অভিশংসিত হতে পারেন দুই কারণে

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প

প্রতিনিধি পরিষদে অভিশংসন ইস্যুতে অভিযোগ গঠন ও ভোটে ডোনাল্ড ট্রাম্প বিপদে পড়তে যাচ্ছেন—এটা একরকম নিশ্চিত। এটি সম্ভবত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে অস্থির করে তুলেছে। এমন উত্তেজনাকর মুহূর্ত দীর্ঘ হোক, তা তিনি চান না। পুরো ঘটনাটির নিয়ন্ত্রণ নিতে তিনি চান, প্রতিনিধি পরিষদের চৌকাঠ ডিঙিয়ে তা সিনেটের আওতায় আসুক, যেখানে তিনি ও তাঁর দল শক্তিশালী। আর এ কথাটি তিনি সরাসরি বলে দিয়েছেন এক টুইটে।

৫ ডিসেম্বর দেওয়া ওই টুইটে ট্রাম্প লেখেন, ‘প্রতিনিধি পরিষদে গতকাল নিষ্ক্রিয় ডেমোক্র্যাটদের এক ঐতিহাসিক বাজে দিন গেছে। তাদের হাতে কোনো অভিশংসনের অভিযোগ নেই। তারা আমাদের দেশকে অর্থহীন করে তুলছে। কিন্তু তাতে তাদের কিছুই আসে যায় না। তারা উন্মাদ হয়ে গেছে। এ কারণে আমি বলি, যদি আমাকে অভিশংসন করতে চাও, তো দ্রুত কর, যাতে আমরা সিনেটে একটি ন্যায্য শুনানি পেতে পারি, আর আমাদের দেশ ফিরে যেতে পারে কাজের ধারায়। সেখানে আমরা (অ্যাডাম শিফ), (জো) বাইডেন, পেলোসিসহ আরও অনেকের সাক্ষ্য পাব এবং প্রথমবারের মতো আমরা উন্মোচন করব, এই পুরো ব্যবস্থা কতটা দুর্নীতিগ্রস্ত। এই জঞ্জাল পরিষ্কারের জন্যই আমাকে নির্বাচিত করা হয়েছিল, আর আমি তা-ই করছি।’
নিশ্চিতভাবেই ডোনাল্ড ট্রাম্প উদ্বিগ্ন। তবে তিনি তাঁর উদ্বেগটি বরাবরের মতোই প্রতিপক্ষকে আক্রমণের মধ্য দিয়ে আড়াল করার চেষ্টা করছেন। একই সঙ্গে তিনি বেশ সচেতনও। নিজের পিঠ বাঁচাতে তিনি সিনেটেরই শরণ নিয়েছেন।
এদিকে ৫ ডিসেম্বর প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি কংগ্রেসের প্রতি অভিশংসন ইস্যুতে সামনে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি সরাসরি বলেছেন, ‘আজ আমি আমাদের (তদন্ত কমিটির) চেয়ারম্যানকে অভিশংসনের পথে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।’
৪ ডিসেম্বর হাউস জুডিশিয়ারি কমিটি অভিশংসন তদন্তের ওপর শুনানি নিয়েছে। ওই শুনানি নিয়ে প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা কেলিয়্যান কনওয়ে ৫ ডিসেম্বর ফক্স নিউজকে বলেন, ‘ওই সাক্ষীরা ছিলেন পক্ষপাতদুষ্ট অধ্যাপকের দল, যাদের কাছে কোনো সত্য নেই।’ একই সঙ্গে তিনি জানিয়েছেন, সিনেটে বিচার শুরুর জন্য হোয়াইট হাউস পুরোপুরি প্রস্তুত। সিনেটে সত্যিকারের তথ্য রয়েছে এমন ব্যক্তিদেরই সাক্ষ্য গ্রহণ করা হবে।
এই বক্তব্যেই কিছু শঙ্কা তৈরি হচ্ছে। কারণ, সত্যিকারের সাক্ষ্য বলতে হোয়াইট হাউস আদতে কী বিবেচনা করবে, তা ঠিক স্পষ্ট নয়। তবে ডোনাল্ড ট্রাম্প যা বলেছেন, সে হিসেবে পেলোসি, বাইডেনসহ প্রতিনিধি পরিষদে সাক্ষ্য দেওয়া ব্যক্তিদেরই সিনেটে হাজির থাকার কথা। নিয়ম অনুযায়ী অভিযোগের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদেরই সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। তবে সিনেট চাইলে এর বাইরে বিভিন্ন ব্যক্তির সাক্ষ্যও গ্রহণ করতে পারে।
কনওয়ে তাঁর বক্তব্য এটা স্পষ্ট করেছেন, জো বাইডেন ও তাঁর ছেলে, হাউস ইনটেলিজেন্স কমিটির চেয়ারম্যান অ্যাডাম শিফসহ ইউক্রেনের কোম্পানি বুরিসমার পরিচালনা পরিষদের কয়েকজন ব্যক্তিকে ডাকা হতে পারে সিনেট শুনানিতে।
কনওয়ের দেওয়া শেষের তথ্যটি বেশ আগ্রহোদ্দীপক। কারণ, প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে যে ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে, তার সঙ্গে এই বুরিসমা কোম্পানি সরাসরি জড়িত। এই কোম্পানিতেই বাইডেন পরিবারের বিনিয়োগ রয়েছে। আর এর সূত্র ধরেই ডোনাল্ড ট্রাম্প ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে বাইডেনদের বিষয়ে তদন্তের চাপ দিয়েছিলেন। ওই কোম্পানির পরিচালনা পরিষদে থাকা ব্যক্তিদের সিনেট শুনানিতে ডাকার উদ্দেশ্য সম্ভবত এই, ইউক্রেন সরকারকে দিয়ে যে তদন্ত পরিচালনার চেষ্টা ট্রাম্প করেছিলেন, তা তিনি হয়তো এখন সিনেট দিয়েই করিয়ে নেবেন।
