চার ঋতুর নগরী

সেই ২০০১ সালের কথা। সবে এসেছি আটলান্টিকের পাড়ের এই দেশটিতে। সারা পৃথিবীর রাজধানী, স্বপ্নের শহর, ভালোবাসার শহর নিউইয়র্কে। নিউইয়র্কের ঋতু, মানুষ আর সংস্কৃতি আমাকে দারুণভাবে মুগ্ধ করেছে। চার ঋতুর নগরী এই নিউইয়র্ক। আমি এই মায়াবী শহর, বৈচিত্র্যময় ঋতু আর ঋতুর পালাবদলের সঙ্গে সবে পরিচিত হয়ে উঠছি। ঋতুর মতোই অত্যন্ত বৈচিত্র্যময় এই শহরের মানুষ। পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে জড়ো হওয়া নানা রঙের-বর্ণের আর নানা রুচির মানুষের সঙ্গে এখানে এসেছে নানা কৃষ্টি আর সংস্কৃতি। এসব পাঁচমিশালী ভাষা, ধর্ম, খাদ্য, আনন্দ-উৎসব মিলেই তৈরি হয়েছে আমেরিকার সংস্কৃতি। বারো মাসে তাই এখানে তেরো পার্বণ লেগেই থাকে।
এই ঝকঝকে চকচকে নগরীর ফুটপাথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে আমার দেশের কথা খুব মনে পড়ত। মনে পড়ত মা, ভাই-বোন আর বন্ধু-বান্ধবের কথা। তারা কেউই জানে না, কি দ্রুত আর অদ্ভুতভাবে বদলে যাচ্ছে আমার এখানকার জীবন, বদলে যাচ্ছি আমি নিজে। এই মেগা সিটি আমাকে বদলে দিয়েছে নানাভাবে। মনে, প্রাণে আর পোশাকে। মানুষের জীবনও এই ঋতুর মতোই বৈচিত্র্যময়। পরিবেশ আর প্রকৃতির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষেরও মনের রং আর মেজাজ বদলে যায়।
শরৎ, শীত, বসন্ত আর গ্রীষ্ম এই বর্ণালি চারটি ঋতু নিয়েই নিউইয়র্কের ঋতুচক্র। শরৎ দিয়েই ঋতু গণনার শুরু। সেপ্টেম্বর, অক্টোবর আর নভেম্বর—এই তিন মাস হলো নিউইয়র্কের শরৎ, আমাদের শরৎকাল। সেপ্টেম্বর আসতে না আসতেই ধীরে ধীরে সূর্যের তেজ কমতে শুরু করে। চারদিকে তাকালে মনে হয়, গাছপালার ঘন সবুজ রং মরে ভারি সুন্দর নানা মায়াবী রঙে পাতার রূপান্তর ঘটছে। চারদিকে কেবল হলুদ, লাল আর কমলার ছড়াছড়ি। পাতার এই বাহারি রং যেন ফুলের রংকেও হার মানায়। নানা ঋতুতে নিউইয়র্ককে দেখতে শুরু করলাম নানা সাজে।
এই সময়টায় আবহাওয়া যেমন সুন্দর, তেমনি আরামদায়ক। না গরম, না শীত। মিষ্টি রোদ, ঝকঝকে আকাশ। শহর ছেড়ে একটু দূরের পার্কগুলোতে গেলে দেখা যায় নানা জাতের হাঁস লেকের নির্মল পানিতে সাঁতার কাটছে। সেখানে প্রায় জায়গায় নোটিশ ঝুলিয়ে দেওয়া আছে, যাতে এদের বিরক্ত না করার কথা উল্লেখ রয়েছে। লেকের পানিতে মাছ ধরারও নিয়ম বেঁধে দেওয়া। নির্দিষ্ট দিনে, নির্দিষ্ট সাইজের মাছ ধরা যাবে। সবাই কম বেশি নিয়ম মেনে চলে, তাই সবকিছুই ছবির মতো সুন্দর।
