ট্রাম্পের আলকাট্রাজ চালুর ঘোষণা: মনে করিয়ে দিচ্ছে সেই তিন ‘ম্যাকগাইভার’ বন্দীর পালানোর ঘটনা
আলকাট্রাজ দুর্ভেদ্য। এটাই কুখ্যাত এ কারাগারের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এখান থেকে কেউ পালাতে পারে না। কিন্তু একে যত দুর্ভেদ্য বলা হোক না কেন, এ কারাগার থেকেও পালানোর ঘটনা রয়েছে। যাঁরা এ ঘটনা ঘটিয়েছিলেন তাঁদের শুধু বুদ্ধি, সাহস আর ৫০টি রেইনকোট।
১৯৬২ সালের ১১ জুন। তিনজন বন্দী, যাঁদের বয়স তিরিশের কোঠায় সেই ফ্যাঙ্ক মরিস এবং দুই ভাই ক্লারেন্স ও জন অ্যাংলিন নিজেদের কারাকক্ষের দেয়ালে তৈরি লুকানো গর্ত দিয়ে বেরিয়ে পড়েন। এরপর নিজেদের তৈরি ভেলা নিয়ে চুপিচুপি বেরিয়ে পড়েন। তাঁদের এই দুঃসাহসী কাজ করতে গিয়ে কারাগার থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পথে পাইপ দিয়ে তাঁদের ছাদে উঠতে হয়েছিল। দেয়াল টপকে সান ফ্রান্সিসকো উপসাগরের হিমশীতল ও ঢেউতোলা পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে দ্বীপের মধ্যে তৈরি আলকাট্রাজ দুর্গ থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আবার এ কারাগারটি চালুর নির্দেশ দিয়েছেন। দ্বীপের কারাগারটি থেকে সত্যিকার অর্থেই পালানো অসম্ভব—এ ধারণাটিই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রস্তাবের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। যুক্তরাষ্ট্রের কারা ব্যুরো এটি চালানো ব্যয়বহুল হওয়ায় ৬০ বছরের বেশি আগে বন্ধ করে দেয়।
সম্প্রতি ওভাল অফিসে ট্রাম্প দাবি করেন, ‘আলকাট্রাজ থেকে কেউ কোনো দিন পালাতে পারেনি।’ ট্রাম্প বলেছেন, তিনি তাঁর সরকারকে ক্যালিফোর্নিয়ার উপকূলের কাছে একটি দ্বীপে অবস্থিত কুখ্যাত কারাগার আলকাট্রাজ আবার চালু ও সম্প্রসারণের নির্দেশ দিয়েছেন। ৪ মে নিজের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে দেওয়া এক বার্তায় ট্রাম্প বলেন, ‘অনেক বেশি দিন ধরে আমেরিকা হিংস্র, সহিংস এবং পুনরাবৃত্ত অপরাধীদের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেন, ‘আইন, শৃঙ্খলা ও ন্যায়বিচারের প্রতীক হিসেবে আলকাট্রাজ আবার চালু করা হবে।’
এ কারাগারটি ১৯৬৩ সালে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। বর্তমানে আলকাট্রাজ দ্বীপ একটি পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এটি সান ফ্রান্সিসকোর গোল্ডেন গেট ব্রিজের কাছাকাছি অবস্থিত।
