ইনজেকশন

মাঝে মাঝে হাত ঝিন ঝিন করার অনেক কারণ থাকতে পারে। ‘কিছুই না’ থেকে শুরু করে, ‘অচিরেই মৃত্যু’র আলামত পর্যন্ত হতে পারে। তাই আজ এক ‘হাত সার্জনের’ কাছে গেলাম। মানে হ্যান্ড সার্জন। হ্যাঁ, হাতেরও স্পেশাল সার্জন আছে। তিনি শুধু হাতের চিকিৎসা করবেন। প্রয়োজনে হাতের আঙুল বা আরও ওপরে কবজি পর্যন্ত কেটে অসুখ দূর করতে পারবেন। আমি যে ডাক্তারের কাছে সব সময় যাই, তিনিই এঁর কাছে যেতে বলেছিলেন। এত থাকতে ‘সার্জনের’ কাছে কেন পাঠালেন বুঝলাম না। সার্জনের নাম আবার ইমরান খান। গেলাম।
গিয়ে দেখি এ, বি, সি, ডি। সুদর্শন এক ভদ্রলোক। ব্যবহার ভালো। একটু আশ্বস্ত হলাম। এর আগে আরেক হ্যান্ড সার্জনের কাছেও গিয়েছিলাম। তিনি মূল কারণ নির্ণয় করতে পারেননি। ‘হতেও পারে, নাও হতে পারে’ এসব বলেছিলেন। তাঁর রিপোর্ট ডক্টর খানকে দেখালাম। তিনি হাসলেন। ‘রিপোর্ট তো খুবই কনফিউজিং। সে বেরই করতে পারেনি তোমার কি হয়েছে বা কেন হয়েছে। তাহলে চিকিৎসা দেবে কীভাবে?’
আমি একই সঙ্গে ভরসা এবং আশঙ্কায় নিপতিত হলাম। কারণ, তিনি নিশ্চয়ই বের করতে পারবেন আসলে কী হয়েছে। পারবেন বললে কম হবে, তিনি বের করেই ছাড়বেন। আর আশঙ্কার কারণ হলো, এক ডাক্তার আরেক ডাক্তারকে খাটো করে কথা বলে না। ডাক্তার রুটকে আমার খুব খারাপও লাগেনি। তিনিও বুঝিয়ে, যুক্তিসংগত ভাবে কথাবার্তা বলেছেন। ‘কম্পিউটারে দীর্ঘদিন কাজ করলে এমন হতে পারে। গুরুতর কিছু দেখছি না। এর কারণ এটাও হতে পারে, ওটাও হতে পারে।’
তাহলে একজন আমাদের মুল্লুকের এ, বি, সি, ডি ডাক্তার কেন এভাবে বলছেন? এ, বি, সি, ডি সবাই নাও বুঝতে পারেন। এ, বি, সি, ডি মানে হচ্ছে ‘আমেরিকান বর্ণ কনফিউজড দেশি’।
এ ক্ষেত্রে তিনি নিজে অন্য দেশ থেকে আমেরিকায় আসেননি, তাঁর বাবা-মা অন্য দেশ থেকে এসেছেন। কাজেই তাঁদের কথায় আমাদের মতো বিকট ‘হ’ উচ্চারণে এবং খাঁটি গ্রামারে ‘হয়ার আর ইউ ফরম’ থাকে না।
কিন্তু আরেক ডাক্তারকে নিয়ে হাসছে কেন?
বারো পৃষ্ঠার বড় ফরমে অনেক কিছু লিখতে হয়। রোগীর আধঘণ্টা লেগে যায়। নানা-নানি, দাদা-দাদির অসুখ কী কী ছিল, যা তাঁরা আমাকে দিয়ে গেছেন, তাও অনুমান করে লিখতে হয়। অনেক ডাক্তার আছেন, রুমে ঢোকার আগে ৩০ সেকেন্ড সেই ফরমে চোখ বোলান। তারপর ঠিক চার মিনিট রোগীকে সময় দেন। তাড়াহুড়ো যে করছেন, সেটা অবশ্য রোগীকে বুঝতে দেন না।
আমি এ নিয়ে মোটেও অভিযোগ করি না। কারণ, এমন অনেক রোগী আছে যাদের এখন-তখন অবস্থা। আমার মতো শখের রোগীর পেছনে সময় ব্যয় না করে, তাদের তো সময় দেওয়া উচিত?
