এলোমেলো মায়া

কয়েক দিন ধরে চারদিকে কৈশোরের গুঞ্জন। নস্টালজিক সব দৃশ্য। অলস দুপুর! প্রেমে ভরা বিকেল, সন্ধ্যা! দুপুরে ঘুম থেকে উঠে মন খারাপ করা বিকেল! ‘আছরের পর ঘুমাতে হয় না’, মা-বাবার উপদেশ বাণী। আমাদের টেলিপ্যাথিই ছিল ভরসা। কারও ফোন থাকলেও তা হাতের নাগালে না। মোবাইল বলে যে একটা জিনিস, তা তো স্বপ্নেও জানতাম না। তুই কী কাল সন্ধ্যায় আমারে মনে করেছিস? কেউ কেউ নিজেকে হিমু ভাবত, রূপা ভাবত, শুভ্র ভাবত। মায়াবতী বা দেবী! খুব প্রিয় সহপাঠীকে বলতে না পারা ভালো লাগার কথা! সবকিছু যেন মনের গোলমাল আরও বেশি বাড়িয়ে দিত! আমার চারপাশে এসব কী হচ্ছে? আমার মনে হচ্ছে আমিও হিমুর মতো উদাস দুপুরে হেঁটে চলেছি দূর গন্তব্যহীন কোনো পথে।
নাহ্ গন্তব্যহীন নয়। আমি হাঁটছিলাম না। আমি ট্রেনের কামরায়। যাচ্ছি ইস্ট ব্রুকলিন। একটা ঠিকানা দেওয়া আছে। ২৫ ইস্ট ব্রুকলিন, বাড়ির নম্বর দেওয়া আছে। সবচেয়ে বড় জিনিস আমার মোবাইলে আনলিমিটেড ডাটা আছে। জিপিআরএস ব্যবহার করে ঠিকানা দিলে সব চলে আসবে। কখন কত সময় লাগবে পৌঁছাতে। হু কেয়ারস? সমস্যা না। আমি যাচ্ছি। কোথায় যাচ্ছি আমি নিজেও ঠিক জানি না। আমার কাছে ব্রুকলিন মানে সেই প্রেমিক ব্রিজ। কিন্তু বিশ্বের এই বড় সিটির বিশালত্ব বোঝানো দায়। কোথাও রওনা হলে মনে হয় আমি আমেরিকা থেকে দিল্লি যাচ্ছি। বিলিভ মি।
কিন্তু আমার বহু বছর পর মনে হচ্ছে আমিও ঘোরের মধ্যে আছি। সেই তারুণ্য থেকে থেকে আমাকে স্পর্শ করছে! আমাকে কোনো স্টেশনে নামতে হবে আমি মাঝেমধ্যে ভুলে যাচ্ছি। এই মানুষটার ক্ষমতা অসাধারণ! নিজে এ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। কিন্তু মানুষের অবচেতন মনে এক ছায়া ফেলে রেখেছেন এখনো। মায়া। এ মায়ার ঘোর নিয়ে আমরা একদিন চলে যাব। মনোবিজ্ঞানী নিহারঞ্জন! আমাদের স্যার ক্লাসে একদিন বললেন, ‘আরে হুমায়ূন আহমেদ তো প্যারা সাইকোলজি ক্রিয়েট করে।’ স্যারের কথায় কী কোনো তাচ্ছিল্য ছিল, যা আমাকে কষ্ট দিয়েছিল সেদিন। আমার বলতে ইচ্ছে হয়েছিল, ‘স্যার প্যারা সাইকোলজি না। সত্য। আমার অনেক প্রেডিকশন সত্য হয়ে যায় বা আমি অনেক কিছু আগে থেকে বুঝতে পারি। কী ঘটতে যাচ্ছে।’ জানি, বললে স্যার বা ক্লাসের সবাই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড কামালের মতো আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করত।