এই কারাগারে ‘আমেরিকার সবচেয়ে নিষ্ঠুর ও সহিংস অপরাধীদের’ রাখা হবে বলে জানান ট্রাম্প।
আলকাট্রাজ প্রথমে একটি নৌ প্রতিরক্ষা দুর্গ ছিল। ২০ শতকের শুরুতে এটিকে একটি সামরিক কারাগারে রূপান্তর করা হয়। ১৯৩০-এর দশকে বিচার বিভাগ এটি দখলে নিয়ে ফেডারেল বন্দীদের গ্রহণ শুরু করে। এর বিখ্যাত কয়েদিদের মধ্যে ছিলেন কুখ্যাত গ্যাংস্টার আল কাপোন, মিকি কোহেন এবং জর্জ ‘মেশিন গান’ কেলি।
১৯৬২ সালে বার্ট ল্যাঙ্কাস্টার অভিনীত ‘বার্ডম্যান অব আলকাট্রাজ’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমেও বিখ্যাত হয়েছিল কারাগারটি। এ ছাড়া ১৯৯৬ সালের জনপ্রিয় চলচ্চিত্র ‘দ্যা রকে’র শুটিংও হয় এই দ্বীপে। ওই মুভিতে শন কনারি ও নিকোলাস কেজ অভিনয় করেছিলেন।
ফেডারেল ব্যুরো অব প্রিজনসের ওয়েবসাইট অনুযায়ী, কারাগারটি চালাতে অত্যধিক ব্যয় হতো বলে এটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। দ্বীপে অবস্থিত হওয়ার কারণে এর খরচ ছিল অন্য যেকোনো ফেডারেল কারাগারের তুলনায় প্রায় তিন গুণ।
তবে এই দুর্ভেদ্য কারাগার ভেঙে বেরিয়ে যাওয়া মরিস ও অ্যাংলিন ভাইদের আর কখনোই খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে অপরাধভিত্তিক কাহিনির ভক্তরা এবং বন্দীদের নিজের পরিবারের সদস্যরাও বিশ্বাস করেন, তাঁরা সত্যিই তীরে পৌঁছেছিলেন এবং জীবনের বাকি সময়টা আইন ও জনসম্মুখ থেকে লুকিয়ে কাটিয়ে দেন। কিন্তু মার্কিন তদন্ত সংস্থা মনে করে, তাঁরা কারাগার থেকে পালাতে গিয়ে মারা যান।
৪০ বছর ধরে এই মামলার তদন্তে জড়িত ছিলেন বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত মার্কিন মার্শাল আর্ট রোডেরিক। তিনি বলেন, ওই মামলার তদন্ত কখনোই থেমে থাকেনি।
আলকাট্রাজে ঢোকা ও বের হওয়া
মরিস ও অ্যাংলিন ভাইয়েরা আমেরিকার সবচেয়ে ভয়ংকর কারাগার আলকাট্রাজে এসেছিলেন ব্যাংক লুটের অপরাধী হিসেবে। তাঁরা যেখানে যেতেন, সেখান থেকেই পালানোর চেষ্টা করতেন। এফবিআই ফাইলে থাকা তাঁদের অপরাধের ইতিহাস তা-ই দেখায়। তবু ক্যালিফোর্নিয়ার ‘দ্য রক’ নামে পরিচিত এই ফেডারেল কারাগার তাঁদের মনোবল ভাঙতে পারেনি। আর থামাতে পারেনি তাঁদের পালানোর রেকর্ডও।
তিন বন্দীর পালানোর রেকর্ড নিয়ে বই লিখেছেন ৫৮ বছর বয়সী ডেভিড উইডনার। বন্দীরা সম্পর্কে তাঁরা মামা। উইডনার লিখেছেন, ‘আসলে তাঁর মামারা আটক থাকতে একদমই পছন্দ করতেন না।’