যা হোক, জানাই আছে ডাক্তার ৪ মিনিট সময় দেবেন। দেড় মিনিট পার হয়ে গেছে। হাত উল্টে-পাল্টা, সামনে-পেছনে করতে বললেন। নার্ভের সমস্যা হলে হাতের কোনো একটা মুদ্রা করতে বেগ পেতে হবে। তারপর হাতে এখানে ওখানে টোকা দিয়ে বলছেন, ‘ঝি ঝি করে?’ আমি বুঝতে পারলাম না কি বলব। আসলে করছে না, কিন্তু করছে না বললে তো চিকিৎসাই করবে না? আবার ছোট বেলায় স্কুলে কনুইয়ের কাছে যে জায়গাটায় পাজি ছেলেরা টোকা দিয়ে হেসে বলত ‘কেমন লাগে?; সেই জায়গাতেও তিনি টোকা দিলেন। অবাক হলাম, ওখানে টোকা দিলে তো ইলেকট্রিক শক লাগবেই!
রোগীর কাছে ডাক্তারের অফিস যেমন ঝকমারি, ডাক্তারের কাছে রোগী হয়তো আরও বড় ঝকমারি। ফরমে কিন্তু তারা শিক্ষা, কায়কারবার, সবকিছু নিয়ে নিয়েছে। আমার ধারণা এটার দ্বারা ডাক্তার বোঝেন, এই রোগীকে অসুখের কারণ বা চিকিৎসা পদ্ধতি কী ভাষায় বলা উচিত। ‘দাস্ত’ কয়বার হয় বলতে হবে, না ‘বাউল মুভমেন্ট’ হলো কি না সেটা বলবে। তারপর আছে চিকিৎসার সুদূর প্রসারী ফলাফল (প্রগনোসিস) বোঝানো। একজন লটারি প্রেমিককে ‘৭৫% সম্ভাবনা তুমি ভালো হয়ে যাবে’ বললে ভাববে ‘বাহ, আমি তো একেবারে সুস্থ হয়ে যাব’। আরেকজন পরিসংখ্যানের ছাত্রকে তা বললে সে বুঝবে ‘সর্বনাশ, এই চিকিৎসায় দেখি বিরাট ঝুঁকি!’
ডাক্তার আসলে শিক্ষা-দীক্ষা এবং জ্ঞান-বুদ্ধির ব্যাপারটা পোশাক-আশাক, কথা বার্তায় বুঝে নেন বলেই আমার ধারণা। তাই আমি একটু গলা খাকারি দিয়ে বললাম, ‘আমার মনে হয় কার্পাল টানেল সিনড্রোম আছে। লাম্বার ডিস্কে সামান্য সমস্যা হচ্ছে, আর সার্ভিক্যাল ডিস্কেও স্পন্ডিলোসিসের সমস্যা।’
এই তিন কথাতেই ডাক্তার যা বোঝার বুঝে নিলেন। বললেন, ‘আমিও তাই মনে করি, তোমার এটা কার্পাল টানেলও হতে পারে, আবার সার্ভিক্যাল প্রবলেমের জন্য হতে পারে।’
দুটি শব্দ খুবই কাজের। ‘সার্ভিক্যাল’ মানে মেরুদণ্ডের ঘাড়ের অংশ, আর লাম্বার মানে কোমরের। কাজেই ‘কোমরে ব্যথা’ না বলে ‘লাম্বার পেইন’ বললে ব্যথাটা যেন আভিজাত্য পেয়ে গেল। ‘সার্ভিক্যাল স্পন্ডিলোসিস’ মানে ঘাড়ে বাত রোগ হওয়া। এ যেন সেই গরিবের বড় হোটেলে ওমলেট খেতে গিয়ে, সেটা আসলে যে ডিম ভাজা, এই করুন সত্যটি আবিষ্কার করার মতো।
কার্পাল টানেল সিনড্রোম মানে হাতের কবজিতে স্নায়ু টান লাগা। যারা দীর্ঘক্ষণ কম্পিউটারে কাজ করে তাদের এটা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এলিমিনেশন প্রক্রিয়া শুনে খুশি হলাম। ইনি মনে হলো ডক্টর ক্রুগের থেকেও ভালো।
তারপর বললেন, ‘হাতে একটা ইনজেকশন দিতে হবে।’ ইনজেকশনে যদিও আমি ভয় পাই না, কিন্তু এখন কিঞ্চিৎ ভড়কে গেলাম। নার্ভের ইনজেকশন! কত ভেতরে ঢোকাবে কে জানে? আমার আবার অফিসে ফিরে যেতে হবে, জরুরি কাজ আছে। তাঁকে বললাম, ‘এই ইনজেকশন নিতে কোথায় যেতে হবে?’
