ইরানে ‘বেপরোয়া’ হামলা চালাতে পারেন ট্রাম্প, আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের

ইরানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ট্রাম্পের ওপর চাপ রয়েছে তাঁর মিত্র ইসরায়েল ও সৌদি আরবের। এ ছাড়া এখন পর্যন্ত পরাজয় স্বীকার না করা ট্রাম্প ২০ জানুয়ারি বাইডেনের ক্ষমতা গ্রহণ প্রক্রিয়া জটিল করতে নানা কৌশল করছেন। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, সব মিলিয়ে ইরানে বেপরোয়া ধরনের হামলা চালিয়ে বসতে পারেন ট্রাম্প।

বিমানবাহী মার্কিন রণতরি ইউএসএস নিমিৎজ মধ্যপ্রাচ্যেই মোতায়েন থাকবে।ছবি: রয়টার্স

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চলতি মাসেই ইরানের ওপর হামলা চালাতে পারেন বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্পের সময় দ্রুত শেষ হয়ে আসছে। তার আগেই ইরানের বিরুদ্ধে বেপরোয়া কোনো সামরিক পদক্ষেপ নিয়ে বসতে পারেন তিনি। বিশেষজ্ঞরা সে রকম আশঙ্কা থেকেই আগেভাগে সতর্ক করে দিচ্ছেন।

কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আল–জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মার্কিন হামলায় ইরানের শীর্ষ জেনারেল কাশেম সোলাইমানি নিহত হওয়ার বর্ষপূর্তিকে ঘিরে ওয়াশিংটন–তেহরান সম্পর্ক এখন চরম উত্তপ্ত। তাই ভয়াবহ পরিস্থিতির আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের। গতকাল সোলাইমানি হত্যার বর্ষপূর্তিতে তাঁর হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার অঙ্গীকার করেন ইরানেরা নেতারা।

বিশেষজ্ঞদের এই আশঙ্কার পক্ষে নানা আলামত পাওয়া যাচ্ছে। গত মাসেই যুক্তরাষ্ট্র তিনবার উপসাগরীয় অঞ্চলে তাদের বোমারু জেটবিমান উড়িয়েছে। এর মধ্যে গত বুধবার ছিল তাদের সর্বশেষ মহড়া। গত বছরের ৩ জানুয়ারি বাগদাদে মার্কিন ড্রোন হামলায় কাশেম সোলাইমানি নিহত হন। তাঁর হত্যাকাণ্ডের বর্ষপূর্তিতে ইরান হামলা চালালে তার পাল্টা জবাব দিতেই প্রস্তুতি হিসেবে যুদ্ধবিমানের এই মহড়া বলে উল্লেখ করেছে ট্রাম্প প্রশাসন। গতকাল রোববার নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবদেনে জানানো হয়, বিমানবাহী মার্কিন রণতরি ইউএসএস নিমিৎজ মধ্যপ্রাচ্যেই মোতায়েন থাকবে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও মার্কিন শীর্ষ কর্মকর্তাদের বারবার হুমকি দিচ্ছে ইরান। এ পরিপ্রেক্ষিতে নতুন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। মাত্র চার দিন আগেই যুক্তরাষ্ট্র ওই রণতরি ওই অঞ্চল থেকে ফেরত আনার ঘোষণা দিয়েছিল। মার্কিন গণমাধ্যমে গত নভেম্বরেও খবর প্রকাশ হয়, ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার কথা ভেবেও শেষ পর্যন্ত সরে আসেন ট্রাম্প।

যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড এরিয়া স্টাডিজের সহকারী পরিচালক ড্যানি পোস্টেল বলেন, ‘হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পের হাতে এক মাসেরও কম সময় রয়েছে। এই সময়ের মধ্যে ইরানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে মধ্যপ্রাচ্যের মিত্র ইসরায়েল ও সৌদি আরবের কাছ থেকে চাপ রয়েছে তাঁর ওপর।’

আল–জাজিরাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ইরান ও মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি বিশেষজ্ঞ ড্যানি পোস্টেল বলেন, ‘খেলার শেষ দৃশ্যে ট্রাম্প অত্যন্ত আহত ও খুব কোণঠাসা প্রাণীর ভূমিকায়। তাঁর হাতে সময় কম। আমরা তাঁর অনিশ্চিত আচরণ সম্পর্কে জানি।’

পোস্টেল বলেন, ‘সবচেয়ে অনিশ্চিত আচরণ হিসেবে ইরানের ওপর ট্রাম্পের বেপরোয়াভাবে আঘাতের আশঙ্কা এখনো উড়িয়ে দেওয়া যায় না।’

ইরানের শীর্ষ জেনারেল কাসেম সোলাইমানি। গত বছরের ৩ জানুয়ারি বাগদাদে মার্কিন ড্রোন হামলায় নিহত হন তিনি
ফাইল ছবি

