মৃতদেহে রক্ত সঞ্চালনে সাফল্য

রক্ত সঞ্চালন
প্রতীকী ছবি। রয়টার্স

বিজ্ঞানীরা এক ঘণ্টা আগে মারা যাওয়া একটি শূকরের দেহে পুনরায় রক্তপ্রবাহ চালুর পাশাপাশি কোষ পুনরুজ্জীবিত করার দাবি করেছেন। গত বুধবার মার্কিন গবেষকদের একটি দল এই ঘোষণা দেয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘যুগান্তকারী এই সফলতার অর্থ হচ্ছে, এখন মৃত্যুর সংজ্ঞা আমাদের নতুন করে ভাবা উচিত।’ খবর এএফপি

বিজ্ঞানীদের নতুন এই গবেষণা সফলতা ভবিষ্যতে মানুষের চিকিৎসায় ব্যবহারের আশা জাগিয়েছে। মূলত, যাঁদের অঙ্গ প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন, তাঁদের জন্য এটি কাজে লাগবে। এতে বিশ্বজুড়ে হাজারো মানুষের প্রাণ বাঁচানো যাবে।

তবে এ পদ্ধতির নৈতিকতা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হতে পারে। কারণ, গবেষণা করার সময় দৃশ্যত কিছু মৃত শূকর হঠাৎ মাথা নড়াচড়া করে বিজ্ঞানীদের চমকে দিয়েছিল।

এর আগে ২০১৯ সালে মার্কিন গবেষক দলটি শূকরের মস্তিষ্কের কোষ পুনরুজ্জীবিত করা নিয়ে গবেষণা করে। তখন কয়েকটি শূকরের মাথা কেটে ফেলার কয়েক ঘণ্টা পর এটির মস্তিষ্কের কোষের কার্যকারিতা ফিরিয়ে এনে বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায়কে হতবাক করে দিয়েছিলেন তাঁরা।

যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীদের সাম্প্রতিক গবেষণাসংক্রান্ত নিবন্ধটি প্রখ্যাত আন্তর্জাতিক সাময়িকী নেচার–এ প্রকাশিত হয়েছে। গবেষকেরা বলছেন, ২০১৯ সালের গবেষণা পদ্ধতিটি শূকরের পুরো শরীরের ওপর চালান। মানে, মস্তিষ্কের পাশাপাশি তাঁরা পুরো শরীরে রক্ত সঞ্চালন করে দেখতে চেয়েছিলেন। এ জন্য তাঁরা অচেতন হয়ে যাওয়া একটি শূকরের হৃদ্‌যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ করে দেন, যার মাধ্যমে প্রাণীটির শরীরে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এতে শরীরের কোষগুলোতে অক্সিজেন সরবরাহও বন্ধ হয়ে যায়। মূলত অক্সিজেন ছাড়া স্তন্যপায়ী প্রাণীর কোষগুলো মারা যায়। শূকরটি মারা যাওয়ার এক ঘণ্টা পর এটিকে নিয়ে গবেষণা শুরু হয়।

বিজ্ঞানীরা শূকরের শরীরে রক্ত সঞ্চালনের পাশাপাশি রক্ত কোষে অক্সিজেন সরবরাহকারী প্রোটিন বা কৃত্রিম হিমোগ্লোবিন ও রক্ত জমাট বাঁধা ঠেকাতে বিশেষ ওষুধ প্রয়োগ করেন। এতে দেখা যায়, শূকরের শরীরে আবার রক্ত সঞ্চালন শুরু হয়েছে এবং হৃদযন্ত্র, লিভার ও কিডনির মতো অঙ্গের কোষগুলো আবার সচল হয়েছে। পরীক্ষায় ছয় ঘণ্টা পর্যন্ত এসব অঙ্গ সচল রাখতে পারেন তাঁরা।

গবেষণার জ্যেষ্ঠ লেখক এবং যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক নেনাড সেস্তান সাংবাদিকদের বলেন, শূকরের কোষগুলোর কার্যকারিতা বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা থাকলেও কয়েক ঘণ্টা পর্যন্ত তা সক্রিয় ছিল। এটা আমাদের নির্দেশ করে, কোষের মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব।

গবেষণা প্রবন্ধের সহ-প্রধান লেখক ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ডেভিড আন্দ্রিজেভিক বলেন, তাঁদের উদ্ভাবিত পদ্ধতিটির নাম ‘অরগ্যানএক্স’। তাঁরা আশা করছেন, ক্ষতিগ্রস্ত অঙ্গে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে।

যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিউচার অব হিউম্যানিটি ইনস্টিটিউটের অ্যান্ডার্স স্যান্ডবার্গ বলেছেন, ‘অস্ত্রোপচারের নতুন ধরন উদ্ভাবনে সহায়তা করতে পারে অরগ্যানএক্স পদ্ধতি।’

নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োইথিসিস্ট ব্রেনদান প্যারেন্ট বলেন, এই পদ্ধতিটি মানুষকে পুনরুজ্জীবিত করতেও ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে, এতে রোগীকে এমন একটি অবস্থায় ফেলার ঝুঁকি থাকে, যাতে লাইফ সাপোর্ট ছাড়া তাঁর বেঁচে থাকা অসম্ভব। মানুষ জীবন্মৃত অবস্থায় থাকবে।

এনওয়াইইউ গ্রসম্যান স্কুল অব মেডিসিনের স্যাম পার্নিয়া বলেছিলেন, অসাধারণ এবং অবিশ্বাস্যভাবে উল্লেখযোগ্য গবেষণা এটি। মৃত্যু হলো একটি জৈবিক প্রক্রিয়া। এটি চিকিত্সাযোগ্য এবং মৃত্যু হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পরও কোষের কার্যকলাপ ফিরিয়ে আনা যায়।

যুক্তরাজ্যের নটিংহাম ট্রেন্ট ইউনিভার্সিটির দার্শনিক বেঞ্জামিন কার্টিস বলেছেন, এখন মৃত্যুর সংজ্ঞা নতুনভাবে দাঁড় করার প্রয়োজন পড়তে পারে। বর্তমানে মৃত্যুর মেডিকেল সংজ্ঞা হচ্ছে, একজন মানুষের দেহের কার্যক্রম পুরোপুরি অচল না হওয়া পর্যন্ত সত্যিকার অর্থে তাঁকে মৃত বলা যাবে না। আর এটা হতে কয়েক ঘণ্টা লাগে।