ঘানি

সেহেরি খাওয়া শেষে ফজরের নামাজ পড়ে সালেহা সাধারণত ঘুমিয়ে পড়ে। যাকে বলে আরামের ভাতঘুম। এ সময়টা ঘুমের জন্য ওর খুব প্রিয় সময়। আজ শেষ রোজা, তুলির ঘুম আসছে না ঘরের অসমাপ্ত কাজগুলোর চিন্তায়। গত এক সপ্তাহ থেকে আসন্ন ঈদ উপলক্ষে অবিরাম ঘরদোর পরিষ্কারের কাজ করে চলছে, তাও শেষ হচ্ছে না। অনেক কাজ এখনো অসম্পূর্ণ পড়ে আছে। পিঠের ব্যথাটাও ইদানীং আগের চেয়ে বেশি ভোগাচ্ছে সালেহাকে। আগের মতো দ্রুত দৌড়ঝাঁপ করে গুছিয়ে কাজ করতে পারে না। অল্পতেই হাঁপিয়ে ওঠে। যত অসুখ-বিসুখ হোক তার তোয়াক্কা না করে যতক্ষণ শ্বাস আছে, বিদেশ বিভুঁইয়ে একলা হাতেই ঘরের সব কাজ সামলাতে হয়। এখানে সাহায্যকারী বলতে কেউ নেই। বিদেশে বসবাসরত সব ভুক্তভোগীই এ কষ্টের অনুভূতিগুলোর সঙ্গে পরিচিত।
সালেহার ছেলে ও মেয়ে—দুই সন্তান-ই থাকে নিউইয়র্কের বাইরে। মেয়ে বিয়ের পর থেকে কোনো ঈদ মায়ের সঙ্গে করতে পারেনি। এবার সালেহা অনেক অনুরোধ করেছে মেয়েকে নিউইয়র্কে ঈদ করতে আসার জন্য। টেলিফোনের অপর প্রান্তে উত্তরে শুধু দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শুনেছে সালেহা৷ ঘরের বড় বউ সালেহার একমাত্র মেয়ে তুলি, কোনোভাবেই নিজের পরিবার রেখে মায়ের সঙ্গে ঈদ করতে আসতে পারেনি। তবে একসঙ্গে ঈদ উদ্যাপন করতে সালেহার ছেলে ও ছেলের বউ আজ আসবে।
সালেহা রুমের সঙ্গে লাগোয়া বারান্দায় গিয়ে বসে। অন্ধকারের গাঢ় রং সূর্যের আধিপত্যের কাছে আস্তে আস্তে ফিকে হয়ে আসছে। নতুন দিন সমাগত। আলো-আঁধারির এই সময়টা পৃথিবীকে যেন অপার্থিব এক মায়ার চাদর জড়িয়ে রেখেছে। পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ আর ভোরের ঝিরিঝিরি বাতাসে চারপাশের জীবনগুলো ঘুম ভেঙে ধীরে ধীরে জেগে উঠছে। নিউইয়র্কের প্রকৃতিতে এখন ঢলঢলে যৌবনকাল চলছে। যত দূর চোখ যায় সবুজ আর সবুজ। বাড়ির আঙিনায় নরম সবুজ ঘাসগুলো জুড়ে ফুল-পাখি-প্রজাপতির মেলা বসেছে। যে মেলায় চোখ রেখে সালেহার ক্লান্তি কিছুটা কমে এসেছে। মেঘের আঁচড়বিহীন নীলাকাশের দিকে তাকিয়ে মুগ্ধতায় ডুবে যায় মন। মানুষের জন্য প্রকৃতির এমন উজাড় করা রূপ স্রষ্টার এক অপূর্ব দান। যে রূপের প্লাবনে ডুব দিয়ে রিক্ত মানুষগুলো উজ্জীবিত হয়ে ওঠে বেঁচে থাকার আকুল স্বপ্নে। যে স্বপ্নের মোহনায় হারিয়ে গিয়ে ক্লান্ত মানুষটারও মনে হয়, জীবন অনেক সুন্দর। বেঁচে থাকাটাই সুখ। প্রকৃতি বিশাল ক্ষমতাধর। প্রকৃতি অনায়াসেই মানুষের মন ভালো করে দিতে পারে। জীবনের যেকোনো দুর্দিনে মানুষ প্রকৃতির কোলে আশ্রয় খোঁজে। তাইতো চিকিৎসকরাও মানুষের শরীর-মন খারাপ করলে প্রকৃতির সান্নিধ্যে যেতে বলে।
