আমার সকল দুঃখের প্রদীপ

আজকাল সৃষ্টিকর্তা যেন আমার মনের কথা বুঝতে পারেন। এই যেমন শুক্রবার জুমার নামাজের আগে মনে হলো যদি লাগোর্ডিয়া এয়ারপোর্টে একটা ট্রিপ পেতাম! আমি তখন কোনি আইল্যান্ডের শেষ মাথায়। হঠাৎ বড় লাগেজ ও একটা হ্যান্ডব্যাগ নিয়ে এক সুবেশী নারী উঠে বসল। তার গন্তব্য লাগোর্ডিয়া এয়ারপোর্ট। জ্যাকসন হাইটস থেকে লাগোর্ডিয়ার দূরত্ব দশ মিনিটের। ওখানে মসজিদে গিয়ে জুমার নামাজ পড়লাম।

আজ কী হলো সেটা বলি। ম্যানহাটনের সেন্ট্রাল পার্ক এলাকা থেকে কানেকটিকাটের ট্রিপ পাওয়া যেকোনো উবার চালকের জন্য সৌভাগ্যের ব্যাপার। তবে এই আনন্দ উৎসবে পরিণত হয়, যখন সেই প্যাসেঞ্জার গাড়িতে উঠে বলে বসে, ফিরতি ট্রিপে সে আবার ম্যানহাটনে আসতে চায়। তার মানে খালি গাড়ি নিয়ে আসার কোনো আশঙ্কা নেই।

এক মাঝবয়সী ভদ্রলোক আর একটি তেরো-চৌদ্দ বছর বয়সী ছেলে গাড়িতে উঠল। লাগেজ ও ছেলেকে ব্যাক সিটে বসিয়ে লোকটি ফ্রন্ট সিটে আমার পাশে বসল। ভদ্রলোক ভারতীয়। গায়ের রং ও চেহারা দেখে মনে হয় দক্ষিণ ভারতের হবে। ‘হাই’, বলে সে জানাল, ‘আমার নাম অংশুমান। পেশায় ডাক্তার।’ আমিও উত্তরে ‘হাই’ বললাম।

রাতের কালো অন্ধকার চিরে ছুটে চলেছে আমার কালো গাড়ি। দীর্ঘ যাত্রার একঘেয়েমি দূর করতে আমরা আলাপে মেতে উঠলাম। আমার অনুমান সঠিক। ভদ্রলোকের বাড়ি কর্ণাটকের বেঙ্গালুরুতে। হাইস্কুলে পড়ার সময় পরিবারের সঙ্গে এই দেশে চলে আসে সে। এই দেশে আছে প্রায় চল্লিশ বছর। এখানে ডাক্তারি স্কুলে পড়েছে অংশুমান। এখন একটা নামকরা হাসপাতালের ‘চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট’ বিভাগে কাজ করছে। আমরা দুজনে ইংরেজিতে কথা বলছিলাম। অংশুমানের ইংরেজি উচ্চারণ চমৎকার। এই দেশে বহু বছর ধরে আছে বলেই হয়তো হিংলিশ উচ্চারণে কথা বলে না।

‘তুমি কি শুধু উবার চালাও মনজুরুল? নাকি আরও কোনো কাজ কর?’—অংশুমান খুব আন্তরিকতার সঙ্গে জানতে চাইল। আমিও ওর সুন্দর আচরণে মুগ্ধ হয়ে বলতে লাগলাম ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা। ট্রাফিক পুলিশে যোগ দেওয়ার চেষ্টা করছি বলে জানালাম। গ্রিনকার্ডের ‘অ্যাপ্রুভাল’ চিঠি এসেছে প্রায় সাত মাস হতে চলল। কিন্তু এখনো হাতে পাইনি। অংশুমান আর আমি এরপর অভিবাসীদের ক্ষেত্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের কঠোর নীতির সমালোচনায় মুখর হলাম। অংশুমানের জন্মভূমি ভারত ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কথাও এল। সে প্রচণ্ড বিজেপি ও মোদীবিরোধী, বুঝতে পারলাম।

আমি যে আসলে ভারতবিদ্বেষী নই, সেটা বোঝাতে অংশুমানকে বললাম, ‘আমি ভারতীয় সংস্কৃতির বৈচিত্র্যে মুগ্ধ। কলকাতা আমার খুব প্রিয় শহর। আর হিন্দি সিনেমার তো পোকা আমি। এমনকি সাউথ ইন্ডিয়ান সিনেমাও দেখা হয় প্রচুর।’

অংশুমান মৃদু হাসল আমার কথায়। ‘আমার আসলে হিন্দি সিনেমা দেখা হয় না। মাঝে মাঝে ছেলেকে নিয়ে থিয়েটারে গিয়ে হলিউডের মুভি দেখি। মা আর বাবা ছাড়া ভারতের কোনো কিছুর সঙ্গেই আমার এখন সংযোগ নেই।’ অংশুমানের কথায় হাসলাম। আর আমি তো ভেতো বাঙালি। লাঞ্চ আর ডিনারে ভাত ছাড়া চলে না। গান শুনলে রবীন্দ্রসংগীত। টিভি দেখলে বাংলাদেশের নিউজ। আর নিউইয়র্কের কমিউনিটিনির্ভর বাংলা পত্রিকাতে সীমাবদ্ধ আমার পড়াশোনা।

কথাগুলো বললাম অংশুমানকে। ভেবেছিলাম ও হয়তো তির্যক হাসি হাসবে। তার বদলে মুখ ছেয়ে এল বিষণ্নতায়। গভীর বিষাদের সুরে বলল, ‘তোমার তো তবু একটা শিকড় আছে। আমি তো কিছুই হতে পারলাম না। না ঘরকা, না ঘাটকা। মা-বাবা এখনো সঙ্গে আছেন। তাই অনেক প্রথা পালন করতে হয় ইচ্ছা না থাকলেও। আবার আমেরিকানদের মতো এত আধুনিকও হতে পারেনি।’

আমাদের দীর্ঘ কথাবার্তার মাঝখানে অংশুমানের কিশোর বয়সী ছেলে কোনো কথা বলল না দেখে একটু অবাক হলাম। সে পুরো রাস্তা আইপ্যাড দেখায় ব্যস্ত। মুখে বললাম, ‘তোমার ছেলের নাম কী? খুব শান্ত স্বভাবের মনে হচ্ছে!’

একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অংশুমান বলে উঠল, ‘ওর নাম আয়ুষ্মান। বয়স এখন ১৪ বছর। ও অটিস্টিক। কথা সেভাবে বলতে পারে না। তবে সবকিছু বোঝে।’

আইপ্যাডের আলোতে অয়ুষ্মানের মুখ দেখা যাচ্ছে। আমি ফিরে খুঁটিয়ে দেখলাম। দেখে অস্বাভাবিক কিছু মনে হলো না। ‘ওকে দেখলে তো স্বাভাবিকই মনে হয়!’
আমাকে লজ্জা দিয়ে অংশুমান বলে উঠল, ‘বেশির ভাগ অটিস্টিক শিশুদের চেহারা খুব স্বাভাবিক।’

কানেকটিকাটের ওয়াটারবারি শহরে ঢুকলাম। আর বিশ মিনিট পরই অংশুমানের গন্তব্য। হঠাৎ ওর ছেলেটা আইপ্যাড বন্ধ করে বাইরের দিকে তাকিয়ে কাঁদতে শুরু করল। অংশুমান পেছনে ফিরে বলতে লাগল, ‘কাঁদছ কেন বাবা? আমি তো আবার পরের উইকেন্ডে আসব। তুমি আমার সঙ্গে দু দিন থাকবে। তোমাকে অনেক ভালোবাসি বাবা। কাঁদে না প্লিজ।’

বাবার কথায় ছেলের কোনো পরিবর্তন হলো না। সে কেঁদেই চলল। আমি কিছু বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আমার বিস্মিত মুখের দিকে তাকিয়ে অংশুমান বলল, ‘ওর মায়ের সঙ্গে আমার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে বছরখানেক হলো। আমরা দুজনেই ছেলের অভিভাবকত্ব দাবি করেছিলাম আদালতে। আদালত ওর মায়ের পক্ষে রায় দিয়েছে। উইকেন্ডে কেবল দু দিনের জন্য আমি নিয়ে রাখতে পারি। এখন ওকে ওর মায়ের কাছে পৌঁছে দিতে যাচ্ছি।’

যদিও বিষয়টা খুব ব্যক্তিগত। তবু মুখ ফসকে বলে ফেললাম, ‘ওর মা তোমাকে ছেড়ে গেলে কেন?’

অংশুমানকে অবশ্য বিব্রত মনে হলো না। ও বলল, ‘আমার স্ত্রী শ্বেতাঙ্গ। ব্রুকলিনে জন্ম ওর। আমাদের প্রাচ্যের মানসিকতা ওরা বহন করে না। একজনকে বিয়ে করলে সারা জীবন তার সঙ্গে থাকতে হবে এমনটায় বিশ্বাসী নয়। আমাকে ছেড়ে যাওয়ার কারণ একটাই-একঘেয়েমি। ওর আমার সঙ্গে আর থাকতে ইচ্ছা করছিল না। আমি অবশ্য এ জন্য ওকে দোষ দেব না। কারণ সে সত্যি কথা বলেছে। আমাকে গোপন করে অন্য কোনো সম্পর্কে জড়ায়নি।’

‘এখন তাহলে তোমার সাবেক স্ত্রীর বাড়িতে যাচ্ছ তোমরা?’ আমি জানতে চাইলাম।

‘হ্যাঁ, নতুন স্বামীর সঙ্গে সে এখানেই থাকে।’ অংশুমান উত্তর দিল। কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকে সে। ‘আমার মা-বাবা পুরো সপ্তাহ অপেক্ষা করে থাকে কবে শুক্রবার আসবে সে জন্য। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান আমি। আয়ুষ্মান আমার বাবা আর মায়ের জীবনের একমাত্র আনন্দ।’ বুক কাঁপানো দীর্ঘশ্বাস ফেলে কথাটা বলে অংশুমান।

গাড়ি নির্ধারিত ঠিকানায় পৌঁছানোর পর অংশুমান নেমে এসে ছেলেকে গাড়ি থেকে বের করে। ক্রন্দনরত ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খায়। গাড়ির আওয়াজে তখন এক শ্বেতাঙ্গ ভদ্রলোক বেরিয়ে এসেছে। অংশুমানের ছেলেটাকে আড়াল করে সে এসে এমনভাবে দাঁড়াল, যাতে ও বাবার কাছে যেতে না পারে। ছেলেটা তখন চিৎকার করে কাঁদছিল বাবার জন্য।

অংশুমান যাওয়ার পথে ফ্রন্ট সিটে না বসে পেছনে গিয়ে বসল। আর কোনো কথা হলো না আমাদের। শব্দ না করলেও বুঝতে পারলাম, পেছনে সিটে বসে নীরবে কেঁদে চলেছে ও। অংশুমান হয়তো বুঝবে না। তবু গাড়ির সিডিতে প্রিয় একটা গান দিলাম।

‘আমার সকল দুঃখের প্রদীপ জ্বেলে দিবস গেলে করব নিবেদন আমার ব্যথার পূজা হয়নি সমাপন।’