তবে ভার্সিটি থেকে বের হওয়ার কিছুদিন পর একদিন একটা ঘটনার পর কামাল আমাকে গুরু মানতে শুরু করল। এর পর আর হাসাহাসি করেনি। বিষয়টা সিরিয়াসলি নিত। হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে আমি কিছু লেখার যোগ্যতা রাখি না এবং লিখছিও না। যদিও তাঁকে প্রথম যে দিন দেখেছিলাম, সে দিন আমার একটা বিষয় মনে হয়েছিল। আমি তাঁকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করেছিলাম। ঠিক আমি না যেন, আমার ভেতর থেকে কেউ। সেই কেউ একজনকে আমি আজও খুঁজছি। তাঁকে নিয়ে গবেষণা শুরু হওয়ার আগেই আমি সে অনুমানের কথা লিখে ফেলব। আমার দু-চারজন সাক্ষী আছেন, যাদের আমি সে সময়ই বলেছিলাম।
মেট্রোরেলে ঘোষণা করল, ক্যানাল স্ট্রিট ক্রস করে ট্রেন ডিক্যাব অ্যাভিনিউতে ঢুকছে। আমি এখানে নেমে চেক করে দেখলাম পাঁচ মিনিট লাগবে। আসলে এখানেই আমি একটা মারাত্মক ভুল করলাম। সেটা ঘোরলাগা হুমায়ূনের কারণে কি না জানি না। বের হয়ে এলাম। দুপুরের তীব্র ঝাঁজালো রোদ। সানগ্লাস পরলে চোখে আরাম লাগে, কিন্তু রাস্তার সাইন দেখতে পাই না। এবার আমি একটা পাওয়ার লেন্স কিনে ফেলব। তখন আর আমার কানা বাবার মতো দূর অবস্থা হবে না। সানগ্লাসও পরব। মাইক্যালকোরের অরিজিন্যাল গ্লাস যেন সব শীতল! আহ! কোন দিকে যাব? হাঁটছি কিন্তু জিপিআরএস সব কী এলোমেলো দেখাচ্ছে? না আমার ব্রেন এলোমেলো ঠিক বুঝতে পারছি না। আমি একজনকে দেখালাম, ‘প্লিজ হেল্প মি।’ উনি দেখে বললেন, ‘সামনে।’ কিন্তু সামনের ঠিকানা আর আমার ঠিকানা রাত দিন ব্যবধান। এখন দেখি ট্রানজিটে দিলে বলে ‘ফাইভ ট্রেন’ নিতে। কীসব এলোমেলো নির্দেশনা!
আমি উবার কল করার জন্য সার্চ দিলাম। গন্তব্যে যেতে সময় দেখায় চল্লিশ মিনিট ভাড়া ৪৭ ডলার। মাথা খারাপ নাকি? এই বেকার দিনে ৫০ ডলার উবার ভাড়া দেব? ৮/১০ ডলার হলে কথা ছিল না। আমি কনফার্ম হওয়ার জন্য এক ভদ্রলোকের সাহায্য নিলাম। তিনি নিউইয়র্ক পুলিশের লোক। বললেন ৫নং ট্রেন নিতে। আবার ডিক্যাব সেন্টারের সাবওয়েতে নেমে খুঁজে ৫ নম্বর ট্রেনের অপেক্ষায়।
আসলে এ ট্রেন ধরতে পাঁচ মিনিট সময় লাগবে বলেছিল। এখন কোনটা নেব ট্রেন? ব্রাইটন বিচের দিকে যেটা যাচ্ছে সেটা. না অন্যটা?