বারান্দার টবে রাখা ফুলগুলো বাতাসে দোল খাচ্ছে। আহা! কী সুন্দর! ভোরের প্রথম আলোয় ফুলগুলোর এমন মায়াময় তিরতির কম্পন ঘুমের ঘোরে কত দিন চোখে দেখেনি সালেহা। বিদেশের ফুলে গন্ধ নেই বলে কোনো দিন ছুঁয়েও দেখেনি ফুলগুলো। সালেহার আলতো হাতের আদরে ফুলগুলো যেন আরও বেশি প্রস্ফুটিত হয়ে উঠে। কথায় বলে আদর, ভালোবাসা, সহানুভূতি পাগলেও বোঝে। ফুল গাছগুলোও মনে হয় বুঝেছে। জীবন বহতা নদীর মতো। বয়ে চলে সদা নিজস্ব গতিতে। কারও জন্য কোনো কারণে জীবন থেমে থাকে না। রংচঙে ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে থেকে সালেহা নস্টালজিক হয়ে পড়ে। মনের আনাচে–কানাচে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা স্মৃতি নামক ঘুণপোকার দল কুটুর–কুটুর শব্দ তোলে।
অনেক বছর আগে ঠিক আজকের মতো ঈদের আগের দিনের কথা। ছোট্ট মেয়েটার আপাদমস্তক জুড়ে চাপা উত্তেজনা বইছে। আনন্দে চোখ দুটো জোনাকি পোকার মতো টিম টিম করে জ্বলছে। প্রজাপতির মতো উদ্দেশ্যহীনভাবে গোটা বাড়ি চষে বেড়াচ্ছে। কারণ একটাই, আগামীকাল যে ঈদ। ঈদ মানেই খুশি আর খুশি। ঈদ মানেই আনন্দ আর আনন্দ। ঈদ মানেই নতুন জামার মোহময় ঘ্রাণে প্রাণ উচ্ছ্বসিত। সালেহাদের পুরো বাড়ি জুড়ে ছিল ফুলের বাগান। যেকোনো উৎসবে কাঁচা ফুল দিয়ে ঘর সাজানো হতো। ঘরের ভেতরে ঈদের দিন সালেহার মনে হতো, সে ফুলের বাগানে বসে আছে। ঘরে ঢুকতেই বাগানবিলাস ফুলের গেট। দুই হাতে ফুল সরিয়ে ঘরে ঢুকত সালেহা। হাসনাহেনার ঘ্রাণে মাঝরাতে সালেহা কত দিন যে ঘর ছেড়ে ফুল বাগানে ছুটে গেছে, তার হিসাব নেই। ‘ফুল বাগানে অন্ধকারে পরির দল আসে, সে পরির দল পাখনায় বসিয়ে তাদের দেশে নিয়ে যাবে’—মায়ের এমন আরও কত ভয় দেখানোর পরেও সালেহাকে ঘরে ধরে রাখতে পারত না।
সালেহাদের বাড়ির সদর দরজার দক্ষিণ দিকে ছিল বিশাল আকৃতির এক মেহেদি গাছ। সে গাছ থেকে ঈদের আগের দিন বিকেল বেলা অনেকেই আসত মেহেদি পাতার জন্য। সালেহার মা কাউকে না করত না। ঈদের চাঁদ দেখা যাওয়ার পর সন্ধ্যা ঘনিয়ে যখন রাত নামল, মেহেদি পাতা আনতে গিয়ে পত্র শূন্য গাছ দেখে সালেহার সে কি কান্না। মা কুপির আলোয় কিছু পাতা তুলে এনে সেদিন ওকে শান্ত করেছিল। পাতাগুলো সিল পাটায় বেটে নারিকেলের সলা দিয়ে হাতে আলপনা আঁকার জন্য