ফিলিস্তিনি-ইসরায়েল সংঘাত: মার্কিন গণমাধ্যমের কাছে খোলা চিঠি

ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় নির্বিচার হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল
ছবি: এএফপি

চলমান রক্তক্ষয়ী ফিলিস্তিনি-ইসরায়েল সংঘাতের প্রেক্ষাপটে মার্কিন গণমাধ্যম বরাবর ১৬ অক্টোবর একটি খোলা চিঠি দিয়েছেন বিশ্বের কয়েক শ খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ।

চিঠিতে বলা হয়, তাঁরা যাঁরা শিক্ষাবিদ হিসেবে ফিলিস্তিন-ইসরায়েল অধ্যয়ন নিয়ে কাজ করছেন, এ বিষয়ে শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষকে আলোকিত করার কাজ করেছেন, তাঁরা বেশির ভাগ মার্কিন মুদ্রণ-সম্প্রচারমাধ্যমে এ-সংক্রান্ত সংবাদের পরিবেশন দেখে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।

সিএনএনের ‘যুদ্ধে ইসরায়েল’ প্রতিপাদ্যের সংবাদে গাজাকে দৃশ্যপট থেকে মুছে দিয়ে ইসরায়েলের দৃষ্টিভঙ্গিকে ঢালাওভাবে গ্রহণ করা হয়েছে। তারা সংঘাত নিয়ে ইসরায়েলের বয়ান ধারাবাহিকভাবে প্রচার করে যাচ্ছে। তারা ইসরায়েলি নারীদের ধর্ষণ, শিশুদের হত্যার ভিত্তিহীন অভিযোগ তুলে ধরছে। ইরাকে হামলার প্রেক্ষাপট ফাঁদা ও ৯/১১-পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের পর তাঁরা এত বিচার-বিবেচনা ও দায়িত্বজ্ঞানহীন সাংবাদিকতা আর লক্ষ করেননি।

কাণ্ডজ্ঞান ও ন্যূনতম পেশাগত সততার কথা বাদ দিলেও শুধু অভিজ্ঞতা থেকেই সবার বোঝা উচিত, এ–জাতীয় উত্তেজক ও অমানবিক সংবাদ প্রচার কতটা বিপজ্জনক।

শিক্ষাবিদের আশা, অন্যরাও তাঁদের মতো এই বিষয়টি বিশ্বাস করেন যে বিশেষ করে ক্ষমতা প্রদর্শন ও যুদ্ধ পরিস্থিতিতে সাংবাদিকতার সবচেয়ে পরিশীলিত রূপ হলো সন্দেহপ্রবণ হওয়া, সংকোচহীনভাবে সমালোচনা করে যাওয়া। এভাবেই সাংবাদিকতা চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে তার প্রধান গণতান্ত্রিক ভূমিকা পালন করে। মানুষকে সঠিক জ্ঞান ও যৌক্তিক দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে বুদ্ধিদীপ্ত নীতি নির্ধারণে সক্ষম করে তোলে।

এই ইস্যুতে দায়িত্বশীলভাবে সংবাদ পরিবেশনের জ্ঞান ও উপায় দুটোই মার্কিন গণমাধ্যমের রয়েছে। গণমাধ্যমের অনেকেই ২০২২ সালে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী কর্তৃক ফিলিস্তিনি-আমেরিকান সাংবাদিক শিরিন আবু আকলের হত্যার তদন্ত করেছে। এই ঘটনার জেরে সবাই জানে, ইসরায়েলি সামরিক ও অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তা কতটা মিথ্যাশ্রয়ী হতে পারেন।

গণমাধ্যমের সেই সন্দেহপ্রবণ দৃষ্টিভঙ্গি আজ কোথায়, যখন এটাই আজ সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন?

সাংবাদিকতার জায়গা থেকে আজ কেন কোনো ধরনের চাপ প্রয়োগ দেখা যাচ্ছে না? কেনই-বা গাজায় সংঘটিত যুদ্ধাপরাধকে ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের প্রচারিত বানোয়াট-ভিত্তিহীন দাবিগুলোকে গণমাধ্যম প্রশ্নের মুখে ফেলছে না?

এটা তাঁদের (শিক্ষাবিদ) কাছে বেশ স্পষ্ট যে ইসরায়েল সরকার গাজা উপত্যকায় গণহত্যাকে জায়েজ করতে পশ্চিমা জনমত গঠনের চেষ্টা করে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে এই ধারাবাহিকতায় গাজায় প্রায় তিন হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে, যাদের মধ্যে এক হাজারের বেশি শিশু আছে।

ফিলিস্তিনিদের কোনো ধরনের ‘উসকানি’ দেওয়া হয়নি বলে একটি প্রেক্ষাপট তৈরি করা হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটের মাধ্যমে ইসরায়েল যুদ্ধাপরাধের প্রক্রিয়াকে অব্যাহত রেখেছে।

এখানে সত্য হলো, শুধু ২০২৩ সালেই ইসরায়েল ৪৭ জন শিশুসহ ২৫০ জনের বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে।