উইডনার লিখেছেন, তাঁরা গরিব হিসেবে বাঁচতে চাইতেন না। এফবিআইয়ের নথিপত্রে দেখা যায়, গ্রামীণ জর্জিয়ায় আরও প্রায় ডজনখানেক ভাই–বোনের সঙ্গে বড় হওয়া এই দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে সব মিলিয়ে দুই ডজনের বেশি অভিযোগ ছিল। এসব অভিযোগের বেশির ভাগই চুরি ও জোরপূর্বক প্রবেশের জন্য।
উইডনার বলেন, অ্যাংলিন ভাইয়েরা কেবল ভালো কিছু পাওয়ার জন্য এমনটা করেছিলেন। তাঁরা ভালো জীবন চেয়েছিলেন। কিন্তু কীভাবে সেটা অর্জন করতে হয়, সেটা তাঁরা জানতেন না, তাই চুরি করেই চেষ্টা করতেন।
রেকর্ড অনুযায়ী, ক্লারেন্স ও জন অ্যাংলিনের শেষ চুরিটি ছিল আলাবামার কলাম্বিয়ায় একটি ছোট ব্যাংকে। পাঁচ দিন পর তাঁরা ওহাইয়োতে পালানোর সময় ধরা পড়েন। এতে তাঁদের ১৫ বছরের কারাদণ্ড হয়।
কানসাসের লেভেনওয়ার্থে অবস্থিত ফেডারেল পেনিটেনশিয়ারি থেকে পালানোর চেষ্টা করার পর অ্যাংলিন ভাইদের আলকাট্রাজে স্থানান্তর করা হয়। ওই সময় লেভেনওয়ার্থ ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সর্বোচ্চ নিরাপত্তার কারাগার। কারা কর্তৃপক্ষ জানায়, ক্লারেন্স রুটির বাক্সের ভেতরে ধাতব লুকিয়ে পালানোর চেষ্টা করেছিলেন।
এফবিআইয়ের নথি অনুযায়ী, ক্লারেন্স কেবল কারাগারের বেকারি পর্যন্তই পৌঁছাতে পেরেছিলেন, তারপরই ধরা পড়েন। তবে এমন সৃজনশীল উপায়ে পালানোর চেষ্টা অ্যাংলিন পরিবারের কাছে বিস্ময়কর ছিল না। উইডনার সিএনএনকে বলেন, শৈশবে ওই ছেলেরা নানা উপায়ে লুকানোর চেষ্টা করে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন।
যখন অ্যাংলিন ভাইয়েরা আলকাট্রাজে আসেন, তখন সেখানে ফ্রাঙ্ক মরিসকে পান। ফ্রাঙ্ক ছিলেন আরেক মেধাবী ব্যক্তি। দুটি কারাকক্ষে তাঁদের পাশাপাশি রাখার ফলে তাঁরা আবারও পালানোর পরিকল্পনা করেন। এই তিনজনের বাইরে পালানোর ষড়যন্ত্রে অ্যালেন ওয়েস্ট নামে আরেক বন্দীও ছিলেন। তবে তিনি পালাতে পারেননি।
ওয়েস্টের সাক্ষ্য ও এফবিআইয়ের তথ্যে জানা যায়, ১৯৬২ সালের সেই রাতে তিনজন পালিয়ে গেলেও অ্যালেনকে সঙ্গে নেননি তাঁরা। ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই) জানায়, তাঁরা অসাধারণ এক পালানোর পরিকল্পনা করেন, যা ছয় মাস ধরে ধীরে ধীরে বাস্তবায়ন করা হয়েছিল।
সহবন্দীদের কাছ থেকে চুরি করা রাবারের রেইনকোট ও স্টিম পাইপ ব্যবহার করে তাঁরা বিশেষ ভেলা তৈরি করেন। কারাগারের দেওয়া ভ্যাকুয়াম ক্লিনারের মোটর দিয়ে বানানো হয়েছিল একটি বৈদ্যুতিক ড্রিল। চামচ দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল স্ক্রু ড্রাইভার।