সালেহা একবার মায়ের কাছে যায় তো আরেকবার বোনের কাছে যায়। মা, বোন ব্যস্ত ঈদের দিনের প্রস্তুতি নিয়ে। সালেহা ব্যস্ত মেহেদি নিয়ে। রাতে বড় বোন পাশে বসিয়ে সালেহার হাতে হাসনাহেনা ফুল এঁকে দিল। সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রিয় হাসনাহেনা ফুল নিজের হাতে দেখতে পেয়ে খুশিতে সালেহা লাফাতে লাগল। তাড়াতাড়ি গোসল করে নতুন জামা, জুতা পরে ঈদের হাটে যাওয়ার আগে মাকে সালাম করতে গিয়ে দেখে মা কাঁদছে। ছোট্ট সালেহা কিছুতেই বুঝতে পারে না, এমন আনন্দের দিনে মা কেন কাঁদছে? কয়েক মাস আগে সালেহার নানা মারা যায়। নিজেকে প্রবোধ দেয় সালেহা, মনে হয় নানার জন্য মা কাঁদছে।
ছোটবেলায় ভালোভাবে না বুঝলেও, অনেক বছর আগে ঈদের দিনে মায়ের চোখের জলের মর্মার্থ সালেহা আজ বুঝতে পারছে। আজ যে সালেহার চোখেও অশ্রুজল। ঈদের কোনো আনন্দ নেই মনে। আপনজনদের ছেড়ে দূরে সংসার নামক অদৃশ্য কারাগারে বন্দী দায়িত্বের কাদাজলে নিমজ্জিত মেয়েদের জীবন, আনন্দঘন দিনগুলোতে এভাবেই কেটে যায় চোখের জলে। জীবন নামক সূর্য হেলে পড়েছে পশ্চিমাকাশে। বাবা-মা গত হয়েছে বেশ আগেই। সালেহার আজ ভীষণ মনে পড়ছে বাবা-মাকে। যাঁদের স্নেহ, আদর, যত্নে বেড়ে উঠেছে সালেহা আজ তাঁরা কোথায়? বুকে ভারী পাথর ভর করেছে আজ। এ কেমন অদ্ভুত জীবন? নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করে। কোনো উত্তর পায় না সালেহা।
ঘড়ির কাঁটা অনবরত সামনে ছুটছে। আটটা বেজে গেছে। স্মৃতির জাবর কাটতে কাটতে কখন যে এত বেলা হয়ে গেছে টের পায়নি সালেহা। ঘরে ফিরে কাজে মনোনিবেশ করল সে। বুকশেলফ, ড্রেসিং টেবিল, ডাইনিং রুম, রান্নাঘরের চুলা পরিষ্কার করে বাথরুমে ঢুকল। বাথরুম পরিষ্কার করে গোসল শেষে রান্নার কাজে মনোযোগ দিল সালেহা। ইতিমধ্যে ছেলে এসে পৌঁছেছে বাসায়। সালেহার স্বামী ব্যস্ত তাদের নিয়ে। রান্নাবান্না করে সবার জন্য ইফতার বানাতে বানাতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। কাজের শুরু আছে, শেষ নেই। একটা কাজ শেষ না করতেই অন্য কাজ এসে হাজির হয় সামনে। সবার জন্য ডাইনিং টেবিলে ইফতার সাজিয়ে দেওয়া হয়েছে। ইফতারের আরও ঘণ্টা খানিক বাকি আছে। সারা দিনের কাজের চাপে সালেহা হাঁপিয়ে উঠেছে। মনটাও আজ তার ভীষণ ভারাক্রান্ত। বারবার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে অজান্তেই।
