৪ জুলাই আমেরিকানরা স্বাধীনতা দিবস পালন করবে। ২৪১ বছর আগের এই দিনে এক রক্তক্ষয়ী বিপ্লবের মাধ্যমে ১৩টি ব্রিটিশ কলোনি অথবা উপনিবেশ ব্রিটিশ রাজা জর্জ-৩-এর কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। সেই ১৩টি উপনিবেশ ছিল নিউ হ্যামশায়ার, ম্যাসাচুসেটস, কানেকটিকাট, রোড আইল্যান্ড, নিউইয়র্ক, নিউ জার্সি, পেনসিলভানিয়া, ডেলেয়ার, ম্যারিল্যান্ড, ভার্জিনিয়া, নর্থ ক্যারোলাইনা, সাউথ ক্যারোলাইনা ও জর্জিয়া। ১৭৭৬ সালের ৪ জুলাই স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র স্বাক্ষরের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র অথবা ইউনাইটেড স্টেট অব আমেরিকা গঠিত হয়, যদিও তখনো গৃহযদ্ধ চলছিল এবং তা আরও বেশ কিছুদিন স্থায়ী হয়েছিল। জর্জ ওয়াশিংটন তখন আমেরিকান বাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। এই সময় ফ্রান্স ও স্পেন অস্ত্র ও অন্যান্য সামগ্রী দিয়ে আমেরিকাকে সাহায্য করেছিল। পরে থমাস জেফারসনের প্রচেষ্টায় যুদ্ধের অবসান হয়। ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয় দাশ প্রথা। আমেরিকায় প্রবর্তিত হয় গণতন্ত্র।
আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রামের অনেক পুরোনো মিত্র হলো ফ্রান্স। আমেরিকার আকাশে আজকের যে স্ট্যাচু অব লিবার্টি উঁচু করে মশাল ধরে আছে তার পরিকল্পনা, নকশা, অর্থ সংগ্রহ—সবই হয়েছে ফ্রান্সে। আমেরিকার গৃহযুদ্ধে ও বিপ্লবে (১৭৭৫-১৭৮৩) সে দেশের জনগণের বীরোচিত ভূমিকা, দাশ প্রথার অবসান এবং একটি নতুন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্মের পর বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে ফ্রান্সের নাগরিকেরা উপহার দিয়েছে এই ভাস্কর্যটি।
স্ট্যাচু অব লিবার্টি স্বাধীনতার প্রতীক। এই ভাস্কর্য শুধু আমেরিকার জাতীয় প্রতীকই নয় বরং সারা বিশ্বের কাছে মুক্তি বা স্বাধীনতার প্রতীক। নিউইয়র্কের লোয়ার ম্যানহাটনসংলগ্ন আপার নিউইয়র্ক বের দুটি ক্ষুদ্র দ্বীপ লিবার্টি আইল্যান্ড ও এলিস আইল্যান্ড। এই দুইটি দ্বীপের সঙ্গে আমেরিকার অভিবাসী মানুষের আগমনের ইতিহাস ওতপ্রোতভাবে জড়িত। স্ট্যাচু অব লিবার্টির অবস্থান লিবার্টি আইল্যান্ডে আর এলিস আইল্যান্ড হলো লাখ লাখ অভিবাসীর প্রবেশদ্বার। ১৮৯২ থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত প্রায় ১৬ লাখ অভিবাসী মানুষের এলিস আইল্যান্ড দিয়ে নৌপথে আমেরিকায় ঢুকেছে, নতুন দেশে ভাগ্য গড়তে আসা অভিবাসীরা দূর থেকে এই স্ট্যাচু অব লিবার্টিকে দেখে পুলকিত হয়েছে। সবার মনে হয়েছে, এই ভাস্কর্য যেন তাদের স্বাগত জানাচ্ছে।
এই ভাস্কর্যটির পোশাকি নাম হলো লিবার্টি এনলাইটিনিং দ্য ওয়ার্ল্ড। একজন মহিলার আদলে আঁকা ভাস্কর্যটিতে দেখানো হয়েছে যে সে নিজেকে অপশাসন থেকে মুক্ত করছে, তার পায়ের কাছে পড়ে আছে বন্ধন মুক্তির শিকল। এর ডান হাতে উঁচু করে ধরা আছে জ্বলন্ত মশাল, স্বাধীনতার প্রতীক। বাম হাতে বুকের কাছে ধরা আছে একটি ফলক, যাতে রোমান সংখ্যায় খোদাই করে লেখা আছে ‘জুলাই ৪, ১৭৭৬’, যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা ঘোষণার দিন। এর পরনে আছে ঢিলে সবুজাভ রঙের বাতাসে উড়ন্ত একটি গাউন। মাথায় পরিধান করা আছে সাতটি সূচিমুখী শক্ত কিলকবিশিষ্ট একটি মুকুট, যা কি না সাতটি মহাদেশ ও সাতটি মহাসমুদ্রের প্রতীক।
এই ভাস্কর্যটির উচ্চতা ৪৬ মিটার বা ১৫১ ফুট, যে বেদি বা স্তম্ভের ওপর ভাস্কর্যটি দাঁড়ানো তাসহ এর উচ্চতা হলো ৯৩ মিটার বা ৩০৫ ফুট। ভাস্কর্যটি ২ দশমিক ৪ মিলিমিটার বা দশমিক ০১ ইঞ্চি পুরু পেটানো তামার পাতে তৈরি এবং একটি লোহার ফ্রেমে দাঁড় করানো। লোহর ফ্রেমটি তৈরি করেছেন বিখ্যাত প্রকৌশলী গুস্টেফ ইফেল, যিনি ফ্রান্সের বিখ্যাত ইফেল টাওয়ারটিও তৈরি করেছেন।
