জর্জ আর মোবারকের কমলা-সন্ধ্যা

প্রেসিডেন্ট পদে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী বাছাই বিতর্কে হিউস্টনে জো বাইডেন ও কমলা হ্যারিস। ছবি: রয়টার্স ফাইল ছবি
প্রেসিডেন্ট পদে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী বাছাই বিতর্কে হিউস্টনে জো বাইডেন ও কমলা হ্যারিস। ছবি: রয়টার্স ফাইল ছবি

যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে গেছে। সিনেটর কমলা হ্যারিস ডেমোক্রেটিক পার্টির ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে লড়ছেন। আমেরিকার এমন কোনো শীর্ষ পদের জন্য কমলা হ্যারিসের মনোনয়ন সংবাদের সঙ্গে উচ্চারিত হচ্ছে দক্ষিণ এশীয়দের নাম। যুক্তরাষ্ট্রের উদারপন্থী জনগণ জো বাইডেনের এ পছন্দকে বেশ ভালোভাবেই নিতে দেখা গেছে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায়। বলা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের বিভক্ত রাজনীতিতে এশীয়রা একটি শক্তি হয়ে উঠেছে। কৃষ্ণাঙ্গ ও ভারতীয় মিশ্রণের কমলা হ্যারিসের মনোনয়নের মধ্য দিয়ে জো বাইডেন কৃষ্ণাঙ্গদের সমর্থন পাবেন। পাবেন ভারতীয়দেরও সমর্থন।

বয়সে প্রবীণ শ্বেতাঙ্গ জর্জ একিনসের প্রাথমিক বিশ্লেষণ এমনটাই। জর্জ জানেন না, দক্ষিণ এশীয়দের রাজনৈতিক বিভাজনের চালচিত্র। সাধারণ আমেরিকান হিসেবে তাঁর কোনো ধারণাই নেই দক্ষিণ এশীয় মানুষের মনোজগতের। সারা জীবন আমেরিকার কালো লোকজনকেও জানার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন, কথাটি প্রায়ই বলে থাকেন।

আমেরিকার প্রান্তিক নগরীতে জীবন কাটিয়ে দেওয়া জর্জ জীবদ্দশায় একজন কৃষ্ণাঙ্গ লোকের প্রেসিডেন্ট হওয়া দেখেছেন। বারাক ওবামা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে উল্লাসও করেছিলেন। বলেছিলেন, আমেরিকা যে একটা উদার সর্ব বর্ণের জনারণ্যের দেশ, তা প্রমাণিত হয়েছে। একটা জাতি সভ্যতার বেশ ভালো অবস্থানে পৌঁছানোর লক্ষণ এটি। হিলারি ক্লিনটনের মাধ্যমে একজন নারীর প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়াটাও দেখে যাবেন, এমন প্রত্যাশাও ছিল তাঁর।

ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে জর্জ অখুশি হয়েছিলেন, এমন দেখা যায়নি। যদিও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নানা কর্মকাণ্ডে গত চার বছর তাঁকে বিরক্ত হতে দেখা গেছে। মাঝেমধ্যে বলেন, এই লোকটা রাজনীতি থেকে আসেনি। ফলে মুখে যা আসে, তা–ই বলে ফেলে। আমেরিকার স্বার্থে লোকটা বেপরোয়া। ট্রাম্পের প্রতি একটা গোপন সমর্থনের আভাস পাওয়া যায় তাঁর কথাবার্তায়।

সাম্প্রতিক সময়ে মহামারি সামাল দেওয়া এবং অর্থনৈতিক দুরবস্থা নিয়ে জর্জকে বিরক্ত মনে হয়েছে। আমেরিকান লোকজন রাজনীতি নিয়ে প্রকাশ্য কথাবার্তা এড়িয়ে চলে। এর মধ্যেও জর্জ বন্ধুদের আড্ডায় জো বাইডেনকে পছন্দ কথা জানিয়েছেন। আমেরিকায় কোনো দলের সঙ্গে তালিকাভুক্ত ভোটার নন জর্জ। তাঁর মিসরীয় বন্ধু মোবারক মনে করেন, এবার জর্জ ডেমোক্র্যাটদের পক্ষেই ঝুঁকে আছেন। কমলা হ্যারিসের মনোনয়ন ঘোষণার পর দুই বন্ধু তাৎক্ষণিক উল্লাস প্রকাশ করেন। জর্জ অবশ্য টিপ্পনী কাটতে ভোলেন না।

—মোবারক, তুমি তো এমনিতেই পাঁড় ডেমোক্র্যাট। ট্রাম্পকে টেনেহিঁচড়ে হোয়াইট হাউস থেকে বের করতে পারলেই তুমি আনন্দ পাবে। তোমার কথা বাদ দাও। আমাদের অন্য বন্ধুদের খবর কী?

ব্রায়ানের প্রতিক্রিয়া জানতে চান জর্জ।

ব্রায়ান ওয়াকার তাঁদের কৃষ্ণাঙ্গ সহকর্মী। মোবারকই জানালেন, ব্রায়ান কমলা হ্যারিসের মনোনয়নে খুশি নন। তরুণ ব্রায়ান জো বাইডেনকেই পছন্দ করেন না। সাম্প্রতিক নাগরিক আন্দোলনের সমর্থক ব্রায়ান অতি উদারপন্থী। ডেমোক্রেটিক পার্টির তরুণ নেতা আলেকজান্ডার ওকাসিওর সমর্থক। বার্নি স্যান্ডার্সের সমর্থক। ব্রায়ান মনে করেন, পুলিশই থাকা উচিত নয়। লুটপাট করে যারা বাজার অর্থনীতির স্থাপনাগুলো গড়ে তুলেছে, তাদের সম্পদ লুটপাটের প্রতি তাঁর প্রচ্ছন্ন সমর্থন রয়েছে। ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলনের ব্রায়ান মনে করেন, পুলিশ ছাড়াই নগরীগুলো চালু থাক। জানিয়েছেন, তিনি উত্তেজিত নন কমলা হ্যারিসের মনোনয়নে। নিজে ভোটকেন্দ্রেই যাবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন।

মিটমিট হাসছেন জর্জ। মোবারককে বললেন, তোমার দক্ষিণ এশীয় বন্ধুদের প্রতিক্রিয়া কী?