এদিকে ন্যান্সি পেলোসির আহ্বানের পরই হাউস জুডিশিয়ারি কমিটির সদস্য স্টিভ কোহেন জানিয়েছেন, অভিশংসন প্রতিবেদন তৈরিতে ডেমোক্র্যাটরা দলবদ্ধ হয়ে কাজ করবেন। তাঁর মতে, প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে দুটি বিষয়ে অভিযোগ আনা হতে পারে। এর একটি ক্ষমতার অপব্যবহার এবং অন্যটি কংগ্রেসের কাজে বাধা। এ ছাড়া বিচারে বাধা সৃষ্টির প্রসঙ্গটিও আসতে পারে। তিনি বলেন, ‘ডেমোক্রেটিক ককাস, জুডিশিয়ারি কমিটি—আমরা সবাই এক হয়ে কাজ করিছ। স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি ও তাঁর দল কী নিয়ে হাজির হন, তার জন্য আমরা অপেক্ষা করব। আমরা সমর্থন দিতে প্রস্তুত।’
কোহেন যদিও ডেমোক্র্যাটদের দলবদ্ধ কাজের ওপর আস্থা রাখছেন, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে দ্বিদলীয় উদ্যোগ ছাড়া অভিশংসন করাটা প্রায় অসম্ভব, যার প্রয়োজনীয়তার কথা বারবার বলছেন হাউস জুডিশিয়ারি কমিটির চেয়ারম্যান জেরি ন্যাডলার। আবার চূড়ান্ত প্রতিবেদনটিতে আসলে সব ডেমোক্র্যাটকে যুক্ত করারও তেমন সুযোগ নেই। এটি শেষ পর্যন্ত জেরি ন্যাডলার ও অ্যাডাম শিফের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ন্যান্সি পেলোসিই চূড়ান্ত করবেন।
চূড়ান্ত প্রতিবেদনে ডেমোক্র্যাটরা চাইবে রবার্ট ম্যুলারের প্রতিবেদনকে সংযুক্ত করে দিতে। ডেমোক্রেটিক দলের একটি সূত্রের কথা উল্লেখ করে তথ্যটি জানিয়েছে সিএনএন। ওই সূত্র অবশ্য জানিয়েছে, চূড়ান্ত প্রতিবেদনে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে তিনটি অভিযোগ আনা হতে পারে। এগুলো হচ্ছে ক্ষমতা অপব্যবহার, কংগ্রেসের কাজে বাধা ও বিচারকাজে বাধা, যেখানে ম্যুলারের প্রতিবেদনে থাকা প্রমাণাদির উল্লেখ থাকবে। যদিও আরেকটি সূত্র জানাচ্ছে, রবার্ট ম্যুলারের তদন্ত প্রতিবেদনের উল্লেখ করা, না করা নিয়ে ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে। তবে হাউস জুডিশিয়ারি কমিটির চেয়ারম্যানের মত ম্যুলারের প্রতিবেদনটিকে অভিশংসন প্রতিবেদনের সঙ্গে সংযুক্ত করার প্রতি।
এ পুরো প্রক্রিয়া শেষ হতে এখনো কয়েক সপ্তাহ লাগবে। আগামী সপ্তাহেই হাউস জুডিশিয়ারি কমিটিতে চূড়ান্ত প্রতিবেদনের ওপর ভোট হবে। সেখানে তা পাস হলে প্রতিবেদনটি পাঠানো হবে প্রতিনিধি পরিষদে ভোটের জন্য। ১৬ ডিসেম্বরের আগে এ ভোট হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এ ছাড়া হাউস জুডিশিয়ারি কমিটিতে হাউস ইনটেলিজেন্স কমিটির অ্যাটর্নিরা তাঁদের বক্তব্য উপস্থাপনের সময় আরেকটি শুনানি অনুষ্ঠিত হতে পারে। প্রতিনিধি পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে বিচার প্রক্রিয়াটি চলে যাবে সিনেটের আওতায়। কনওয়ের বক্তব্যে এটা স্পষ্ট, সিনেট মোটামুটি প্রস্তুত হয়েই আছে। কিন্তু তাদের কাছে এখনো পুরো তদন্ত ও এর প্রতিবেদন নিয়ে তেমন কোনো তথ্য নেই।
তথ্যের ঘাটতি থাকলেও সিনেট বসে নেই। রিপাবলিকান নেতাদের একটি অংশ ৫ ডিসেম্বর রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেছেন। হোয়াইট হাউস ৫৩ জন রিপাবলিকান সিনেটরের সঙ্গে নিয়মিত সংযোগ রাখছে এবং একটি শক্তিশালী দল গঠনের চেষ্টা করছে। বিভিন্ন সিনেটরের সঙ্গে আলাপ করে সিএনএন জানিয়েছে, প্রত্যেক সিনেটর নিজের মতো করে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তবে তাঁদের কেউই অভিশংসন প্রতিবেদন ও সিনেটে এর উপস্থাপনের পর কী হবে, তা নিয়ে নিশ্চিত নন। ঠিক কী ঘটতে যাচ্ছে, বলতে গেলে তা কেউই জানেন না। তবে ট্রাম্প যে লড়াইটি নিজের দুর্গ সিনেটেই লড়তে চান, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অন্তত প্রতিনিধি পরিষদের শুনানিতে হোয়াইট হাউসের অসহযোগিতা ও ৫ ডিসেম্বর দেওয়া তাঁর টুইটের পর এ নিয়ে আর কোনো সংশয় থাকার কথা নয়।