ব্র্যাকলিয়ার সেন্টার শেষ করে আরও দুটো সাবওয়ে ফেলে আমি নামলাম সব শেষ স্টপেজে। ২৯ ইস্ট ব্রুকলিন। আমি পেছনে আগালে ২৫-এ পৌঁছে যাওয়ার কথা । আমি হাঁটছি। আমার মাথায় বিদেশিনীদের মতো লাল হেট। মুখে মাস্ক! এটা করোনাকাল।একসময় ২৫ নম্বর স্ট্রিটে ১৩২৪ বাড়ির সামনে পৌঁছে গেলাম। সব ঠিক আছে, শুধু প্রতিষ্ঠানের নাম নেই। এরিয়া কোড মেলে না। আমাকে যেতে হবে 11230। কিন্তু এটা 11226। বিরাট কনফিউজিং। এখানে আশপাশের মানুষ দেখে যা বুঝলাম এলাকা পুরো আফ্রিকান আমেরিকানদের দখলে। সামনে চার-পাঁচজন তরুণ তরুণী মাস্তি করছে। এঁরা সবাই প্রাইভেটকারের চালক। তাঁদের ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে না করোনা বলে কিছু আছে। মৃতের জরিপে তাঁদের সংখ্যার আধিক্যেও সাদাদের প্রতি কটাক্ষ ছিল। অথচ তাদের কোনো হুঁশ নেই।
আমি এবার উবার নিলাম। যিনি আমাকে ঠিকানা দিয়েছেন, মিস ম্যারিগান। তাঁকে কল দিলে ভয়েস মেলে চলে যাচ্ছে। খুব ভালো মানুষ। ফোন ব্যাক করেন, বা মেসেজ রেখে দেন। বিদেশিদের এ ভদ্রতাজ্ঞান আমাকে মুগ্ধ না আশ্চর্য করে। কী অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। তাঁর ভিজিটিং কার্ডে দেখেছি পিএইচডি ডিগ্রিধারী। ফাইভ ফ্ল্যাগসের সিইও। কী অসাধারণ এক মহিলা। আজও দেখিনি। তবে মনে মনে না দেখেই মায়া তৈরি হয়েছে। করোনাকাল গেলে একদিন দেখা করব।
ফেরার পথে আমি ট্রেন থেকে ম্যানহাটন ৫৯ সাবওয়েতে নামলাম। বের হলাম সাবওয়ে সংলগ্ন ব্লুমিংডিলের শোরুম হয়ে। অনেক সেলসম্যান। এটা অভিজাতদের শপিংমল। পৃথিবীর সব বিখ্যাত ব্র্যান্ডের শোরুম আছে। সবগুলোর সেলসম্যান ও সেলসগার্লরা এত সুন্দর যে বলার মতো না। মনে হয় তাঁরা নিজেরাও এক একজন মডেল। করোনাকালে সিটি নীরব। কিন্তু এখানে অনেকে কেনাকাটা করছে।
আমি ছেলেদের হাওয়াই শার্ট হাত দিয়ে ধরে দেখলাম। মন কাড়া মোলায়েম। দেওয়ার মতো কেউ নেই। কিন্তু এগুলো কী ইউনিসেক্স? নাহ এত দাম দিয়ে আমি কাপড় কিনব না। ক্রাইসিসের সময়। অসাধারণ নরম আর পুরো কটন ফ্যাব্রিক। দাম ৩০ শতাংশ অফ। এই ব্লুমিংডিলে প্রথম দিন ঢুকে আমি ভয়ে ভয়ে পা ফেলেছি। মনে হয় ভুল করে আমি হলিউড মুভির কোনো স্যুটিং স্পটে ঢুকে পড়েছি। তখন ক্রিসমাসের সময় ছিল। না বুঝেই পা বাড়ানো। এই কেউ এসে বলবে আরে তুমি এখানে কী করো? এসব কাপড় পরে এখানে ঢোকা নিষেধ। তোমার জুতাও তো ময়লা! এমন সময় প্রিয় পারফিউমের শো রুমগুলো দেখে আমার ভুল ভাঙল। আমি নিজেকে আশ্বস্ত করলাম, ‘যেতে পারো তুমি।’ মনে মনে হাসলাম । কী বোকা আমি!