৭ অক্টোবরের আগে মার্কিন গণমাধ্যম কেন দশকের পর দশক ধরে ফিলিস্তিনিদের ওপর চালানো ইসরায়েলি সহিংসতা-ধ্বংসযজ্ঞ নিয়ে প্রতিবেদন বা সমালোচনা করেননি। কেন দেখে মনে হচ্ছে যে গাজার যন্ত্রণা-দুর্ভোগ নথিভুক্ত করার মতো কোনো প্রতিবেদকই মার্কিন গণমাধ্যমের নেই। কেন ফিলিস্তিনিদের অভিজ্ঞতা বা বয়ান পাঠকদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার মতো সদিচ্ছা মার্কিন গণমাধ্যমের নেই।

এসব নিয়ে বিচার-বিবেচনা করার যথেষ্ট সময় পাওয়া যাবে। তবে এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি কাজ হলো, ডামাডোল আরও না বাড়িয়ে অতি সত্বর এসব বন্ধ করা।

৭ অক্টোবর থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত ১১ ফিলিস্তিনি সাংবাদিক সহকর্মীকে ইসরায়েলিরা হত্যা করেছে। আসছে দিনগুলোতে আরও অনেক ফিলিস্তিনির কণ্ঠ চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়া হবে।

মার্কিন গণমাধ্যমের কাছে শিক্ষাবিদদের দাবি হলো, ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর ইসরায়েলি সহিংসতার বিচার-বিবেচনাহীন সংবাদ এখনই বন্ধ করা হোক। এখনই তারা তাদের দায়িত্ব পালন করুন।

মার্কিন গণমাধ্যমগুলোকে অবিলম্বে চারটি পদক্ষেপ নিতে আহ্বান জানান শিক্ষাবিদেরা। এগুলো হলো—
* ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য কর্মকর্তার ব্যাপারে সন্দেহপ্রবণ হওয়া। তাঁদের কঠিন প্রশ্নের সম্মুখীন করা। তাঁদের ভিত্তিহীন অভিযোগগুলো তোতাপাখির মতো আওড়াতে অস্বীকৃতি জানানো।
* ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে গাজায় ইসরায়েলি সামরিক দখলদারিসহ ১৬ বছর ধরে শ্বাসরুদ্ধকর ইসরায়েলি আগ্রাসনের প্রেক্ষাপট প্রতিবেদনে অন্তর্ভুক্ত করা। ইসরায়েলের এই আচরণের বারবার নিন্দা জানিয়ে আসছে জাতিসংঘ ও অন্যান্য মানবাধিকার সংগঠন।
* সব প্রতিবেদনে ফিলিস্তিনিদের কথা তুলে ধরুন।
* গণমাধ্যমে কথা বলার জন্য ফিলিস্তিনি অতিথিদের আমন্ত্রণ জানালে আলোচনার বেশির ভাগ সময় ‘সন্ত্রাসবাদ’ ও হামাসের নিন্দা প্রচেষ্টায় ব্যয় করে ফেলার প্রবণতা বন্ধ করুন।

গণমাধ্যমগুলো মাঝেমধ্যে যেসব অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ প্রতিবেদন-বিশ্লেষণ প্রচার-প্রকাশ করেছে, তাঁরা (শিক্ষাবিদেরা) সেগুলো উপেক্ষা করছেন না। কিংবা তার প্রশংসা করতে তাঁরা কুণ্ঠিত হন না। তাঁর চান, গণমাধ্যমগুলো ধারাবাহিকভাবে আরও বস্তুনিষ্ঠ হোক। সেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে তাঁরা সহযোগিতা-সমর্থনের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন।