নিশ্চয়ই কোথাও গিয়ে আরেকদিন নিতে হবে, তাহলে আর নেব না। তিনি বললেন, ‘এখানেই দেওয়া হবে, ওই যে আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট ইনজেকশন নিয়ে আসছে।’
পাশেই একজন স্থূলকায় নারী খুটখাট করছিলেন। একবার ওপরে কী একটা তুলে দেখলেন। তাঁকে এতক্ষণ সেভাবে খেয়াল করি নি। বুঝলাম সময় কম। ডাক্তার বললেন, ‘হাত টেবিলের ওপরে রাখ।’
কী জিজ্ঞেস করব, কী না করব ভাবতে ভাবতে বললাম, ‘এই ইনজেকশনের প্রভাব কত দিন থাকবে?’ তিনি বললেন, ‘অনেক দিন, তোমার অসুখ ভালোও হয়ে যেতে পারে।’
মানে কড়া ইনজেকশন। ভাবলাম বলি, আমার অসুখ আসলে কিছুই না, একটু বাড়িয়ে বলেছি। এই সেদিন সমুদ্রে এক ঘণ্টা দাপিয়ে আসলাম। হঠাৎ যে কারওই হাত পায়ে ঝি ঝি ধরতে পারে। আমার ক্ষেত্রে তাই হবে হয়তো।
সিরিঞ্জ আমার সামনেই, কিন্তু আমি সিরিঞ্জের দিকে তাকাচ্ছি না। এঁকে থামানো যায় কীভাবে বুঝতে পারছি না। তখন একটা অপ্রিয় সত্য মনে বিঁধে গেল। টুথপেস্ট একবার বের হলে আর ঢোকানো যায় না। ইনজেকশনও একবার অ্যাম্পুল থেকে বের হলে আবার অ্যাম্পুলে ঢোকানো যায় না। টুথপেস্ট তবু ফেলে দেওয়া যায়। ইনজেকশন রেডি করার পর ফেলে দেওয়া যায় না। মানুষের শরীরে যেভাবেই হোক ঢোকাতে হবে। এই মুহূর্তে সেটা ঢুকবে মোস্তফা তানিমের শরীরে। ডাক্তারকে আবার বেশ ভালোই মনে হয়েছে। তিনি এই বিষয়ে মতামতও জিজ্ঞেস করছেন না। যেন এটা বিশেষ ইনজেকশন না, জিভ বের করে ‘আআআ’ করতে বলছেন মাত্র।
ভরসার মতো একটি যুক্তি দেখলাম। তিনি তখন আমার হাতে স্প্রে দিচ্ছেন। তাতে নাকি হাতের ওই জায়গা অবশ হয়ে যাবে। তারপর দীর্ঘ সুচ সময় নিয়ে গুতিয়ে কবজির মধ্যে ঢোকাতে পারবেন। তিনি স্প্রে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি ঠিক আছ?’
