নাসার ছবিগুলো কী বলছে

আমরা তো প্রায়ই নতুন নতুন গ্যালাক্সির ছবি দেখি। পত্রিকায় ছাপা হয়। কিন্তু সম্প্রতি নাসার জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের তোলা বেশ কিছু ছবি প্রকাশের পর সারা বিশ্বে সাড়া পড়ে গেছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন নিজে এ ছবিগুলো উন্মোচন করে বিশ্বাসীকে চমকে দিয়েছেন। এসব ছবির মধ্যে নতুনত্বটা কী? কেন সবাই উন্মুখ হয়ে উঠেছেন? নিশ্চয়ই বিশেষ কারণ আছে।

মহাশূন্যের অনেক সংবাদই তো আমরা প্রায় প্রতিদিন দেখি। পত্রিকায় পড়ি। এই তো সেদিন দেখলাম, আমাদের সূর্যে এমন এক সৌরঝড় বয়ে গেছে যে তার ঢেউ এসে পৃথিবীকেও আঘাত হানতে পারে।

কোটি কোটি বছর আগেও নাকি এ রকম একবার হয়েছে। আবার সে রকম হলে হয়তো মানুষের অস্তিত্ব বিপন্ন হতে পারে। কিন্তু না, সৌভাগ্য যে গত দিন সাতেকের মধ্যে এমন কোনো দুর্যোগের মধ্যে আমাদের পড়তে হয়নি।

দুই দিন আগেও একটা খবর দেখেছি। এটা ব্রিটেনের দ্য মিরর পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। মহাকাশ গবেষণাকেন্দ্রে একটি টিপটিপ শব্দ শোনা যাচ্ছে। একটি নির্দিষ্ট সময় অন্তর তিনবার করে টিপটিপ শব্দ। বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখছেন, এটা মহাশূন্যের অজানা কোনো দূরবর্তী গ্রহ থেকে প্রেরিত সংকেত কি না। যদি হয়, দেখতে হবে ওই সংকেতের অর্থ কী।

যাহোক, নাসার টেলিস্কোপ একটা নতুন মাত্রার সন্ধান দিয়েছে। নাসার হাবল টেলিস্কোপ সৌরজগতের বাইরের দূরবর্তী গ্যালাক্সির তারকারাজির ছবি তুলছে। গবেষণার উপাদান সংগ্রহ করছে। কিন্তু ওয়েব টেলিস্কোপের বৈশিষ্ট্য হলো, এটা দূরবর্তী গ্যালাক্সিগুলোর তারকারাজির চিত্র আরও নিখুঁতভাবে তুলতে পারছে। বলা যায় ভেতরের খবর বের করে আনছে। এর মাধ্যমে বিগব্যাংয়ের পর কী হয়েছে, কখন থেকে বিভিন্ন গ্যালাক্সির উদ্ভব, তারপর কীভাবে এই মহাজগৎ পরিবর্তিত হয়ে চলেছে—এসব বিষয়ে আরও গভীরে জানার একটি জানালা খুলে গেছে। বিজ্ঞানীদের মহাকাশ গবেষণার সম্ভাবনা প্রসারিত হয়েছে। এটাই এ মুহূর্তের জন্য সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর খবর।

ওয়েব হলো নাসা পরিচালিত একটি আন্তর্জাতিক কর্মসূচি। এর সঙ্গে রয়েছে ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি (ইএসএ) ও কানাডিয়ান স্পেস এজেন্সি (সিএসএ)। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, ওয়েবের মাধ্যমে মহাবিশ্বের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ রহস্য উন্মোচন করার সম্ভাবনা রয়েছে। শুধু আমাদের সৌরজগৎ নয়, এর বাইরেও মহাবিশ্বের কোথায় কী হচ্ছে, কেন হচ্ছে—এসব অজানা রহস্য উন্মোচন সহজ হবে।

এ মহাবিশ্বের দূরবর্তী গ্যালাক্সির যেসব ছবি প্রকাশিত হয়েছে, তার বিবরণ ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ চলছে। এ বিষয়ে মাসিক ম্যাগাজিন বিজ্ঞানচিন্তায় আমাদের দেশের ও যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাপ্রবাসী বিশেষজ্ঞদের উঁচু মানের লেখা আমরা ছাপাব। তখন হয়তো আজকের এ ওয়েবের কার্যক্রমের বিস্তারিত জানতে পারব।

তিন হাজার কোটি আলোকবর্ষ দূরের গ্যালাক্সি?

বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, অন্ধকার থেকে বিগব্যাংয়ের মহাবিস্ফোরণ ঘটে আজ থেকে প্রায় ১ হাজার ৩৮০ কোটি বছর আগে। তাহলে এ কথা কেন বলা হয় যে বিজ্ঞানীরা হাবল টেলিস্কোপে তিন হাজার কোটি বছর আগের গ্যালাক্সি পর্যবেক্ষণ করেছেন? এটা তো সম্ভব নয়। বিজ্ঞানীদের মতে, বিগব্যাংয়ের আগে তো ছিল সব অন্ধকার। এর আগের কোনো গ্যালাক্সির অস্তিত্বের প্রশ্নই ওঠে না। এটা ঠিক। আসলে এখানে যে তিন হাজার কোটি বছর আগের গ্যালাক্সি পর্যবেক্ষণের বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে, সেটি হলো তার বর্তমান অবস্থানের দূরত্ব। এর উদ্ভব ঘটেছিল অন্তত ১ হাজার ৩৩০ থেকে ১ হাজার ৩৪০ কোটি বছর আগে এবং তখন এর দূরত্ব ছিল অনেক কম।

জ্যোতির্বিদেরা হাবল ও ওয়েব দুরবিনে ধারণকৃত বহু দূরের যেসব গ্যালাক্সির বর্ণালি বিশ্লেষণ করে বলতে পারছেন, সেসব গ্যালাক্সি থেকে আলো রওনা দিয়েছিল ১ হাজার ৩৩০ থেকে ১ হাজার ৩৪০ কোটি বছর আগে। মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে প্রায় ১ হাজার ৩৮০ কোটি বছর আগে। তার মানে ওই সব গ্যালাক্সি সৃষ্টি হয়েছে বিগব্যাংয়ের ৮০ কোটি বছরের মধ্যে।

যে সময়ের আলো আমরা এখন দেখছি ওই গ্যালাক্সিগুলো থেকে, তখন মহাবিশ্বের আকার এখন থেকে ১০ গুণেরও ছোট ছিল। আর তাই ওই গ্যালাক্সিগুলো আমাদের অনেক কাছে ছিল। মনে করা হয়, ওই গ্যালাক্সিগুলো তখন আমাদের থেকে মাত্র ৩০০ কোটি আলোকবর্ষ দূরে ছিল, কিন্তু প্রায় ১ হাজার ৩০০ কোটি বছর ধরে মহাবিশ্বের প্রসারণের কারণে সেই গ্যালাক্সিগুলো আমাদের থেকে দূরে সরতে সরতে এখন ৩ হাজার কোটি আলোকবর্ষ দূরে চলে গেছে।

তাই ওয়েব দুরবিন যে ছবি তুলেছে, সেই আলো আমাদের কাছে আসতে ১ হাজার ৩০০ কোটি বছর লাগলেও ওই সব গ্যালাক্সি তখন তুলনামূলকভাবে কাছে ছিল, আর তাদের সে সময়ের ছবিই আমরা দেখছি। ১ হাজার ৩০০ কোটি বছর পরে ‘এই মুহূর্তে’ ওরা যে দূরত্বে আছে (৩০০০ কোটি আলোকবর্ষের বেশি), সে আলো আমরা দেখছি না।

মনে করা হয়, আমরা যত হাজার কোটি বছর অপেক্ষা করি না কেন, সেই আলো আমরা কখনোই দেখব না। কারণ, ইতিমধ্যে মহাশূন্যের অব্যাহত সম্প্রসারণের জন্য ওই গ্যালাক্সিগুলো আমাদের থেকে ক্রমাগত আরও দূরে সরে যাচ্ছে এবং সেখান থেকে আলোক তরঙ্গ কখনোই আমাদের কাছে আর পৌঁছাবে না।

এসব বিষয়ে আমরা বিভিন্ন বিশেষজ্ঞের বিশ্লেষণ ও লেখায় আরও পরিষ্কারভাবে জানতে পারব।

লেখক: আব্দুল কাইয়ুম, সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো এবং মাসিক ম্যাগাজিন বিজ্ঞানচিন্তার সম্পাদক