মোবারক জানান, তাঁর পাকিস্তানি বন্ধু মাসুদ মির্জা জানিয়েছেন, ভারতীয় বংশোদ্ভূত কমলা হ্যারিসের মনোনয়নে তিনিও উত্তেজিত নন। নির্বাচনে পাস করলে ভারতীয়দের নিয়ে এসে চাকরির বাজার ভরে ফেলবেন কমলা। তা ছাড়া জো বাইডেন বয়স্ক মানুষ। নির্বাচিত হলে কমলা হ্যারিসই কার্যত দেশ চালাবেন জো বাইডেনের নামে। ফলে একজন পাকিস্তানি হিসেবে তিনি সমর্থন করতে পারেন না, সাফ জানিয়ে দিয়েছেন।

মোবারকের ভারতীয় বন্ধু অবিনাশ প্যাটেল জানিয়েছেন, তিনি ট্রাম্পের সমর্থক। ভারতের বর্তমান সরকারের খাঁটি বন্ধু ট্রাম্প। তা ছাড়া মুসলমান জঙ্গিদের ব্যাপারে ট্রাম্পের অবস্থান স্পষ্ট। ফলে তাঁর পক্ষে কোনো অবস্থায় বাইডেনের সমর্থন করার কোনো কারণ নেই। কমলা হ্যারিসের কারণেও নয়।

জর্জ মিটমিট করে হাসছেন। প্রান্তিক নগরীতে গ্রীষ্মের উষ্ণ আবহাওয়ায় রেস্টুরেন্টের বাইরের ছাউনিতে বসে শূন্য গ্লাসটি আবার পূর্ণ করলেন। জিজ্ঞেস করলেন, তোমার বাংলাদেশি বন্ধুদের অবস্থান কী?

মোবারক জানালেন, বাংলাদেশিরা নিজেদের সমিতি আর দেশের রাজনৈতিক দলের দলাদলি নিয়ে ব্যস্ত। আমেরিকার নির্বাচন নিয়ে তাদের তেমন কোনো ভাবনা আছে বলে মনে হয় না। ট্রাম্প বেকার ভাতা দিচ্ছেন, ফুড স্টাম্প দিচ্ছেন, আরও সরকারি সাহায্য পাওয়ার আশায় আছে তাদের অনেকেই। এর মধ্যে ভারতীয় কমলা হ্যারিস নিয়ে উত্তেজিত কাউকে পাওয়া যায়নি বলে মোবারক জানালেন। কেউ কেউ পাকিস্তানি বন্ধু মাসুদ মির্জার মতোই কথা বলেছেন। কেউ বলেছেন ভারতীয় অবিনাশ প্যাটেলের মতোই।

ভারতীয়রা কমলা হ্যারিসের পক্ষে নেই ট্রাম্পের প্রতি ভালোবাসার কারণে। পাকিস্তানিরাও নেই ভারত বিরোধিতার কারণে। বাংলাদেশিদের মধ্যেও উচ্ছ্বাস নেই নানাজনের নিজ নিজ অবস্থানের কারণে।

জর্জ মাথা দোলাচ্ছেন। হাতে চশমা নিয়ে টেবিলে থাকা ন্যাপকিন নিয়ে মুছলেন। মোছার পর চশমার কাচ আরও ঝাপসা লাগছে বলে খুলে ফেললেন।

বিমর্ষ মোবারক বলেন, জর্জ, তোমার নিজের কথা বলো। তোমার পাশের বাড়ির মেরির কথা একটু জেনে নাও।

জর্জ ফোন করেন মেরিকে।

মোবারক টিপ্পনী কাটেন।

এই সুযোগে আবার প্রেমের কথা শুরু করে দিয়ো না জর্জ! ঘরে সুন্দরী অল্প বয়সী স্ত্রী নাতালিয়াকে রেখে সুযোগ পেলেই কী করো, তা আমার জানা আছে!

জর্জ কথা সংক্ষিপ্তই করেন। ফোন রেখে দিয়ে বলেন, মেরি ভালো কথা বলেছে। মেরি বলেছে, প্রার্থী হিসেবে কমলা হ্যারিস খুবই যোগ্য। একজন নারী হিসেবে এ মনোনয়নে মেরি খুশি। আমেরিকা এখনো কোনো নারীকে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেখার জন্য প্রস্তুত কি না, এ নিয়ে সে সন্দেহের কথা জানিয়েছে।

বিমর্ষ মোবারকের প্রশ্ন, তাহলে কী দাঁড়াল?

কিছুই দাঁড়ায়নি, মোবারক। আসছে দুই মাসে ডোনাল্ড ট্রাম্প কতটা খারাপ করেন ঝুঁকিপূর্ণ রাজ্যগুলোয়, তার ওপরই সব নির্ভর করবে। তাই বলে কমলা হ্যারিসের মনোনয়ন নিয়ে তোমার উত্তেজিত না হওয়ার কোনো কারণও দেখছি না। আমিও উত্তেজিত, মোবারক।

চলো, চিয়ার্স করি বন্ধু!

মোবারক বেশ দুর্বল কণ্ঠেই উচ্চারণ করলেন, চিয়ার্স!