১৯৬১ সালের ডিসেম্বর থেকে পরবর্তী ছয় মাসে তাঁরা ধীরে ধীরে তাঁদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে থাকেন। বিভিন্ন স্থান থেকে করা উপকরণের সঙ্গে ডাইনিংরুম থেকে চুরি করা চামচ এবং একটি ভাঙা ভ্যাকুয়াম ক্লিনারের মোটর দিয়ে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন তাঁরা।
এটা ছিল একটি সময়সাপেক্ষ কাজ; কারণ, হাতে বানানো এসব যন্ত্র দিয়ে একবারে খুব বেশি ভাঙা যেত না এবং ড্রিলের শব্দে যাতে কেউ বুঝে না ফেলে, সে বিষয়টি ছিল। তাদের ড্রিলের শব্দ ঢাকা রাখতে মরিস মাঝে মাঝে জোর গলায় গান গাইতেন এবং বাদ্যযন্ত্র বাজাতেন। এ ছাড়া ভেন্টিলেটরগুলোর ওপর স্যুটকেস, কার্ডবোর্ড কিংবা গিটার দিয়ে তাঁদের ঢেকে রাখতেন দিনের বেলায়।
এ ছাড়া কারারক্ষীদের চোখে ধুলো দিতে তাঁরা ডামি মাথা বানাতে শুরু করেন। প্লাস্টার, রং এবং মানুষের চুল দিয়ে নিখুঁতভাবে বানানো হয়েছিল এসব ডামি, যেগুলো শোয়ানো অবস্থায় তাঁদের মতোই দেখাত।
উইডনার বলেন, ‘আমার মা আর ভাই–বোনেরা সব সময় বলতেন, তাঁরা ছিলেন আধুনিক যুগের ম্যাকগাইভার। টেলিভিশনের বিখ্যাত ধারাবাহিক ম্যাকগাইভারে একজন কারিগরি প্রতিভাধর ব্যক্তিকে দেখানো হয়, যিনি তাঁর প্রয়োজনীয় জিনিস তৈরি করতে বিভিন্ন আবিষ্কৃত বস্তু ব্যবহার করে কঠিন পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পান।’ উইডনার বলেন, ‘অ্যাংলিন ভাইয়েরাও কিছু না থাকলেও কিছু একটা তৈরি করে ফেলতে পারতেন।’
তিন কারাবন্দী পালানোর পর তদন্তকারীরা একমত হয়েছিলেন, পালানোর জন্য যেসব কাজ তাঁরা প্রস্তুতির অংশ হিসেবে করেছেন, তা অবিশ্বাস্য। স্পেশাল এজেন্ট ইন চার্জ ফ্রাঙ্ক এল প্রাইস বলেন, তিনজন পালানোর তিন দিন পর এফবিআই একটি নথি জমা দেয়। তাতে বলা হয়, অবিশ্বাস্য কাজ করেছিলেন তিনজন।
তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, তিনজন কারক্সের দেয়ালে গর্ত করতে ড্রিল ব্যবহার করেন। গর্ত বন্ধ রাখতে রং করা কার্ডবোর্ড ব্যবহার করেন। এফবিআইয়ের নথি অনুযায়ী, একটি ইউটিলিটি শাফটের পাইপে উঠে বন্দীরা ভেন্টিলেশন কভারগুলো খুলে ফেলেছিলেন। তারপর একটি চিমনি পাইপ দিয়ে ছাদের দিকে নামতে সক্ষম হন এবং একটির পর একটি বেড়া টপকে চলে যান।
সরকারি নথি বলছে, তাঁরা একটি ভেলা বানিয়ে সেটি চালু করে হিমশীতল অন্ধকারে উধাও হয়ে যান। তদন্তকারী রোডেরিক বলেন, কিছু আকর্ষণীয় প্রমাণ শিগগিরই সামনে আসে। তবে অদ্ভুতভাবে এগুলোর সবই নির্দিষ্ট একটা স্থানে গিয়ে থমকে যায়। আমি জীবনে কখনো এমন কোনো মামলা পাইনি, যার এতগুলো সূত্র ছিল।