এই ভাস্কর্যটির ডিজাইন করেছেন ফরাসি স্থপতি ফের্ডরিক বারথলডি। ভাস্কর্যটি নির্মাণের আগে নব্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশটি সম্পর্কে ধারণা নিতে শিল্পী সরেজমিনে আমেরিকা ভ্রমণ করেন। সেপ্টেম্বর ২৮, ১৮৭৫ সালে ‘ফ্রাঙ্কো-আমেরিকান ইউনিয়ন’ নামের একটি সংগঠন, যেটি দুই দেশের বন্ধুত্বের জন্য কাজ করছিল ভাস্কর্যটি নির্মাণের জন্য তারা এগিয়ে আসে এবং একটি তহবিল সংগ্রহের অভিযান শুরু করে। ফ্রান্সের পত্রিকায় জনগণের কাছে অর্থ দানের আবেদন করা হয়। ১৮৭৫ সালের ৬ নভেম্বর একটি ফান্ড রাইজিং ডিনারে ভাস্কর্যটির নির্মাণব্যয় আনুমানিক ৪ লাখ ফ্রাঁর মধ্যে প্রায় ১০ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ৪০ হাজার ফ্রাঁ সংগ্রহ করা হয়। ভাস্কর্যটির নির্মাণকাজ শেষ হয় ১৮৮৪ সালের জুলাই মাসে। ভাস্কর্যটি যে বেদিটির ওপর দাঁড়িয়ে আছে তা তৈরি করতে অর্থ জুগিয়েছে আমেরিকার জনগণ। আমেরিকার বিখ্যাত পত্রিকা প্রকাশক জোসেফ পুলিৎজার এই অর্থ সংগ্রহে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। উল্লেখ্য, আমেরিকায় শিল্প, সাহিত্য, নাটক ও সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কারটির নাম ‘পুলিৎজার’, যার প্রবর্তকও এই একই ব্যক্তি।
ভাস্কর্যটির নির্মাণ করা হয় খণ্ডে খণ্ডে। প্রথমে নির্মাণ করা হয় এর ডান হাত, যেটি মশাল উঁচু করে ধরে আছে। কাজ শেষ হলে ভাস্কর্যটির প্রথম পূর্ণাঙ্গ প্রদর্শনী হয় প্যারিসে। এরপর এটিকে আবার খণ্ডে খণ্ডে ভাগ করে আমেরিকায় আনা হয়। ১৮৮৬ সালের ২৮ অক্টোবর আমেরিকার প্রেসিডেন্ট গ্রোভার ক্লিভল্যান্ড এটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। ধীরে ধীরে স্ট্যাচু অব লিবার্টির পরিচিতি আমেরিকাসহ ছাড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে। ১৯৮৪ সালে ইউনেসকো ভাস্কর্যটিকে বিশ্ব ঐতিহ্য বা ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ হিসেবে ঘোষণা করে। ১৯৮৬ সালে স্ট্যাচু অব লিবার্টির ১০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে এর ব্যাপক সংস্কার করা হয়। তখন এর হাতের মশালটি গ্লাস ও মেটালের পরিবর্তে সোনার পাত দিয়ে মুড়িয়ে দেওয়া হয়।
ম্যানহাটনের ডাউন টাউন থেকে ফেরি সার্ভিসে প্রতিদিন হাজার হাজার লোক এই ভাস্কর্য দেখতে আসে। ১৯২টি সিঁড়ি পেরিয়ে অথবা এলিভেটর দিয়ে বেদির ওপরে অবস্থিত অবজারভেশন টাওয়ারে যাওয়া যায়। বেদির ভেতর আছে একটি মিউজিয়াম। যেখানে আছে এই ভাস্কর্যের অনেক ঐতিহাসিক দলিল ও নিদর্শন। ৩৫৪টি সিঁড়ি (২২ তলার সমান) পেরিয়ে যাওয়া যায় ভাস্কর্যটির মুকুটের কাছে, যেখান থেকে নিউইয়র্ক হারবার ও নিউইয়র্ক সিটির অনন্য দৃশ্য দেখা যায়।
২০০১ সালে ১১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ারে হামলার পর নিরাপত্তার কারণে স্ট্যাচু অব লিবার্টির পরিদর্শন জনসাধারণের জন্য বন্ধ রাখা হয়। ভাস্কর্যটির নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার জন্য প্রায় ৭০ লাখ ডলার প্রয়োজন ছিল। এটা না পাওয়ায় বাধ্য হয়ে কর্তৃপক্ষ এটি বন্ধ রাখে। পরে কয়েকটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে এই অর্থ সংগৃহীত হয়। নিউইয়র্কের তখনকার মেয়র ব্লুমবার্গ (যিনি একজন কোটিপতি) এই তহবিলে এক লাখ ডলার দান করেন। তিন বছর বন্ধ থাকার পর তা আবার পরিদর্শনের জন্য খুলে দেওয়া হয়।
প্রতিবছর স্বাধীনতা দিবসের আগে স্ট্যাচু অব লিবার্টিকে নানাভাবে সজ্জিত করা হয়। যত দিন আমেরিকা থাকবে তত দিন এই ভাস্কর্য স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রর প্রতীক হয়ে থাকবে।
ই-মেইল: [email protected]