আমেরিকায় আশ্রয়ের আবেদন
সুন্দর ভবিষ্যতের আশা করেন এমন অনেকের কাছেই স্বপ্নের দেশ হলো আমেরিকা। কিন্তু চাইলেই কি কেউ এ দেশে আসতে পারে? তাই অনেকেই এ দেশে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করে থাকেন। আর এ রকমই একটি পদ্ধতি হলো অ্যাসাইলাম বা আশ্রয়ের জন্য আবেদন যার উদ্দেশ্য স্থায়ীভাবে আমেরিকায় বসবাসের সুযোগ করে নেওয়া। বাংলাদেশিদের মধ্যে এই পদ্ধতি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। তাই আজকের এ লেখায় কীভাবে আমেরিকায় আশ্রয়ের আবেদন করে স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ করে নেওয়া যায়—এ আবেদন প্রক্রিয়া নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার চেষ্টা করব।
অ্যাসাইলাম কি?
জাতিগত, ধর্ম অথবা রাজনৈতিক নিপীড়নের ভয়ে কোনো ব্যক্তি নিজের দেশে ফিরে যেতে অক্ষম অথবা অনিচ্ছুক হলে সে অন্য দেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে চাইলে তাকে যে আশ্রয় দেওয়া হয়, তা অ্যাসাইলাম নামে পরিচিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নৃশংসতার পর আন্তর্জাতিক আইনে অ্যাসাইলামের জন্য আবেদন করার অধিকার অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
কারা অ্যাসাইলাম বা আশ্রয়ের আবেদন করে?
অ্যাসাইলামের জন্য ওই সব ব্যক্তিরাই আবেদন করে যারা নিজের দেশ থেকে নিরাপত্তা ও নিপীড়নের ভয়ে অন্য দেশে পালিয়ে সেই দেশে আইনগত আশ্রয়ের জন্য আবেদন করে। অ্যাসাইলামের জন্য যেকোনো বয়সের, বর্ণের, লিঙ্গের, অর্থনৈতিক অবস্থার লোক আবেদন করতে পারে। তবে অধিকাংশই বিশ্বের ওই সব প্রান্ত থেকে আশ্রয়ের জন্য আবেদন করে যেখানে সংঘাত, দুর্যোগ ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার ঘাটতি রয়েছে।
আমেরিকায় অ্যাসাইলামের জন্য আবেদন করা কি আইনের অন্তর্ভুক্ত?
হ্যাঁ, যে কেউ আবেদন করতে পারবে। তবে অ্যাসাইলামের জন্য আবেদনকারীকে অবশ্যই আমেরিকায় অবস্থান করতে হবে অথবা এ দেশে প্রবেশের জন্য যেকোনো বন্দরে অবস্থান করতে হবে। আন্তর্জাতিক উদ্ধার কমিটির পরিচালক অলগা বার্ন বলেন, ‘আমেরিকায় আইনগতভাবে আশ্রয়ের জন্য আবেদন করার আগে ভিসা অথবা অন্য কিছুরই প্রয়োজন নেই। শুধু ব্যক্তিকে নিজে আমেরিকায় অবস্থান করতে হবে।’ তবে যারা ভ্রমণ অথবা অন্য কোনো ভিসায় এ দেশে প্রবেশ করেন তাদের আশ্রয়ের জন্য আবেদন প্রক্রিয়া শরণার্থীদের থেকে ব্যক্তিবিশেষে ভিন্ন।
কীভাবে আশ্রয়ের জন্য আবেদন করবেন?
আমেরিকায় আশ্রয়ের জন্য আবেদন করতে হলে আই-৫৮৯ নামে একটি ফরম পূরণ করতে হবে। ১২ পাতার এ ফরমে প্রয়োজনীয় তথ্য পূরণ করে দিতে হবে। কোনো নির্ভরযোগ্য এবং ভালো আইনজীবীর মাধ্যমে এই আবেদন করিয়ে নেওয়াই ভালো। আবেদন করতে কোনো ফি দিতে হবে না। আবেদন করার প্রায় ১৮০ দিনের মধ্যে ফলাফল জানানো হবে যে, আশ্রয়ের জন্য আবেদন গ্রহণ করা হয়েছে কি না।
আশ্রয়ের জন্য আবেদনকারী কি আইনগতভাবে কাজ করতে পারবে?
না। আমেরিকায় আশ্রয়ের জন্য আবেদন করার পর আশ্রয়ের অনুমতি পাওয়ার আগে পর্যন্ত কাজ করার কোনো অনুমতি নেই।
উদ্বাস্তু বা শরণার্থী হিসেবে আমেরিকায় আশ্রয়ের জন্য আবেদন করা ভালো নাকি ভ্রমণ অথবা অন্য কোনো ভিসায় ঢুকে পরে আশ্রয়ের জন্য আবেদন করা ভালো?
উদ্বাস্তু বা শরণার্থী বলতে বোঝায়, যারা নিজের দেশ থেকে পালিয়ে আমেরিকার কোনো সীমান্তে এসে এ দেশে প্রবেশের আশা করে। এ জন্য প্রথমে নিজেকে উদ্বাস্তু বা শরণার্থী হিসেবে প্রমাণ করতে হবে। শরণার্থী হিসেবে সীমান্তে আসার পর নিজেকে শরণার্থী প্রমাণ করার আগ পর্যন্ত তারা আমেরিকার ভেতর ঢুকতে পারবে না। পরবর্তীতে বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আশ্রয়ের জন্য আবেদন করতে হবে। উদ্বাস্তু বা শরণার্থী হিসেবে আশ্রয়ের আবেদন করার প্রক্রিয়া খুবই সময়সাপেক্ষ ও জটিল।
অন্যদিকে আমেরিকায় আশ্রয়ের জন্য আবেদন করার আরেকটি প্রক্রিয়া হচ্ছে ভ্রমণ অথবা অন্য কোনো ভিসায় এ দেশে প্রবেশ করে পরবর্তীতে আশ্রয়ের জন্য আবেদন করা। আমেরিকায় প্রবেশের এক বছরের মধ্যে আবেদন করতে হবে। শরণার্থী বা ভ্রমণকারী যার-ই আশ্রয়ের জন্য আবেদন অগ্রাহ্য করা হবে, তাকে আবার নিজ দেশে ফিরে যেতে হবে।
আশ্রয়ের জন্য আবেদন করার পর কি আমেরিকা থেকে অন্য দেশে ভ্রমণ করা যাবে?
