আমি এক নিখোঁজ বাংলাদেশি

দুটো লাগেজ ছিল আমার সঙ্গে। একটা হ্যান্ড লাগেজ। আর একটা বুকের খাঁচায় নিয়ে আসা। বেশ থরে থরে সাজানো। সুন্দর করে গুছিয়ে যতটা পারি ঠেসে ঠেসে ভরেছি। আমার সব শখের জিনিস। ভালোবাসার জিনিস। যতটা পারি। আমার প্রিয় খড়ের চারচালা ঘর। ঘরের পাশে বিরাট বট গাছটা। গাছটাতে যত রকমের পাখির বাসা, সব। ভোরের বেলা ওদের কিচিরমিচির শব্দে আমার ঘুম ভেঙে যেত। প্রিয় আমার ওরা। অতি প্রিয়। আপন। আমার পোষা কুকুরটা। রাস্তার সঙ্গী আমার; আর মিনি বিড়াল। খাওয়ার সময়ের সঙ্গী। বড় মোরগটা। যে ডাকত ভোরেরও আগে। বাড়ির পাশের বড় ডোবাটা। গরমকালে আমরা হাঁটুজলে কাদায় হাতড়ে মাছ ধরতাম। আর তাল গাছটা, বাবুই পাখির বাসা যেটাতে। আমার গাভী, যে সারা বছর প্রায় দুধ দিত। আর আয়েশা। আমরা একসঙ্গে পড়তাম। হাই স্কুলে। কলেজেও। ওর গালে টোল পড়ত যখন হাসত। আমি তাকিয়ে থাকতাম অপলক দৃষ্টিতে। কথা ছিল জলদি ফিরে আসব। বলেছিল দেরি করো না। মুছেছিল চোখ। আমারও চোখ ভেজা ভেজা হলো।
বুকের লাগেজটা এত ভার যে চলতে ফিরতে কষ্টই হচ্ছিল। তারপরও আনন্দ যে মোটামুটি সব নিতে পেরেছি। সোজা উড়াল দিলাম নিউইয়র্কে। JFK বিমান বন্দরে। কেমন যেন ঘোর ঘোর লাগছিল। কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। সবকিছুই বাধা বাধা ঠেকছিল। শুধুই অবাক হচ্ছিলাম।
কদিন পরেই কাজ শুরু করতে হলো একটা দোকানে। ভারী ভারী জিনিস গাড়ি থেকে নামানো। আবার ঠিকমতো গুছিয়ে রাখা। মালিক ইগল পাখির মতো চোখ নিয়ে তাকিয়ে থাকে। ভুল হলেই হিন্দিতে অফুরন্ত গালি। দেশ নিয়ে। আরও অনেক কিছু। মনে হতো, কেনা দাস আমি। কটা টাকার বিনিময়ে মুখ বুজে আর চোখের পানিতে সব সহ্য করেছি। একজন বলল কিছু লেখা পড়া তো জান। কলেজে ভর্তি হও। সহজ ইংরেজি দিয়ে শুরু কর। কমিউনিটি কলেজে ভর্তি হলাম।
প্রথম প্রথম কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। টিচার বা স্টুডেন্টদের কথা। ওদের বাচনভঙ্গি। হাঁ করে তাকিয়ে থাকতাম। ছোট মনে হতো বড্ড।
ছেড়ে দিই মনে হলো। আস্তে আস্তে সয়ে গেল। কিছুদিন পর একটু বুঝতে পারলাম।
একদিন এক তরুণী আমার দেশ কোথায় জিজ্ঞেস করল। বললাম, বাংলাদেশ। What is Bangladesh? Where is it? Africa? যত বলি বাংলাদেশ ততবার বলে in Africa? নাম জানতে চাইল। বললাম জাকারিয়া। what is Jaka? So hard. Jack is fine. How nice it is!
আমাকে জ‍্যাক বলে ডাকত। কিছু বলতাম না।
নিজের থেকেই বলল ওর নাম মারিয়া। সবাই মেরি বলে ডাকে। তড়িৎ গতিতে হাঁটে। যেন হরিণ শাবক। সোনালি রং চুলের। কিন্তু গোছানো। মিষ্টি হাসি সব সময়। কারণে অকারণে আমার সঙ্গে কথা বলে। কত কথা আমাকে জিজ্ঞেস করে। খুব আপন করে। আমার বাড়ির কথা, দেশের কথা। কেমন দেশ। এই সব।
আমার দেশে এইটা আছে কিনা, ওটা আছে কিনা, এই সব।
এখন আমার ইংরেজি অনেক ভালো। উচ্চারণও ওদের মতো। ওকে আমি Algebra শেখাই। আমি smart, ও বলে। আমাকে ও থিয়েটার দেখাতে নিয়ে যায়। এক সঙ্গে ভালো হোটেলে খাওয়ায়।
এখন মেরিকে অচেনা মনে হয় না একদম। মনে হয় যুগ যুগ ধরে চিনি। বাংলাদেশের অনেক কিছুই আমার কাছে ফিকে হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে এখানকার সবকিছুই সুন্দর। মারিয়া কত সুন্দর! আন্তরিক। গোছানো। টিপ টপ অনেক দিন ধরে বুকটা হালকা হালকা লাগছে।
আগের সেই ভার একদম অনুভব করছি না। একদিন নিরিবিলি বুকের সেই লাগেজটা নামালাম। একি! কিছুই তো নেই। সব যেন চুরি হয়ে গেছে। উধাও। সবকিছু। সবকিছু। আয়েশার মুখটাও। আমার চোখ দুটো ভিজে ভিজে গেল।