আমি অন্য দিকে তাকিয়ে কি বললাম জানি না। তবে ভরসার কথাটা চিন্তা করলাম। আশপাশে বহু ডাক্তার-নার্স এবং রোগী। রুমের দরজাও খোলা। এটা হাসপাতালও না। কাজেই আমি ব্যথায় চিল্লাবো সেই ঝুঁকি তিনি নিতে পারেন না। তার মানে ব্যথা হবে না। কিন্তু ভয় হবে। অথবা ব্যথাটা হবে, পরে।
আমি অন্য কারণেও এই ইনজেকশন নিতে অস্বীকার করতে পারি। এটা হয়তো স্টেরোয়েড, এর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াও থাকতে পারে। কিন্তু তিনি কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। তিনি ইনজেকশন শুরু করলেন, অর্ধেক হওয়ার পরে আমি ভাবলাম এত সহজে পার পাব না নিশ্চয়ই, হাড্ডি পর্যন্ত নিয়ে যাবে। ব্যথা না লাগলেও দেখে ভয় লাগবে। কাজেই আমি দেখলাম না। ব্যথাও পেলাম না। তিনি মাত্র ১৫ সেকেন্ডে কাজ শেষ করলেন।
বললেন, ‘চার সপ্তাহ পরে দেখা করো। তোমার ঝি ঝি চলে গেলে এটা কার্পাল টানেল। না গেলে অন্য ব্যবস্থা।’ বলে হাত মিলিয়ে হেসে চলে গেলেন। মনটা আবার ভালো হয়ে উঠল।
চেক আউট করে বেরিয়ে পড়লাম। দশ কদমও যাইনি, হাতে ভয়ানক ঝি ঝি শুরু হলো। বুঝলাম ইনজেকশনের ফল। হাত ভার হয়ে যাচ্ছে। আবার ফিরে গিয়ে বন্ধ দরজা খুলে, ‘ভাই আমার তো হাতের অবস্থা শেষ করে দিয়েছেন’, বলার ইচ্ছাটা দমন করতে পারলাম। ভাবলাম, একটু ঝিন-ঝিন কিন-কিন্ না করলে আবার ইনজেকশন কি? কুইনাইন খেতে কী মিষ্টি লাগে?
লিফট দিয়ে নামতে নামতে আমার বাঁ হাত প্রায় পুরো অবশ। তাও ভালো আরেকটা হাত আছে। ডান হাত দুই পকেটে ঢুকিয়ে ফোন, গাড়ির চাবি, সব বের করলাম। ডান হাত বাম পকেটে ঢুকিয়ে চাবি বের করতে যে শরীর প্রায় দুই পাক খেয়ে যায়, তা জানতাম না। গাড়ি চালাতে গিয়ে বোঝা গেল যে, একেই বলে কার্পাল টানেল সিনড্রোম। মানে ওই ইনজেকশন কার্পাল টানেল করে দিয়েছে। এই কী বিষে বিষক্ষয়? কতক্ষণ থাকবে? কিছুই তো তিনি বললেন না! নিজের হাত নিজের নিয়ন্ত্রণে নেই। সামান্য একটা ইনজেকশনের প্রভাবে!
সুনীলের একটা কবিতায় আছে ‘নিজের দু’হাত যখন নিজেদের ইচ্ছে মতো কাজ করে তখন মনে হয় ওরা সত্যিকারের’। সুনীলের কী তাহলে কার্পাল টানেল সিনড্রোম হয়েছিল?
আবার একটা ভরসার যুক্তি পেলাম। এই দেশে এমন কিছু একজন ডাক্তার করবেন না, যা রোগীর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। তাই এক হাত ঝুলিয়ে, অন্য হাত দুলিয়ে, আবার অফিসে ঢুকলাম। সবাই খুশি, কারণ আমি দুই হাতে কাজ করলে তাদেরও পাল্লা দিয়ে অনেক কাজ করতে হয়।
কয়েকজন বন্ধু শুনে বলল, ‘সর্বনাশ, করেছে কী? কেস করে দাও!’ কিন্তু আমার সর্বনাশও লাগছে না, রাগও হচ্ছে না। ডাক্তারকে বেশ ভালোই মনে হলো।
আমরা কাউকে ভালো মনে করলে তার শত দোষ হাসি মুখে নিজেই খণ্ডাই, আর ভালো না মনে করলে বিনা দোষে তার জীবন অতিষ্ঠ করে তুলি।
হায়রে ইনজেকশন!!