এক নুড়ি এক ডলার

পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহ চাঁদ
ছবি: রয়টার্স

যুগে যুগে চাঁদের সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়েছে মানুষ। কিন্তু নিল আর্মস্ট্রংদের হাত ধরে একবার চাঁদকে স্পর্শ করা গেলেও তারপর পেরিয়ে গেছে অনেক বছর। মানুষ আর চাঁদের নাগাল পায়নি। তবে যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা ২০২৪ সালে আবারও চাঁদে মানুষ পাঠাতে চায়। এর আগে গবেষণার জন্য সংস্থাটি চাঁদের মাটি, নুড়িপাথর সংগ্রহের উদ্যোগ নিয়েছে। এ জন্য তারা চাঁদের ছোট্ট এক খণ্ড নুড়ি কিংবা মাটির জন্য চারটি প্রতিষ্ঠানকে ১ মার্কিন ডলার করে (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৮৫ টাকা) দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই নিল আর্মস্ট্রং প্রথম মানব হিসেবে চাঁদের বুকে পা রাখেন। তাঁর ১৯ মিনিট পর চাঁদে নামেন আরেক মহাকাশচারী বাজ অলড্রিন। তাঁরা দুজন মিলে দুই ঘণ্টার বেশি সময় চন্দ্রপৃষ্ঠে ঘুরে বেড়ান। সংগ্রহ করেন ২১ কেজির বেশি চাঁদের নমুনা। এই সময়টায় কমান্ড মডিউল কলাম্বিয়ায় চেপে চাঁদকে প্রদক্ষিণ করছিলেন নিল আর্মস্ট্রং ও বাজ অলড্রিনের সহযাত্রী মাইকেল কলিন্স।

ঐতিহাসিক ওই ঘটনার পর পেরিয়ে গেছে ৫০ বছরের বেশি সময়। মানুষ আর চাঁদকে ছুঁতে পারেনি। তবে বিজ্ঞানীরা বসে নেই। তাঁরা প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে যাচ্ছেন চাঁদে আবারও মানুষ পাঠানোর। এরই অংশ হিসেবে নাসা এরই মধ্যে প্রস্তুতিও শুরু করে দিয়েছে। কাজ করে যাচ্ছেন রাশিয়া ও চীনের বিজ্ঞানীরাও।

নাসা নুড়ি কেনার ঘোষণা এমন সময়ে দিল, যখন চাঁদের নমুনা সংগ্রহে সেখানে চীনের একটি চন্দ্রযান অবতরণ করেছে। চ্যাং-ই-৫ নামের ওই মহাকাশযানটির চলতি মাসের শেষ দিকে পৃথিবীতে ফেরার কথা রয়েছে। এর আগে ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে চাঁদের দূর প্রান্তে একটি মহাকাশযান নামায় চীন। চাঁদের এই প্রান্তে সেবারই প্রথম কোনো চন্দ্রযান অবতরণ করে।

যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যম বিবিসির এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, চাঁদের নমুনা সংগ্রহে নাসা চারটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করেছে। এগুলো হলো যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডোভিত্তিক লুনার আউটপোস্ট, ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক মাস্টেন স্পেস সিস্টেমস এবং জাপানের টোকিওভিত্তিক আইস্পেস ও এই প্রতিষ্ঠানের ইউরোপীয় সহযোগী প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানগুলো নিজ নিজ উদ্যোগে চাঁদ থেকে নুড়ি সংগ্রহ করবে। এসব নুড়ির একেকটির ওজন ৫০ থেকে ৫০০ গ্রামের মধ্যে হতে হবে।

এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে চাঁদের প্রতিটি ছোট নুড়ির জন্য নাসা ১ ডলার করে দেবে। এসব নমুনা নাসা গবেষণার কাজে ব্যবহার করবে। এর পাশাপাশি নাসার আরেকটি উদ্দেশ্য আছে, তা হলো চাঁদ থেকে নমুনা সংগ্রহ, বিক্রি এবং তা ব্যবহারের একটি ব্যবসায়িক মডেল দাঁড় করানো।