ইসরায়েলের উসকানিতে ট্রাম্প ইরানে হামলা চালাতে পারেন—এমন আশঙ্কা আছে তেহরানেরও। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফ গত শনিবার ইসরায়েলি ফাঁদে পা না দিতে ট্রাম্পের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, জাভেদ জারিফ ইরাক থেকে পাওয়া নতুন গোয়েন্দা তথ্যের বরাতে বলেছেন, ভুয়া অজুহাতে ট্রাম্পকে দিয়ে ইরানে হামলার চেষ্টা করছেন ইসরায়েলি এজেন্টরা। ট্রাম্পকে উদ্দেশ করে জারিফ টুইটে বলেন, ‘ফাঁদের ব্যাপারে সাবধান। যেকোনো রকমের হামলার পরিণতি বাজেভাবে উল্টো বিপদ ডেকে আনবে।’

সোলাইমানি হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই ইরান কঠোর প্রতিশোধ নেওয়ার ঘোষণা দিচ্ছে বারবার। তবে তেহরান ট্রাম্পকে সামরিক সংঘাতের কোনো পটভূমি তৈরি করতে দেবে—এমনটা মনে করছেন না বিশেষজ্ঞরা। কারণ, ২০ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেবেন জো বাইডেন। তিনি তেহরানের সঙ্গে কূটনৈতিক যোগাযোগ শুরুর প্রত্যাশার কথা জানিয়েছেন আগেই। বাইডেন এ–ও বলেছেন, তিনি ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক কর্মসূচির চুক্তিতে আবার ফিরতে চান।

সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার আমলে ২০১৫ সালে ইরানের সঙ্গে চুক্তিতে পৌঁছায় যুক্তরাষ্ট্র। ছয় জাতি চুক্তি হিসেবে পরিচিত এ চুক্তিতে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া রয়েছে রাশিয়া, চীন, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানি। ওই চুক্তির মূল বিষয় ছিল, ইরান পরমাণু কার্যক্রম সীমিত রাখবে ও আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ) ইরানের যেকোনো পারমাণবিক স্থাপনা যেকোনো সময় পরিদর্শন করতে পারবে। বিনিময়ে ইরানের ওপর থেকে অর্থনৈতিক অবরোধ তুলে নেবে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর গত বছর এই চুক্তি থেকে সরে দাঁড়ায় যুক্তরাষ্ট্র।

খেলার শেষ দৃশ্যে ট্রাম্প অত্যন্ত আহত ও খুব কোণঠাসা প্রাণীর ভূমিকায়। তাঁর হাতে সময় কম। আমরা তাঁর অনিশ্চিত আচরণ সম্পর্কে জানি।
ড্যানি পোস্টেল, ইরান ও মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি বিশেষজ্ঞ

বিবিসির খবরে আজ সোমবার জানানো হয়, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির মূল উপাদান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার কাজ শুরু করে দিয়েছে। বিষয়টি আইএইএকে আনুষ্ঠানিকভাবে আগেই জানিয়েছে দেশটি। ইরান বলেছে, তারা ইউরেনিয়াম ২০ শতাংশ পর্যন্ত সমৃদ্ধ করার পরিকল্পনা করেছে। ২০১৫ সালে আন্তর্জাতিক চুক্তির আগপর্যন্ত ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার এই স্তরেই পৌঁছেছিল, এখান তারা সে জায়গায় যেতে চায়। তবে সংঘাত এড়াতে যারা কূটনৈতিক যোগাযোগের পক্ষে, তাদের মত হলো— ইরানের জন্য আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনে চলাটাই কূটনৈতিক সম্পর্ক বাড়ানোর একমাত্র উপায়।

ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানিও সে ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, চুক্তিতে স্বাক্ষরকারীরা সবাই ফিরলে তাঁর দেশও ফিরতে প্রস্তুত।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প
এএফপির ফাইল ছবি

ওয়াশিংটনভিত্তিক থিঙ্কট্যাংক কুইনসি ইনস্টিটিউট ফর রেসপনসিবল স্টেটক্রাফটের নির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট ট্রিটা পারসি বলেন, ‘ইসরায়েলের প্রচারক ও সমর্থকেরা ট্রাম্পকে ইরানের সঙ্গে সংঘাতে জড়ানোর জন্য চাপ দিচ্ছেন।’

আটলান্টিক কাউন্সিলের ফিউচার অব ইরান ইনিশিয়েটিভের পরিচালক ও বিদেশনীতি বিশেষজ্ঞ বারবারা স্লাভিন গত শুক্রবার বলেন, ট্রাম্প প্রশাসন ও ইসরায়েল সম্প্রতি এই অঞ্চলে অনেক কিছু জড়ো করায় আমেরিকা ও ইরানের মধ্যে ব্যাপক যুদ্ধের হুমকি রয়ে গেছে। বারবারা আরও বলেন, ‘জুনে ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে কূটনীতির একটি জানালা খোলা আছে এবং সেটি হতে পারে সামনে এগিয়ে যাওয়ার একমাত্র পথ। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল সাইবার হামলার মাধ্যমে ইরানের লক্ষ্য অর্জনের পথ বন্ধ করতে পারবে না। ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে বাধাগ্রস্ত করার ক্ষেত্রে কূটনীতিই একমাত্র কার্যকর উপায় হিসেবে প্রমাণ হয়েছে। এটাই একমাত্র সংবেদনশীল পথ।’