দেখতে দেখতে হেমন্তের পাতাঝরা দিন চলে এল। সারি সারি ওক গাছের সোনালি, লাল আর গোলাপী পাতাগুলো টুপটাপ করে গায়ের ওপর ঝড়ে পড়তে শুরু করল। ধীরে ধীরে শুকনো পাতার রঙিন গালিচা তৈরি হলো সেন্ট্রাল পার্কের বিশাল এলাকাজুড়ে। পাতার ওপর পা ফেলে হাঁটলে মুড়মুড় করে পাতাভাঙার একটা অদ্ভুত শব্দ হয়। ইচ্ছে করে সেই পাতার বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। মাটি আর পাতার মিলিত সোঁদা গন্ধ মনে একধরনের শূন্যতা তৈরি করে। বুকের ভেতরে কেমন যেন খাঁ খাঁ করতে থাকে। কেবলই মনে হয়, কী যেন নেই। কোথাও কেউ নেই। মাঝে মাঝে দেখা যায়, দুই একটা গাছে কাঠঠোকরা তার শক্ত চোয়াল দিয়ে খুঁট খুঁট খুঁট খুঁট করে কাঠ কাটছে। নিজের দেশের কথা মনে পড়ে।
ডিসেম্বর, জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি—এই তিন মাস ক্যালেন্ডারের হিসেবে নিউইয়র্কের শীতকাল। যদিও শীত এসব হিসেবের তেমন তোয়াক্কা করে না। তার যত দিন খুশি তিনি জাঁকিয়ে বসে আরাম করে থেকে যান। কখনো সেই যে আসে, যাওয়ার নামটি নেই। তবুও যখন আসে, কী ভালোই না লাগে। সারা দিন হলুদ রঙা মিষ্টি রোদ গায়ে মেখে ঘুরে বেড়াই। বেলা পড়ে এলেই ঠান্ডা বাতাস বইতে শুরু করে। আরামদায়ক একটা শীত শীত অনুভূতি জাঁকিয়ে ধরে। আহা, কী সুন্দর! কী মধুর সেই সোনামাখা রোদ্দুর! শিরশিরে সেই ঠান্ডা অনুভূতি। একটু একটু করে শীত তার তীব্রতা বাড়াতে শুরু করে। মানুষের গায়ে ওঠে জ্যাকেট, স্কার্ফ, টুপি। হাতে পায়ে মোজা, বুট। একদিন আচমকা রাজকীয়ভাবেই ‘স্নো হোয়াইট কুইন’ তার অভিষেক শুরু করে দেয়। লোকজন আনন্দে নাচতে শুরু করে। আকাশ থেকে ঝুরঝুর করে ঝরতে বরফ ফুল। সেই শুভ্র সাদা তুষার ঝরার সে কী স্বর্গীয় দৃশ্য! আর সেই বরফেরও কত যে বৈচিত্র্য। কখনো শুকনো গুঁড়ি গুঁড়ি, কখনো পেঁজা তুলোর মতো, কখনো ঘন মুষলধারে বৃষ্টির মতো। স্তূপ হয়ে চারিদিক যেন সাদা বরফের চাদরে ঢেকে দেয়। গাছপালাগুলোও যেন সাদা চাদর মুড়ি দিয়ে ঝিমুতে থাকে। বাচ্চারা বরফে গড়াগড়ি করে, দু হাতে ছুড়ে মারে বরফের বল। আমরা মর্ত্যলোকের বাসিন্দারা যেন চলে যাই রূপকথার সেই ‘স্নো হোয়াইটের দেশে’। প্রতি শীতেই প্রথম বরফ পড়ার দিনটি এক স্বর্গীয় আনন্দ নিয়ে বারবার ফেরে। তবুও কখনো এই আনন্দ পুরোনো হয় না।
মানুষের আনন্দ দেখে স্নো কুইনও আনন্দে আত্মহারা হয়ে বরফ শীতল শরীর দিয়ে প্রবল আলিঙ্গনে মানুষকে জড়িয়ে ধরে। তার প্রচণ্ড ঠান্ডা রক্তহীম করা শ্বাস-প্রশ্বাস যখন তীরের মতো এসে মানুষের শরীরের প্রতিটি লোমকূপ দিয়ে ঢুকতে শুরু করে, দুর্বল মানবশরীর তখন অবশ হয়ে আসে। তাই দুর্বল স্বার্থপর মানুষ বসন্তের আরাধনা শুরু করে। বিরস মুখে শীত তখন বিদায়ের আয়োজন শুরু করে। আমরা সুবিধাবাদী মানুষেরা তখন বসন্তের প্রতীক্ষায় থাকি। ওপরে বসে বিধাতা হয়তো মুচকি হাসে। তবে জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে ‘থ্যাক্সস টু গড’ এই বাক্যটি প্রায় সবার মুখেই শোনা যায়। যত আনন্দ আর যত সমস্যাই হোক, তারা মানুষ বা ঈশ্বর, কাউকেই ধন্যবাদ দিতে ভোলে না।