না। আবেদন করার পর ফলাফলের আগে অন্য দেশে ভ্রমণ করলে আবেদন অগ্রাহ্য করা হবে। তবে অগ্রিম প্রতিশ্রুতি দিয়ে অনুমতি নিয়ে ভ্রমণ করা যাবে। এ প্রক্রিয়া ‘অ্যাডভান্স প্যারোল’ নামে পরিচিত।
আমেরিকায় কতজন আশ্রয়ের জন্য আইনগতভাবে অনুমতি পেয়েছেন?
আশ্রয়ের জন্য আমেরিকায় যারা অনুমতি পান, তাদের ‘অ্যাসাইলি’ বলা হয়। গত বছর ৩৫ হাজার ৫০২ জন ব্যক্তির আমেরিকায় আশ্রয়ের আবেদনের অনুমোদন দেওয়া হয়। আশ্রয়ের অনুমতি পাওয়ার পর তারা কোনো ধরনের ভয় ছাড়াই আমেরিকায় অবস্থান, কাজ ও স্বামী, স্ত্রী অথবা সন্তানের জন্য আবেদন করতে পারবেন।
এক গবেষণা থেকে জানা যায়, যারা অভিবাসন আদালতের আগেই কোনো আইনজীবীর মাধ্যমে আশ্রয়ের জন্য আবেদন করে থাকেন, তাদের আবেদন গ্রহণ করার সম্ভাব্যতা পাঁচগুণ বেড়ে যায়। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরের পর থেকে অভিবাসন আদালতের মাধ্যমে আশ্রয়ের জন্য আবেদন অগ্রাহ্য করার হার বেড়ে ৫৭ শতাংশ হয়েছে। তাই আইনজীবীর মাধ্যমেই আবেদন করিয়ে নেওয়াই ভালো।
কোথা থেকে আমেরিকায় আশ্রয়ের জন্য আবেদন বেশি করা হয়?
২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসের হিসাব পর্যন্ত ভেনেজুয়েলা থেকে সবচেয়ে বেশি ২৭ শতাংশ লোক আশ্রয়ের জন্য আবেদন করেছে। মোট ৩ হাজার ২৭৮ আবেদনপত্র জমা হয় ভেনেজুয়েলা থেকে। এর পরে রয়েছে চীন, গুয়াতেমালা, এলসালভাদোর, মেক্সিকো। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ থেকেও আবেদন করার হার বেড়ে চলেছে। বাংলাদেশি নাগরিকদের মধ্যে বেশির ভাগই ভ্রমণ অথবা অন্যান্য ভিসায় আমেরিকার আসার পর আশ্রয়ের জন্য আবেদন করছেন।
ট্রাম্প সরকারের অধীনে আশ্রয় আবেদনের প্রক্রিয়া কীভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে?
ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বাইরের দেশ থেকে আসা আশ্রয় প্রার্থীদের জন্য নতুন নতুন অভিবাসন আইন প্রণয়ন করছেন। যে কারণে আমেরিকায় আশ্রয় নেওয়া দিনদিন কঠিন হয়ে পড়ছে। চলতি বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি ট্রাম্প সরকার জরুরি অবস্থা জারি করে ঘোষণা দেয়, আশ্রয়ের জন্য শরণার্থী অত্যধিক হারে বাড়ার কারণে দক্ষিণ সীমান্তে দেয়াল তৈরি করা হবে। ট্রাম্প সরকার নতুন আইন প্রণয়ন করে, কেউ যদি নিরাপত্তার আশায় তৃতীয় কোনো দেশ হয়ে(মধ্য আমেরিকা এবং মেক্সিকোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত) আমেরিকায় প্রবেশ করে, তাহলে তার আশ্রয়ের আবেদন অগ্রাহ্য করা হবে।
এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক উদ্ধার কমিটির সহসভাপতি নাজনীন এশ বলেন, ট্রাম্প সরকারের এ রকম নীতি আশ্রয়ের আশায় থাকা অনেক মানুষের আমেরিকায় প্রবেশের পথ বন্ধ করে দেবে।
এ ছাড়া আমেরিকার অনেক সংস্থা এর মধ্যেই ট্রাম্প সরকারের এ রকম নীতির বিরুদ্ধে আবেদন করতে শুরু করছে। এ রকম হলে অনেক শরণার্থীকে আশ্রয়ের আবেদন করার আগেই সীমান্ত থেকে নিজ দেশে ফিরে যেতে হবে, যা তাদের জীবনের জন্য আরও অনেক ঝুঁকিপূর্ণ হবে।
এতসব ঝুঁকি, বাধা-বিপত্তি থাকার পরও সবার ইচ্ছা থাকে আমেরিকায় স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ করে নেওয়া। কেউবা বন্ধুর এই প্রক্রিয়ায় সফল হন, আবার কারও মেনে নিতে হয় নির্মম বাস্তবতা। আশা করি ট্রাম্প সরকারের নতুন নতুন কঠিন অভিবাসন নীতির পরও আশ্রয়প্রত্যাশীরা যাতে সফল হতে পারেন।