নাসার এক মুখপাত্র গত বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে বলেছেন, ওই চার কোম্পানি চাঁদের নমুনা সংগ্রহের পর দৃশ্যমান প্রমাণসহ অন্যান্য তথ্য উপস্থাপন করবে। এরপরই নমুনাগুলোর মালিকানা নাসার হয়ে যাবে। নাসা আরও জানিয়েছে, চাঁদের নমুনা সংগ্রহের কাজটি এই চার কোম্পানিকে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় করতে হবে। নাসা এসব কাজে কোনো অংশীদারত্বে যাবে না।

কোম্পানি চারটির মধ্যে কলোরাডোর রোবটিকস ফার্ম লুনার আউটপোস্ট চাঁদের দক্ষিণ মেরু থেকে নমুনা সংগ্রহ করবে। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জাস্টিন সাইরাস বিবিসিকে বলেন, ‘আমাদের পরিকল্পনা ২০২৩ সালে চাঁদে মহাকাশযান পাঠাব। তবে কয়েকটি মহাকাশযান নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমরা কাজ করছি। কাজেই আরও আগেও হয়তো আমরা চাঁদ থেকে নমুনা সংগ্রহ শুরু করতে পারব।’ তিনি জানান, নাসা তাঁদের সংগৃহীত পুরো নুড়ির দাম হিসেবে সর্বোচ্চ ২৫ হাজার ১ ডলার দিতে চুক্তি করেছে।

নাসা নুড়ির যে দাম ধরেছে, তা অবশ্য এই কোম্পানিগুলোর জন্য লাভজনক না–ও হতে পারে। তবে চাঁদের বুক থেকে সম্পদ আহরণের ব্যবসায় সংশ্লিষ্ট হতে বেসরকারি খাতকে এই উদ্যোগ উৎসাহিত করতে পারে। এ বিষয়ে জাস্টিন সাইরাস বলেন, এই উদ্যোগ মহাবিশ্বে সম্পদ আহরণে সমাজের চিন্তাধারায় পরিবর্তন আনবে। তিনি জানান, প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান অ্যামাজনের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোসের মালিকানাধীন ব্লু অরিজিনসহ কয়েকটি কোম্পানির সঙ্গে তাঁরা আলোচনা করছেন।

জাপানের আইস্পেস চাঁদের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় প্রান্ত থেকে নমুনা সংগ্রহ করবে। ২০২২ সালেই এই কাজ শুরু করতে চায় তারা। তাদের প্রস্তাবিত নুড়ির মোট পরিমাণের জন্য নাসা ৫ হাজার ডলার দেবে।

মহাকাশ বিশেষজ্ঞ সিসিয়েড ও’সুলিভানের মতে, নাসার এই উদ্যোগ অর্থ দিয়ে মাপলে চলবে না। বরং এক ডলার করে নুড়ির দাম ঘোষণা করে নাসা গুরুত্বপূর্ণ এক পদক্ষেপ নিয়েছে। এখানে হয়তো উদ্ভাবনের আর্থিক মূল্য থাকবে না। তবে ব্যবসায়িক মডেল দাঁড়াবে।

বিবিসি জানায়, ওই চার প্রতিষ্ঠানকে নাসা তিন দফায় নুড়ির মূল্য পরিশোধ করবে। কোম্পানিগুলো যে পরিমাণ নুড়ি সংগ্রহ করবে বলে প্রস্তাব করেছে, তার ওপর আনুমানিক মূল্য নির্ধারণ করা হবে প্রথমে। এরপর এই মূল্যের ১০ শতাংশ দেওয়া হবে চুক্তিপত্র হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। পরবর্তী ১০ শতাংশ দাম চুকানো হবে প্রতিষ্ঠানগুলোর চাঁদের উদ্দেশে মহাকাশযান উৎক্ষেপণের সময়। বাকি ৮০ শতাংশ দাম পরিশোধ করবে নাসা চাঁদের নমুনা হাতে পাওয়ার পর।

এ বিষয়ে লুনার আউটপোস্টের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জাস্টিন সাইরাস মজা করে বলেন, ‘হ্যাঁ, এই এক ডলার তিন ভাগে পাব আমরা। প্রথমে দশমিক ১০ ডলার, তারপর দশমিক ১০ ডলার এবং সবশেষে দশমিক ৮০ ডলার।’