অবশেষে গাছে গাছে কচি কচি সবুজ পাতা আর ফুলের কুঁড়ি নিয়ে আসে বসন্তকাল। মার্চ, এপ্রিল, মে—এই তিন মাসজুড়েই চলে ঋতুরানির অভিষেক। চারদিকে ফুলে ফুলে ভরে উঠতে শুরু করে। সবুজের জোয়ার আসে গাছে গাছে। প্রজাপতি রঙিন পাখা মেলে উড়ে বেড়ায়। বাতাসে রোমান্সের গন্ধ। ফুল পাখিদের মনেও অজানা পুলক। চারদিকে যেন জীবনের জাগরণ। সবাই মেতে ওঠে অনাবিল আনন্দে। গোমরামুখো মানুষটিও হেসে কথা বলে এই সময়।
এ সময় মহাসমারোহে শুরু হয় বাসন্তী আয়োজন ‘ফ্লাওয়ার উৎসব’। শীতের ধূসরতা, কনকনে ঠান্ডাকে বিদায় জানিয়ে সবাই মেতে উঠে যৌবনের রাগে, সৌন্দর্য দেবীর উপাসনায়। ম্যানহাটনের হ্যারল্ড স্কয়ারে ম্যাসিসের বার্ষিক ঐতিহাসিক ‘ফ্লাওয়ার শো’ দেখার মতো একটি নান্দনিক আয়োজন। রকফেলার প্লাজা হেসে উঠে টিউলিপের উচ্ছ্বাসে। ব্রঙ্কসের বোটানিকাল গার্ডেনে শুরু হয় অর্কিড শো। অন্যদিকে ব্রুকলিন বোটানিকাল গার্ডেনের ড্যাফোডিল হিলে তখন হলুদের সমারোহ। নিউইয়র্ক যেন মেতে ওঠে ফুলের উৎসবে, ফুলের রাজত্বে। ‘চেরি ব্লুসুম ফেস্টিভ্যাল’ হলো ব্রুকলিন বোটানিকাল গার্ডেনের বার্ষিক চেরি উৎসব।
গ্রীষ্ম এ দেশের সবারই খুব প্রিয় আর কাঙ্ক্ষিত ঋতু। জুন, জুলাই আর আগস্ট—এই তিন মাস জুড়েই চলে নিউ ইয়র্কবাসীর গ্রীষ্মের আনন্দ। মানুষগুলো শীতের তীব্রতায় যখন জবুথবু, চাতক পাখির মতো তখন তারা গ্রীষ্মের অপেক্ষায় থাকে। গ্রীষ্ম এলেই জড়তা কাটিয়ে গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে। রাস্তাঘাটে ফুরফুরে মেজাজে নারী-পুরুষ ঘুরে বেড়ায়, চোখেমুখে ঝকঝকে হাসি। শরীরে পোশাকের বাহুল্য নেই। তাপমাত্রার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পোশাক সংক্ষিপ্ত থেকে সংক্ষিপ্ততর থেকে থাকে। অপরিচিত মানুষও আগ বাড়িয়ে কথা বলে মনের আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয়। ‘ওয়াও! হোয়াট আ বিউটিফুল ডে। এনজয় ইউরসেলফ।’ উত্তরে বলতে হয়, ‘ইয়াহ, ইট্স রিয়েলি বিউটিফুল! হ্যাভ ফান।’ লোকজন দল বেঁধে পরিবার বা বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে সমুদ্র সৈকতে ছোটে। উদোম গায়ে বালির ওপর শুয়ে থাকে। সাগরের লোনা পানিতে ঝাঁপাঝাঁপি করে। কনি আইল্যান্ড, রবার্ট মোসেস স্টেট পার্ক বিচ, লং আইল্যান্ড বিচ, স্যান্ডিহুক বিচ, অর্চাড বিচ, ব্রাইটন বিচ, ফায়ার আইল্যান্ড বিচ, শেল্টার আইল্যান্ড বিচ, রকওয়ে বিচ, ক্রাবমিডো বিচ, ম্যানহাটন বিচ, চিডার গ্রোভ বিচ, সাউথ বিচ, জ্যাকব রিস অ্যান্ড ফোর্ড, লংবিচ, ইস্ট হ্যাম্পটন বিচ এবং মনটাক। আরও কত যে ছোটখাটো সৈকত আছে তার ইয়ত্তা নেই। সাগর যেন দুই বাহু বাড়িয়ে জলকে যাওয়ার ডাক দিতে থাকে।