এফবিআইয়ের নথি অনুযায়ী, পালানোর কয়েক ঘণ্টা পর তদন্তকারীরা আলকাট্রাজের চারপাশের পানিতে তল্লাশি শুরু করেন। পুলিশকে সতর্ক করা হয়। উপকূলরক্ষী ও আর্মি কর্পস অব ইঞ্জিনিয়ার্স তাদের নৌকা ও একটি হেলিকপ্টার নিয়ে তল্লাশি চালায়। কারাগারের ওয়ার্ডেন ব্ল্যাকওয়েল পুরো আলকাট্রাজে তল্লাশি করতে বলেন। তিনি ভেবেছিলেন, তিন বন্দী সেখানেই লুকিয়ে আছেন।
১০০ সেনা ও ৩৫ জন সামরিক পুলিশ অ্যাঞ্জেল আইল্যান্ডে তল্লাশি চালান, যেটি আলকাট্রাজের ঠিক উত্তর দিকে অবস্থিত। তাঁদের ধারণা, ভেলা নিয়ে সেখানে যেতে পারেন তিনজন। তবে সেখানে তাঁদের পৌঁছানোর কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এফবিআইয়ের একটি প্রতিবেদনে এমনটাই বলা হয়েছে।
এ ঘটনার কয়েক বছর পর অবসরপ্রাপ্ত এফবিআই এজেন্ট জন অ্যারেন্ড বলেছিলেন, ‘অবশ্যই এটি তখনকার সময়ে গণমাধ্যমের সবচেয়ে হট টপিকে পরিণত হয়েছিল। তখন আমাদের কাছে কেবল নিউজ ছিল না, কিন্তু সব গণমাধ্যম তখন এই মামলায় অত্যন্ত আকৃষ্ট ছিল।’
এরপর তাঁদের কাছে প্রথম প্রমাণটি আসে, যা ইঙ্গিত দেয় যে বন্দীরা হয়তো বেঁচে ছিলেন। তবে তাঁদের কাছে উপকূল থেকে খবর আসেনি। তাঁদের কাছে একটি পোস্টকার্ড এসেছিল। যাতে তিন বন্দী বেঁচে আছেন—এমন ইঙ্গিত ছিল।
চিঠিতে লেখা ছিল, ‘হা হা উই মেড ইট।’
পোস্টকার্ডটি এসেছিল আলকাট্রাজ কারাগারের ওয়ার্ডেনের কাছে। তাতে ১৮ জুন তারিখ দিয়ে ফ্রাঙ্ক, জিম ও ক্লারেন্সের হস্তাক্ষর ছিল। হস্তলেখাবিশারদকে কাজে লাগিয়েছিল এফবিআই। তিনি ক্লারেন্সের হাতের লেখাটি ভুয়া বলে দাবি করেন। কিন্তু ফ্রাঙ্ক ও জনের হাতের লেখা মেলানোর মতো নমুনা ছিল না। এফবিআই সিদ্ধান্ত নেয়, পোস্টগার্ডটি প্রতারণা ছিল। জেল পালানোর সংবাদের ঘটনা নিয়ে এটি কেউ পাঠিয়েছিল।
কয়েক দিনের মধ্যে আলকাট্রাজ দ্বীপের কাছাকাছি পানিতে তল্লাশি করা অনুসন্ধানকারীরা গোল্ডেন গেট ব্রিজের কাছে কিছু উপকরণ পান। এফবিআইয়ের নথি অনুযায়ী, সেগুলো ছিল হাতে তৈরি লাইফ জ্যাকেটের একটি অংশ।
ভেলা তৈরির মতো একই উপাদান দিয়ে সিল করা প্যাকেটগুলোর মধ্যে ছিল অ্যাংলিনদের ব্যক্তিগত ছবি এবং পরিবারের ঠিকানা, পাশাপাশি সান ফ্রান্সিসকো অ্যাটর্নির যোগাযোগের তথ্য—যিনি অতীতে আলকাট্রাজের বন্দীদের পক্ষে ছিলেন। ওই অ্যাটর্নি এফবিআইকে জানিয়েছিলেন, তিনি কখনো মরিস বা অ্যাংলিনদের কাছ থেকে কিছু শোনেননি।