আজ আমি সব ফ্লোর ঢুঁ মেরে উন্ডোশপিং করে বের হলাম। বহু দিন হয় উইন্ডো শপিং কী প্রয়োজনেও সহজে ঢুকি না। কেন জানি না মন বদলে গেল। ঈশায়ার জন্মের পর থেকে। দেশে থাকতেই এসব ছেড়েছি। আমি ম্যানহাটনের পথে নেমে এলাম। অনেকগুলো শোরুম জিনিসপত্র কী এলোমেলো করছে। বন্ধ করে ফেলবে বোধ করি। শহরে মানুষ নেই বললেই চলে। থেকে থেকে দু-একটা হলুদ ক্যাব, প্রাইভেট কার, বাস চলছে না চলার মতো। এই এলাকাটা আমার প্রিয়। আমি মনের মাঝে এক ধরনের ব্যথা অনুভব করতে লাগলাম। এটাই বোধ করি মায়া।
এ শহরের ভগ্ন দশা আমাকে কষ্ট দিচ্ছে। ঈশায়াকে নিয়ে অনেক ঘুরেছি। কমপ্লিট বডি জিমে যেতাম। সামনে কোথাও ডেলেন্সি ক্যান্ডি শপ থাকার কথা। ওর জন্য কটন ক্যান্ডি কিনব। না সেটায় যেতে হলে কয়েক ব্লক হাঁটতে হবে। আজ থাক। বেশির ভাগ স্টোর বন্ধ হলেও আরেকটা পেলাম জেনিফার। প্রাইভেট স্কুলের মতো কিছু কোম্পানি আছে আমেরিকায়। খুব দামি তাদের প্রসাধন সামগ্রী, কাপড়। নাতাশা নামের লিপস্টিক সম্ভবত ২৫০ ডলার। মাঝেমধ্যে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে কে ব্যবহার করে এসব। এগুলো যারা কেনার ঠিক কেনে। বিজ্ঞাপন প্রয়োজন হয় না বোধ করি। এ জন্য এসব ব্র্যান্ডের নাম আমার মতো সাধারণ মানুষরা জানেও না। এটায় ঢুকে লং ড্রেস দেখে চোখ ভরে গেল। কাপড় তো নয় যেন রেশম। সাদা একটা লং সামার ড্রেস খুব ভালো লেগেছে। কিন্তু খুব দাম। ট্রায়াল রুমের সামনে লাইন। বুঝলাম করোনা বুর্জোয়া শ্রেণিতে তেমন অসুবিধা তৈরি করতে পারেনি। আমি বের হয়ে এলাম।
স্টারবাকসে ঢুকলাম। মনে মনে শুধু ভাবলাম এ কী সে শহর? যে শহরের গতি ছিল সেলুলয়েড ফিতায় চলা সিনেমা দৃশ্যের মতো। যুদ্ধ হলে হয়তো শহর বিধ্বস্ত থাকত। উঁচু সব দালান ভাঙা। কিন্তু করোনা খুব ঠান্ডা মাথায় এ গ্রহটাকে হত্যা করছে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় শহর স্থবির। যেন হঠাৎ স্মরণশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। সব ঠিক আছে কিন্তু মনে করতে পারছে না সে কী করত? বিধ্বস্ত শহর! বিধ্বস্ত মানুষ! যেন কী নেই! কী নেই!
আমি ড্রিংক্স নিয়ে বের হলাম। আবারও মনে হলো আমি যদি হিমু হতাম তবে এ ঠান্ডা গ্লাস নিয়ে রূপার সামনে হাজির হয়ে চমকে দিতাম। না আমি আনুশকা হতাম। না এক জন মায়াবতী। মায়াবতীর কথা মনে হতেই আমি দ্রুত পা বাড়ালাম নিজের বাসার পথে। আমাকে ৬৩ থেকে এফ ট্রেন ধরতে হবে। মেয়ে ভিডিওকলে কথা বলেছে। বেড়ে রাখা খাবার খেয়েছে। আমি ওর জন্য ফ্র্যাপাচিনো মোকা নিয়েছি। খরগোশের বাচ্চার মতো চুকচুক কর খাবে ও। আমার মন ভরে যাবে। আমার হাতে ভালোবাসার শীতল পরশ।
কিছু অজানা ভালোবাসাও হাতছানি দেয়। কাঠবিড়ালি! সবগুলো কবুতর অপেক্ষা করছে পাশের বাড়ির চালে। চড়ুই পাখিরাও বিচিত্র স্বরে ডাকবে। অজানা সুন্দর রবিনরাও আসে। আমি না যাওয়া পর্যন্ত ওরা অপেক্ষা করবে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে মন খারাপ করে চলে যাবে। সন্ধ্যা হতে দেরি আছে। ছয়টা বেজে যাচ্ছে। তবুও ফিরে যাওয়া প্রয়োজন। ওদের নিশ্চয় খিদে লেগেছে। খাবার যে চালে দিই সেখানে ওরা বসে না। তাদের প্রথম উদ্দেশ্য খাবার হলেও তারা বসে দূরের চালে, যেখান থেকে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে। কী অদ্ভুত। পাখিদের কে শেখাল এই যোগাযোগ? সবকিছু পৃথিবীতে ফ্রিকোয়েন্সির খেলা। সঠিক ফ্রিকোয়েন্সি না থাকলে কোনো স্টেশনই কাজ করে না। এটাও একটা ভার্চ্যুয়াল ভালোবাসা। অথচ আমার পশুপাখির প্রতি কোনো মায়া ছিল না। মায়া জিনিসটা খুব খারাপ।