এবার আসি পার্কের কথায়। দ্য হাই লাইন পার্ক, দ্য ইউনিয়ন স্কয়ার পার্ক, ম্যাডিসন স্কয়ার পার্ক, ওয়াশিংটন স্কয়ার পার্ক, সেন্ট্রাল পার্ক, গ্রিলি স্কয়ার পার্ক, পাম্প হাউস পার্ক, ব্রায়ান পার্ক, ফ্লাশিং মেডোস করনা পার্ক, প্রসপেক্ট পার্ক, গভর্নর আইল্যান্ড ইত্যাদি। গ্রীষ্ম এলেই সিটির এসব পার্ক সবুজে সবুজে ঢেকে যায়। ফুলে ফুলে সুরভিত হয়ে ওঠে বাতাস। মৌ মৌ গন্ধে উড়ে বেড়ায় নানা রঙের প্রজাপতি, মৌমাছি আর ভ্রমরের দল। প্রজাপতির মতোই মানুষের মনও পাখনা মেলে। ভালোবাসা ছডায়।
আরও একটা মজার ব্যাপার হলো বারবিকিউ, বনভোজন আর ক্যাম্পিং। গাড়ি নিয়ে সবাই চলে যায় বন, লেক বা সাগর পাড়ের পিকনিক স্পটগুলোয়। সেখানে আগুনে ঝলসানো হটডগ বা চিকেনের সুস্বাদু মাংস পোড়া গন্ধ আসে নাকে। কাজ পাগল মানুষ আনন্দে মেতে ওঠে। কিছুক্ষণের জন্য ভুলে যায় জীবনের জটিল হিসাব-নিকাশ। আমাকে সবচেয়ে বিস্মিত আর অভিভূত করে ক্যাম্পিং। লোকজন ২/৩ দিনের জন্য দূর-দূরান্তে ক্যাম্পিং করতে যায়। পাহাড়, জঙ্গল বা লেকের ধারে তাঁবু খাঁটিয়ে অস্থায়ী ঘর বানিয়ে বসতি গড়ে তোলে। সঙ্গে থাকে শুকনো খাবার, পানি, দেশলাই, ক্যান্ডেল, ফ্লাশ লাইট আর টুকটাক কিছু ফাস্ট এইডের ওষুধপত্র। তারপর তারা সারা দিন বনবাদাড়ে ঘুরে বেড়ায়। গাছের ডালপালা সংগ্রহ করে। লেকে মাছ ধরে। খুব ভাগ্য ভালো হলে বনমোরগ শিকার করে। তারপর সারা দিনের জোগাড় করা লাকড়ি পুড়িয়ে আগুন জ্বেলে, তাতে সংগ্রহ করা মাছ, বনমোরগ বা আলু পুড়িয়ে খায়। অবশ্য সে খাবারের স্বাদ হয় অমৃতের মতো। ২/৩ দিন ক্যাম্পিংয়ের পর তারা ঝডো কাকের মতো চেহারা, খড়ি ওঠা, রোদে পোড়া চামড়া, উসকো-খুশকো চুল নিয়ে আবার প্রাত্যহিক জীবনে ফিরে আসে। আবার ডুবে যায় কাজে।
আমিও অন্য সব নিউইয়র্কারের মতোই সারা বছর অলিগলিতে ঘুরে বেড়াই। উপভোগ করি নানা ঋতুর, নানা রূপের নিউইয়র্ককে। নতুন নতুন রাস্তা, নতুন নতুন দোকানপাট আর বাড়িঘর আবিষ্কার করি ঘুরে ঘুরে। ম্যানহাটন, কুইন্স, ব্রুকলিন, ব্রঙ্কস, স্ট্যাটেন আইল্যান্ড পর্যন্ত আমার নিজের শহরের মতোই চেনা হয়ে গেছে। এই বোহেমিয়ান নগর আমাকেও ধীরে ধীরে বোহেমিয়ান করে তুলেছে। আমার যেন এক নতুন জন্ম হয়েছে এই দেশে। আমি নিউইয়র্ক শহরের প্রেমে পড়ে গেছি। ভালোবাসি এর সকাল, দুপুর আর রাতকে। ভালোবাসি এর প্রকৃতির লীলাখেলাকে। এত চেনা শহর, তবুও মনে হয় কত অচেনা। রহস্যময়ী, লাস্যময়ী নগরের তীব্র আকর্ষণ আমাকে আজও নতুনের মতোই কৌতূহলী করে তোলে। সত্যি নিউইয়র্ক এক অদ্ভুত শহর, যা কাউকে মন খারাপ করতে বা একা থাকতে দেয় না। সবাইকেই আপন করে নেয়। তাই হয়তো আমারও মন থেকে থেকে বলতে শুরু করেছে, ‘নিউইয়র্ক ইজ মাই সিটি। আই রিয়েলি বিলং হিয়ার’।
(এই লেখায় মাইকেল স্টরিংসের নিউইয়র্ক ইন ফোর সিসন্স বই থেকে তথ্য নেওয়া হয়েছে)