সরকারি নথিগুলোতে এমন অনেক মানুষের যোগাযোগ পাওয়া গেছে, যাঁরা দাবি করেছেন যে তাঁরা বন্দীদের দেখতে পেয়েছেন। তবে সেগুলোর কোনোটি বিশ্বাসযোগ্য হয়নি।
অ্যাংলিন পরিবারের বিশ্বাস, এফবিআই মামলার শত শত পৃষ্ঠার নথি প্রকাশ করলেও সংস্থাটি এখনো পুরো ঘটনা সম্পর্কে আলোচনা করতে অনিচ্ছুক।
উইডমার বলেন, ‘তারা এমন কিছু জানে যা তারা বলবে না, কারণ তারা তাদের খুঁজে পায়নি।’
উইডনার আরও বলেন, তিনি তাঁর চাচাদের গল্প প্রথম শোনেন ১৯৭৭ সালে, যখন এফবিআইয়ের চারজন কর্মকর্তা তাঁদের বাড়িতে এসে তাঁর মা মেরিকে তাঁর ভাই ক্লারেন্স এবং জন অ্যাংলিন কোথায় শেষ পর্যন্ত পৌঁছেছেন, সে বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন।
উইডনার বলেন, তাঁর মা বলেছিলেন, তিনি যদি জানতেন তাঁর ভাই কোথায়, তবু তিনি তাঁদের তা বলতেন না।
দুই বছর পর এফবিআই তদন্ত বন্ধ করে দেয়। এফবিআই জানায়, মরিস এবং অ্যাংলিন ভাইয়েরা পালানোর চেষ্টা করে সফলভাবে বেঁচে রয়েছেন, তার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ১৯৭৯ সালের একটি মেমোতে তাঁদের মৃত হিসেবে ধরা হয়।
তবে পলাতক ব্যক্তিদের খুঁজে বের করার জন্য কাজ করা সংস্থা মার্শালস সার্ভিস তাদের ফাইল বন্ধ করেনি। তিনজনকে ধরিয়ে দেওয়ার পোস্টার এখনো সার্ভিসের ওয়েবসাইটে রয়েছে। সরকার তাদের চেহারা কেমন হবে, সে বিষয়ে কম্পিউটারভিত্তিক পোর্ট্রেট তৈরি করেছে।
এ মামলায় পরামর্শক ও অবসরপ্রাপ্ত মার্শাল রোডেরিক বলেন, এখনো কার্যকরী সূত্র আসছে। বারবার সূত্র মিলেছে, তাঁরা বেঁচে আছেন।
তবে ২০০৩ সালে এক রিয়েলিটি শোতে দেখানো হয়, মরিস ও অ্যাংলিন ভাইয়েরা সান ফ্রান্সিসকো বের জোয়ার এবং হিমশীতল ঢেউয়ে বেঁচে থাকতে পারবেন না। তবে ডিসকভারি চ্যানেলের বিজ্ঞানবিষয়ক প্রোগ্রাম ‘মিথবাস্টার্স’ আলকাট্রাজ থেকে তাদের নিজস্ব রেইনকোট ভেলা তৈরি করে, ১৯৬২ সালের পালানোর কৌশল এবং উপকরণগুলোর সঙ্গে যতটা সম্ভব মেলাতে চেষ্টা করে। তাতে বলা হয়, হয়তো তাঁরা বেঁচে গিয়েছিলেন।
এক দশক পর নেদারল্যান্ডসের বিজ্ঞানীরা কম্পিউটার মডেল ব্যবহার করে আবিষ্কার করেন, যদি তাঁরা রাত ১১টা থেকে মধ্যরাত্রির মধ্যে পালান, তবে তাঁরা নিরাপদে গোল্ডেন গেট ব্রিজ এলাকায় পৌঁছাতে পেরেছিলেন। কারাগারের কর্মকর্তারা এফবিআইকে বলেন, তিনজন রাত সাড়ে ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে পালিয়েছিলেন।