সবাই যখন ইফতার সামনে নিয়ে বসে গল্প করছে, সে সময়টা মনের বিষণ্নতা কাটাতে সালেহা বাড়ির সামনে গিয়ে বসে একাকী। পাশেই দেখতে পেল তার ইতালীয় প্রতিবেশী এনথোনেটকে। পোষা কুকুর হাতে বিকেলবেলা সে হাঁটতে বের হয়েছে। হাত তুলে সালেহা হাসিমুখে এনথোনেটকে সম্বোধন জানাল। তারা দীর্ঘদিনের প্রতিবেশী। সালেহার কাছ থেকেই এনথোনেট রমজান মাস সম্পর্কে জেনেছে। ইফতারের আগ মুহূর্তে বাইরে বসে থাকার কারণ জানতে চাইলে আবেগাপ্লুত সালেহা মন খারাপের কথা জানাল তাকে। মানুষের মনের অবস্থা মুখে ভেসে উঠে। সালেহার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে এনথোনেট এসে পাশে দাঁড়ায়। মন খারাপ ছোঁয়াচে রোগের মতন। একজন থেকে অন্যজনে সংক্রমিত হয় সহজেই। সালেহার মুখে বাবা-মা-স্বজনদের জন্য মন খারাপের কথা শুনে এনথোনেটও আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে।
সালেহার পাশে চেয়ার টেনে বসে এনথোনেট। সালেহার মাথায় হাত রেখে বলে, ‘তোমার মন খারাপের কারণের চেয়ে আরও কত বেশি মন খারাপ নিয়ে দেখো একা বেঁচে আছি আমি। শুনবে? আমার দুঃখের কথা শুনলে হয়তো তোমার মন ভালো হয়ে যাবে। শেষ বিকেলের আকাশের দিকে তাকিয়ে এনথোনেট বলতে থাকে, ‘সদ্য কলেজ শেষ করে ইউনিভার্সিটিতে পা রেখেছিলাম। একদিন দুপুর বেলা আমার ভাইয়ের সঙ্গে এড্রিন আসে আমাদের বাসায়। আমাকে দেখে ওর পছন্দ হয়। বিয়ের প্রস্তাব দেয়। আমার পরিবার সানন্দে রাজি হয়ে যায় বিয়েতে। এড্রিন নিউইয়র্কে প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী। দেখতে ভদ্র ও সুদর্শন। এমন পাত্রকে কোনো বাবা-মা অপছন্দ করবে না। আমাদের বিয়ে হয়ে যায়। এ দেশে এসে কিছুদিন পরে জানতে পারি, এড্রিন মিথ্যে বলেছে। সে আইনজীবী নয়। একজন আইনজীবীর অফিসে চাকরি করে মাত্র। কাজ করে সপ্তাহ শেষে যে অর্থ পায়, তার বৃহদাংশ উড়িয়ে দেয় জুয়া খেলে। সত্য জানার পর থেকে তার প্রতি ঘৃণা জন্ম নেয় মনে। মুখে কিছুই বলি না। মিথ্যা দিয়ে যে জীবন শুরু করেছে তাকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল। বাইরে সে যতটা ভদ্র ও বিনয়ী, ঘরে ঠিক ততটাই রুক্ষ বদমেজাজি। আমি পড়াশোনা শুরু করলাম। একপর্যায়ে সে আমার পড়াশোনা বন্ধ করে দেয়। তাঁর ভাষায়, নিউইয়র্কের মতো ব্যয়বহুল শহরে একজনের উপার্জনে সংসার চালানো কঠিন। এ শহরে সংসার চালাতে দু জনকেই সমানভাবে কাজ করতে হবে।’
