নিজের জন্মদাতাকে খুঁজতে গিয়ে পেলেন মায়ের ধর্ষককে

নিউইয়র্কের রচেস্টারে ফিঙ্গার লেকস ডেভেলেপমেন্টাল ডিজঅ্যাবিলিটিজ সার্ভিস অফিস পরিচালিত মনরো ডেভেলমেন্টাল সেন্টারের সাইনবোর্ড। ৮ মার্চ তোলা
ছবি: এপি

মাগদালেনা ক্রুজের কাছে নিজের জন্ম নিয়ে অন্যের কাছ থেকে শোনা স্মৃতি গল্প মোটেই আনন্দের নয়। ছোটবেলা থেকে তিনি জেনে এসেছেন, একটি অপরাধের ফসল তিনি।

১৯৮৬ সালে মাগদালেনার জন্ম। কিন্তু তাঁর মা অন্য আর দশটা মায়ের মতো সন্তানের যত্ন নিতে পারেননি। কারণ, তিনি কথা বলতে পারতেন না, এমনকি তাঁর মানসিক বিকাশও হয়নি। ৩০ বছর বয়সেও তাঁর মানসিক বুদ্ধিবৃত্তি ছিল দুই বছরের শিশুর মতো। তাঁর মা এক দশক নিউইয়র্কের রচেস্টার শহরে প্রতিবন্ধীদের একটি সরকারি আশ্রয়কেন্দ্রে ছিলেন। সেখানে তাঁকে ডায়াপার পরিয়ে রাখতে হতো। সার্বক্ষণিক তাঁর যত্ন নিতে হতো। যৌনমিলন কী বা সেটাতে সম্মতি দেওয়ার মতো জ্ঞানবুদ্ধি তাঁর ছিল না। কিন্তু যখন তিনি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়লেন, তখন নিশ্চিত হওয়া গেল যে তিনি ধর্ষণের শিকার হয়েছেন।

প্রতিবন্ধীকেন্দ্রের কর্মীরা এই নারীর পরিবারকে জানান, সেখানে থাকা আরেকজন বাসিন্দা সম্ভবত এ জন্য দায়ী। তাঁরা বলেন, ঘটনাটি পুলিশকে জানাবেন এবং অভ্যন্তরীণ তদন্তও করা হবে।

সেই ঘটনার পর মাগদালেনার জন্ম। এরপর প্রায় চার দশক কেটে গেছে। মাগদালেনা বললেন, ডিএনএ টেস্ট ও বংশগত ডেটাবেজের সহায়তায় তিনি নিজেই তাঁর বাবার পরিচয় বের করেছেন। চলতি সপ্তাহে তিনি এ ঘটনায় মামলা করেছেন। এতে তিনি অভিযোগ করেন, তাঁর মাকে ধর্ষণ করেছেন সেন্টারের একজন কর্মী, কোনো বাসিন্দা নন।

মামলায় অভিযোগ করা হয়, মাগদালেনা বাবার পরিচয় খুঁজতে গিয়ে দেখেছেন, এ ঘটনায় থানায় কোনো অভিযোগ করা হয়নি। সেন্টারের কোনো কর্মীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি। এমনকি সেন্টার পরিচালনাকারীদের পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

মামলাটি করা হয় প্রতিবন্ধীকেন্দ্র পরিচালনাকারী রাষ্ট্রীয় সংস্থা অফিস ফর পিপল উইথ ডেভেলপমেন্ট ডিজঅ্যাবিলিটিজের বিরুদ্ধে। ক্রুজের আইনজীবী মামলায় অভিযোগ করেন, তাঁর জন্ম ঘিরে সেই সময়ের ঘটনাগুলো তাঁর পরিবার যতটা উপলব্ধি করেছিল, তা তার চেয়ে অনেক বেশি ভয়াবহ ও জঘন্য ছিল।

ওই ঘটনায় এখন আর ফৌজদারি অভিযোগ আনার সুযোগ নেই। কারণ, এ ঘটনায় আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সময়সীমা অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। ২০১৯ সালে নিউইয়র্কে ধর্ষণ আইনে সংশোধনী আনায় এখন মামলাটি সম্ভব হয়েছে।

মাগদালেনা তাঁর জন্মের ঘটনা নিয়ে অনুসন্ধান চার বছর আগে শুরু করেন। তাঁর আইনজীবীর ভাষ্য, অনুসন্ধানের শুরুতে তাঁর মা ঘটনার সময় যে কেন্দ্রে ছিলেন, সে সময়ের নথি বের করেন। এ জন্য তাঁকে সংশ্লিষ্ট পৌরসভা ও রাজ্যের কর্তৃপক্ষের কাছে ধরনা দিতে হয়েছিল। এরপর তিনি সে সময়কার মনরো ডেভেলপমেন্টাল সেন্টার থেকে তাঁর মা সম্পর্কে কিছু তথ্য পান। সেখানে তাঁর মা অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার আগে ও পরে শরীরের স্পর্শকাতর জায়গায় কিছু আঘাতের চিহ্ন ছিল বলে উল্লেখ রয়েছে।