মার্কিন এক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রোলফ হাট বলেছেন, ‘গবেষকেরা আবিষ্কার করেছেন জোয়ারের পরিবর্তনে তাঁদের ভেলার ধ্বংসাবশেষ অ্যাঞ্জেল আইল্যান্ডের দিকে ফিরে যেতে পারে। আমরা জানি না, তারা প্যাডলিংয়ে কতটা দক্ষ ছিলেন। তবে আমার মনে হয়, যদি কখনো অতিরিক্ত শক্তি থাকে, তা এই পরিস্থিতিতেই ব্যবহার করা উচিত।’
এফবিআই যখন ৪০ বছরের বেশি সময় আগে তদন্তটি মার্শালস সার্ভিসের কাছে হস্তান্তর করে, তখনো সূত্রগুলো উঠে আসছে। অ্যাংলিন পরিবার দাবি করেছে, তারা ১৯৭৫ সালে ব্রাজিলে ভাইদের একটি ছবি পেয়েছে, যা এক পরিবারিক বন্ধু পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু মার্শালস সার্ভিস বলেছে, এটি যাচাই করা সম্ভব নয়।
২০১৩ সালে এফবিআই একটি চিঠি পেয়েছিল, যা জন অ্যাংলিনের পক্ষ থেকে বলে দাবি করা হয়েছিল। চিঠিটির লেখক বলেছেন, যদি তাঁকে প্রকাশ্যে ক্যানসার চিকিৎসা এবং এক বছরের কারাদণ্ডের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, তবে তিনি আত্মসমর্পণ করতে ইচ্ছুক।
যাঁরা বিশ্বাস করেন বন্দীরা তাঁদের পালানোর পর বেঁচে ছিলেন, এমন আত্মীয়রাও স্বীকার করেন, বর্তমানে প্রায় ৯০ বছর বয়স হয়ে যাওয়া ওই তিনজন সম্ভবত আর বেঁচে নেই।
রোডেরিক বলেন, তাঁরা হয় বেতে মারা গেছেন, না হলে এত দিনে কোথাও তাঁদের মৃত্যু হয়েছে।
অতীত প্রশ্ন তোলে কারাগারের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে
অ্যাটর্নি জেনারেল রবার্ট এফ কেনেডি দাবি করেছিলেন, আলকাট্রাজ তার কার্যকারিতা হারিয়েছে। তিনি এটি বন্ধ করে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেন। পরের বছর আলকাট্রাজ স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যায় এবং ১৯৭২ সালে ন্যাশনাল পার্ক সার্ভিস এটি একটি জাদুঘরে রূপান্তরিত করতে শুরু করে। তার পর থেকে সাবেক কারাগারটি প্রতিবছর এক মিলিয়নের বেশি দর্শনার্থী টেনেছে, যা গোল্ডেন গেট ন্যাশনাল পার্ক কনসারভেন্সির মতে, অন্যতম জনপ্রিয় ন্যাশনাল পার্ক সাইট।
কিন্তু ট্রাম্প একে ভিন্নভাবে দেখেন। তিনি বলেন, দেশের আইনশৃঙ্খলা ঠিক রাখতে আলকাট্রাজ চালু করা প্রয়োজন।
উইডনার আলকাট্রাজ বহুবার পরিদর্শন করেছেন। তিনি বলেন, রাজনৈতিক বিতর্ক থেকে দূরে থাকেন তিনি। তবে আবার আলকাট্রাজ চালুর ধারণাটির সমর্থক নন তিনি। উইডনার বলেন, ‘এটি খারাপ ধারণা বলে আমি মনে করি। আপনি সেখানে অনেক ইতিহাস হারাতে যাচ্ছেন।’
সিএনএন অবলম্বনে মো. মিন্টু হোসেন