এনথোনেট বলতে থাকে, ‘অতঃপর পড়াশোনা বাদ দিয়ে আমিও পুরোপুরি কাজে নেমে পড়লাম। আমার আর পড়াশোনা শেষ করা হল না। এর মাঝে সন্তান এল সংসারে। এড্রিনের জুয়া খেলার নেশা দিনদিন বাড়তেই লাগল। ক্রেডিট কার্ড থেকে টাকা তুলেও সে জুয়া খেলার নেশায় মত্ত হয়ে থাকল। দিন দিন আমাদের ঋণের বোঝা বাড়তেই থাকল। মাস শেষে ক্রেডিট কার্ডের বিল দেখে আমি আঁতকে উঠি। আমার নামেও কিছু ক্রেডিট কার্ডের বিল জমতে শুরু করল। প্রতিবাদ করি, ঋণ করে কেন এমন সর্বনাশের খেলায় মেতে থাকতে হবে? এড্রিনের সোজা উত্তর ছিল, এ দেশে সবাই এমন ঋণ করে। পাল্টা জবাব দিলাম, তোমার এ ধরনের অপ্রয়োজনীয় ঋণের চাপে সংসারের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য উবে যেতে বসেছে। এড্রিনের উত্তর, কাজ করে সব ঋণ শোধ করে দেব। হঠাৎ একদিন এড্রিন গত হয়। সব ঋণের বোঝা এসে পড়ে আমার ঘাড়ে। একমাত্র সন্তান সে বিয়ে করে চলে যায় অন্য শহরে। আমি একা পড়ে থাকি এ ঘরে। দীর্ঘদিন যাবৎ একাকী জীবনযুদ্ধ চালাতে চালাতে খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। অদ্ভুত এ জীবন। সংসার-সন্তান-স্বজনের চাপে কেবলই দীর্ঘশ্বাসের এ নারী জীবন। সন্তান বড় হয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে নিজের জীবন নিয়ে। আমাকে সময় দেওয়ার মতো সময় নেই সন্তানের। মাঝেমধ্যে ফোন করে খবর নেয়, বেঁচে আছি কিনা? এখন আমি একা একদম একা।’
একদমে কথাগুলো বলে কিছু সময়ের জন্য নীরব হয়ে যায় এনথোনেট। নির্বাক সালেহা বোবা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। এনথোনেটের দীর্ঘশ্বাস এসে সালেহার বুকে ঠেকে। দীর্ঘশ্বাসগুলো উড়তে উড়তে শূন্যে মিলিয়ে যায়, বৃষ্টি হয়ে লুটিয়ে পড়ে সাগরে। যে দীর্ঘশ্বাসগুলো কেউ দেখতে পায় না।
এনথোনেট কিছু সময় চুপ থেকে জোরে শ্বাস নিয়ে আবার বলতে শুরু করে, ‘বোধ জ্ঞান হওয়ার পর থেকে প্রিয় রং ছিল লাল রং। লাল রঙের মতোই রঙিন জীবন ছিল আমার। বড় হতে হতে সে লাল রং ফিকে হয়ে যায়। জীবন শুধুই আজ বয়ে নেওয়া ছাড়া আর কিছুই নয় আমার কাছে। বুকের সবটুকু ভালোবাসা উজাড় করে দিয়ে কাছের মানুষদের ভালোবেসেছিলাম, বিনিময়ে পেয়েছি আঘাত, অবহেলা আর অসম্মান। কুকুর, বিড়াল, পাখি, মাছ—এদের সান্নিধ্যে নির্মল ভালোবাসা খুঁজে পেয়েছি। এরা আমাকে মিথ্যা বলে না। আঘাত করে না। অসম্মান কিংবা অবহেলাও করে না৷ আমাকে একা ফেলে দূরে যায় না। ওদেরকে নিয়ে আমি এখন নিশ্চিন্তে নির্ভার বেঁচে আছি। মানুষের কাছে যা পাইনি, বোবা প্রাণীদের কাছে তা পেয়েছি।’— এরপর এনথোনেট উঠে দাঁড়াল।