একজন তত্ত্বাবধায়ক মাগদালেনার মা সম্পর্কে লিখেছেন, ‘বাদামি বর্ণের পুরুষ পছন্দ করে, নগ্ন হয়ে যায়, কখনো চিৎকার করে, লাফিয়ে ওঠে, দ্রুত খায়।’ মাগদালেনার বিশ্বাস, এই ব্যক্তি তাঁর বাবা।

ফিঙ্গার লেকস ডেভেলেপমেন্টাল ডিজঅ্যাবিলিটিজ সার্ভিস অফিসের প্রবেশ পথ। ৮ মার্চ তোলা
ছবি: এপি

কিন্তু এসব রেকর্ড দেখে ক্ষুব্ধ হন মাগদালেনা। এরপর তিনি অ্যানসেসস্ট্রিডটকমের মাধ্যমে জেনেটিক পরীক্ষা করান এবং ভার্জিনিয়াতে তাঁর বাবার দিকের থাকা রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়দের সঙ্গে মিলিয়ে দেখেন। অনলাইনে ওই পরিবারের ছবি খোঁজে পান। সেখানে দেখেন, একটি মেয়ের চোখ তাঁর চোখের মতো। তিনি ওই মেয়ের বাবাকে শনাক্ত করেন। এরপর অনলাইনে খোঁজাখুঁজি করে তিনি দেখেন, ওই ব্যক্তি একসময় রচেস্টারের বসবাস করেছেন। তিনি যেখানে থাকতেন, তা মনরো ডেভেলপমেন্টাল সেন্টার থেকে খুব বেশি দূরে নয় এবং ওই সময়ে তাঁর জন্ম হয়।

২০১৯ সালে ক্রুজ সব তথ্য নিয়ে পুলিশের দ্বারস্থ হন। পুলিশও তাঁকে নিশ্চিত করে, ওই ব্যক্তি সেই সেন্টারে কাজ করতেন। কিন্তু অনেক আগেই অভিযোগ আনার সময় শেষ হয়ে গেছে।

১৯৮০-এর দশকে মনরো ডেভেলপমেন্ট সেন্টার সম্পর্কে এই পরিবারের কোনো ধারণাই ছিল না। সেখানে এমন অনেক নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছিল। সেন্টারটি ২০১৩ সালে সরকার বন্ধ করে দেয়।

সেন্টারের সুপারভাইজার, নিরাপত্তারক্ষী, স্বেচ্ছাসেবকসহ ১৯৭৬ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত অন্তত ১০ কর্মীকে ধর্ষক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল।

মাগদানেলার মা এখন আরেকটি প্রতিবন্ধীকেন্দ্রে আছেন। তাঁর আইনজীবী সুসান ক্রুমিলার বলেন, ‘তাঁর সঙ্গে কী ঘটেছে, তিনি কখনো বলতে পারেননি। তিনি অন্তঃসত্ত্বা না হলে তাঁর সঙ্গে কী হয়েছে, তা আমরা কখনো জানতামই না। এমনকি তাঁর মেয়ে যদি তদন্ত না করত, তাহলে আমরা এখনো প্রতিষ্ঠানটি সম্পর্কেও জানতাম না।’

রেকর্ডে দেখা যায়, ওই নারীর মূত্রাশয়ে সমস্যা ছিল। অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পর সেন্টার পরিচালনাকারীরা তাঁর মূত্রাশয় সমস্যার চিকিৎসা করাতে গিয়ে জন্মনিয়ন্ত্রণব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছিলেন।

ক্রুমিলার বলেন, জন্মনিয়ন্ত্রণের সুপারিশের পেছনে ক্রমাগত অপরাধ লুকিয়ে রাখা ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্য থাকতে পারে না।

তবে অফিস ফর পিপল উইথ ডেভেলপমেন্ট ডিজঅ্যাবিলিটিজ (ওপিডব্লিউডিডি) বিচারাধীন বিষয়ে মন্তব্য করতে চায়নি। তারা বলেছে, সেন্টারে যাঁদের সহায়তা দেওয়া হয়, তাঁদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা ওপিডব্লিউডিডির সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার।

ক্রুমিলার বলেন, ‘আমরা সম্ভবত কখনোই জানতে পারব না, কত রোগী এই সেন্টারে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, কতবার হয়েছেন। সেখানে আর কত ধর্ষক ছিলেন। কারণ, কেন্দ্রটি এসব অপরাধ ঢেকে রাখার চেষ্টা করেছিল।’