চিঠিতে স্বাক্ষরকারী অন্যতম ব্যক্তিরা হলেন—
১. লিলা আবু-লুঘদ, অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান, কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি
২. ওয়ালিদ আফিফি, অধ্যাপক, যোগাযোগ, ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটি সান্তা বারবারা
৩. নাদজে আল-আলী, অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান ও মধ্যপ্রাচ্য অধ্যয়ন, ব্রাউন ইউনিভার্সিটি
৪. এভলিন আলসুলতানি, অধ্যাপক, ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া
৫. সাঈদ আতশান, সহযোগী অধ্যাপক, শান্তি-সংঘর্ষ অধ্যয়ন ও নৃবিজ্ঞান, সোর্থমোর কলেজ
৬. খলিল বারহুম, স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি
৭. মোস্তফা বায়োমি, অধ্যাপক, সিটি ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক-ব্রুকলিন কলেজ
৮. হাতেম বাজিয়ান, প্রভাষক, মধ্যপ্রাচ্যের ভাষা ও সংস্কৃতি, ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া বার্কলে
৯. জোয়েল বেইনিন, অধ্যাপক, মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস, স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি
১০. নিনা বারম্যান, অধ্যাপক, সাংবাদিকতা, কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি
১১. আমাল বিশারা, সহযোগী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান, টাফটস ইউনিভার্সিটি
১২. জর্জ বিশারাত, অধ্যাপক, আইন, ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া-কলেজ অব দ্য ল, সান ফ্রান্সিসকো
১৩. পলা চক্রবর্তী, সহযোগী অধ্যাপক, গণমাধ্যম অধ্যয়ন, নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি
১৪. ওমর দাজানি, অধ্যাপক, আইন, ম্যাকজর্জ স্কুল অব ল
১৫. করম ডানা, বিশিষ্ট অধ্যাপক, উত্কর্ষ ও রূপান্তরমূলক গবেষণা, ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটন, বোথেল
১৬. বেশারা দোমানি, অধ্যাপক, প্যালেস্টাইন স্টাডিজ, ব্রাউন ইউনিভার্সিটি
১৭. দানা এল কুর্দ, সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইউনিভার্সিটি অব রিচমন্ড
১৮. জুলিয়া ইলিয়াচার, সহযোগী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান, প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি
১৯. নুরা এরাকাত, সহযোগী অধ্যাপক, আফ্রিকানা স্টাডিজ অ্যান্ড প্রোগ্রাম ইন ক্রিমিনাল জাস্টিস, রাটগার্স ইউনিভার্সিটি নিউ ব্রান্সউইক
২০. রিচার্ড ফক, অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক আইন, প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি
২০. লিলা ফারসাখ, অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইউনিভার্সিটি অব ম্যাসাচুসেটস বোস্টন
২১. কিথ ফেল্ডম্যান, সহযোগী অধ্যাপক, এথনিক স্টাডিজ, ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া বার্কলে
২২. গ্যারি ফিল্ডস, অধ্যাপক, যোগাযোগ, ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া সান দিয়েগো
২৩. লিসা হাজ্জার, অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান, ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া সান্তা বারবারা
২৪. রোজিনা হাসান, অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান, সাগিনাউ ভ্যালি স্টেট ইউনিভার্সিটি
২৫. মাহমুদ ইব্রাহিম, ইমেরিটাস অধ্যাপক, ইতিহাস, ক্যাল পলি পোমোনা
২৬. রশিদ খালিদি, অধ্যাপক, আধুনিক আরব অধ্যয়ন, কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি
২৭. ড্যারিল লি, সহযোগী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান, ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো
২৮. জাচারি লকম্যান, অধ্যাপক, মধ্যপ্রাচ্য, ইসলামি অধ্যয়ন ও ইতিহাস, নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি
২৯. অ্যালেক্স লুবিন, অধ্যাপক, আফ্রিকান আমেরিকান স্টাডিজ, পেনসিলভানিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি
৩০. সুনাইনা মাইরা, অধ্যাপক, এশিয়ান আমেরিকান অধ্যয়ন, ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া ডেভিস
৩১. শারি মাকদিসি, অধ্যাপক, ইংরেজি ও তুলনামূলক সাহিত্য, ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া লস অ্যাঞ্জেলেস
৩২. উসামা মাকদিসি, অধ্যাপক, ইতিহাস, ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া বার্কলে
৩৩. মেলানি ম্যাকঅ্যালিস্টার, অধ্যাপক, আমেরিকান অধ্যয়ন ও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি, জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি
৩৪. মায়া মিকদাশি, সহযোগী অধ্যাপক, উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ, রাটজার্স ইউনিভার্সিটি
৩৫. টিমোথি মিচেল, অধ্যাপক, মিডল ইস্টার্ন স্টাডিজ, কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি
৩৬. নাদিন নাদের, অধ্যাপক, জেন্ডার অ্যান্ড উইমেন স্টাডিজ, ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয় শিকাগো
৩৭. মাহা নাসার, আধুনিক মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস ও ইসলামি অধ্যয়ন, ইউনিভার্সিটি অব অ্যারিজোনা
৩৮. ডেভিড পালুম্বো-লিউ, অধ্যাপক, তুলনামূলক সাহিত্য, স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি
৩৯. জেনিস পেক, অধ্যাপক, গণমাধ্যম অধ্যয়ন, ইউনিভার্সিটি অব কলোরাডো বোল্ডার
৪০. জুলি পেটিট, অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান, ইউনিভার্সিটি অব লুইসভিল
৪১. রাশ রেহম, অধ্যাপক, নাট্য ও ধ্রুপদি, স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি
৪২. সারা রায়, সহযোগী, সেন্টার ফর মিডল ইস্টার্ন স্টাডিজ, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি
৪৩. ওয়াডি সাইদ, অধ্যাপক, আইন, ইউনিভার্সিটি অব কলোরাডো স্কুল অব ল
৪৪. শেরেন সিকালি, সহযোগী অধ্যাপক, ইতিহাস, ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, সান্তা বারবারা
৪৫. আবদেল রাজ্জাক তকরিত, প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, আরব অধ্যয়ন কেন্দ্র, ইউনিভার্সিটি অব হিউস্টন
৪৬. হেলগা তাভিল-সৌরি, সহযোগী অধ্যাপক, গণমাধ্যম, সংস্কৃতি ও যোগাযোগ, নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি
৪৭. উইলিয়াম ইউম্যানস, সহযোগী অধ্যাপক, স্কুল অব মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক অ্যাফেয়ার্স, জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি
অনুবাদ: নাসিফ আমিন