চলে যাওয়ার আগে সালেহার হাত দুটো ধরে বলল, কখনো মন খারাপ করবে না। হতাশ হবে না। নিজেকে নিজে সময় উপহার দেবে। দুঃখ-কষ্ট, আনন্দ-বেদনা সবকিছুর মধ্যে নিজেকে ভালোবাসবে। মুখ ফুটে নিজের মনের কথা বলবে। যে জন্য, যার জন্য মন খারাপ, তার কাছে গিয়ে বেড়িয়ে আসবে। যা মন চায় অন্যের ক্ষতি না করে তৃপ্তি সহকারে সে কাজটি করবে। নিজের চেয়ে বড় কেউ নয়, কিছু নয়—এটা বিশ্বাস করবে। দেখবে সর্বাবস্থায় আত্মতৃপ্তি পাবে।
এনথোনেটের চলে যাওয়ার পথের দিকে চেয়ে থাকে সালেহা। দৃষ্টির আড়াল হয়ে যায় সে। দিনের আলো নিভে গেছে খানিক আগেই। মেঘাচ্ছন্ন আকাশের ফাঁকফোকর হতে তারারা উঁকিঝুঁকি মারছে। নিয়ন বাতির এই শহরে গাঢ় অন্ধকারের দেখা পাওয়া দুষ্কর। সালেহার খুব ইচ্ছে হচ্ছে, এই মুহূর্তে কিছু সময়ের জন্য অন্ধকারের মাঝে ডুব দিয়ে, আকাশের বুকে নাম না–জানা তারাদের ভিড়ে বাবা-মাকে খুঁজতে। বুকের ভেতরটা হু হু করছে৷ ইফতারের সময় সালেহাকে ডাকা হয়েছে। তাকে বাইরে কথা বলতে দেখে পানি, খেজুর দিয়ে গেছে ঘর থেকে। বাইরে খোলা আকাশের নিচে বসে সালেহা শেষ রোজার ইফতার সেরেছে।
ছোটবেলায় ঈদের আগের দিন এ সময়ে সালেহা আকাশের দিকে তাকিয়ে হন্যে হয়ে ঈদের চাঁদ খুঁজত। জীবনের বড়বেলায় আজ ঈদের আগের দিন চাঁদের পরিবর্তে আকাশের দিকে তাকিয়ে সে বিমর্ষ মনে বাবা-মাকে খুঁজছে।
মাগরিবের নামাজের সময়টুকু খুবই স্বল্পস্থায়ী। নামাজ পড়তে সালেহা তড়িঘড়ি করে ওপরে উঠে আসে। নামাজ শেষে বেসিন ভর্তি এঁটো প্লেট-বাসন আর খাবার টেবিল পরিষ্কার করতে করতে সালেহার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শেখা ‘কলুর বলদ’ বাগধারাটার কথা মনে পড়ে যায়। কলুর বলদ মানে হলো একটানা খাটুনি করে যে। স্যার প্রথম ক্লাসে যেদিন কলুর বলদ বাগধারাটার অর্থ বুঝিয়ে বলেছিলেন, সেদিন সালেহার চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল নানার বাড়িতে সারা দিন হালচাষ শেষে জোয়াল কাঁধে গরু দিয়ে ধান মাড়াইয়ের দৃশ্যটি। কালের বিবর্তনে গরু দিয়ে ধান মাড়াইয়ের মতো অমানবিক বিষয়টি হারিয়ে যেতে বসলেও সংসারে নারীদের রাতদিন ঘানি টানার বিষয়টি রয়েই গেছে।
ঈদের দিন সালেহার মায়ের নীরব অশ্রুপাত, টেলিফোনের অপর প্রান্তে সালেহার একমাত্র মেয়ের ভেজা দীর্ঘশ্বাস, সন্ধ্যার আবছা আলোয় এনথোনেটের নিম্নগামী চোখের জলের মধ্যে সালেহা চক্রাকারে কলুর বলদের মতো নারী জীবনে ঘানি টানার একই চিত্র দেখতে পায়।