ট্রাম্প-বাইডেন কথার লড়াই

ডোনাল্ড ট্রাম্প ও জো বাইডেন
ছবি: রয়টার্স

যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচন নিয়ে বড় কোনো হইচই নেই। কোভিড-১৯ রোগে ছয় মাসে প্রায় দুই লাখ মানুষ মারা গেছেন। করোনার সংক্রমণের মধ্যেই নির্বাচনের তোড়জোড় চলছে।  
এবারের নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রের নির্দিষ্ট এলাকা ঘিরে প্রচার চলছে। টিভি, রেডিও, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আর টেলিফোনের প্রচারই বেশি। ঘরের সামনে প্রার্থীর পোস্টার কমই ঝুলতে দেখা যায়। ডাকযোগে আসছে নির্বাচনী প্রচারবিষয়ক পোস্টার। ট্রাম্প বা বাইডেনকে ভোট দেওয়ার আহ্বানও জানাচ্ছে না কেউ।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সংবাদমাধ্যমে নির্বাচনী প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেনও জোরালোভাবে নির্বাচনী প্রচার চালাচ্ছেন। ডেমোক্রেটিক পার্টি অবশ্য ভাবছে না, ট্রাম্পের খারাপ আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের লোকজন বাইডেনকে নির্বাচিত করবেন। বাইডেন নিজের অর্থনৈতিক পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করছেন। বলছেন, ‘মেড ইন আমেরিকা’ বলে ট্রাম্প শুধুই ফাঁকা বুলি ছাড়ছেন। নির্বাচিত হলে আমেরিকার কোম্পানিগুলোর স্বার্থরক্ষার বিষয়ে করণীয় নীতিমালা ঘোষণা করেছেন তিনি।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজের তৈরি সমস্যায় ঘুরপাক খাচ্ছেন। আগের সপ্তাহে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ওপর চোট গেছে যুদ্ধে নিহত আমেরিকার সৈনিকদের বিদ্রূপ করার জন্য। ‘ফেক মিডিয়ার’ সংবাদ বলে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হলেও এখনো এ নিয়ে তিনি তোপের মুখে। এর মধ্যে আমেরিকার প্রখ্যাত সাংবাদিক বব উডওয়ার্ডের সঙ্গে গত ফেব্রুয়ারির কথোপকথন নিয়ে আবার বেশ ফেঁসে গেছেন ট্রাম্প। এই কথোপকথনের অডিও রেকর্ডিং থাকায় এবার আর ফেক নিউজ বলছেন না। ভিন্নভাবে সামাল দেওয়ার কসরত করছেন ট্রাম্প। ডোনাল্ড ট্রাম্পের এমন লেজেগোবরে অবস্থায়ও তাঁর সমর্থকদের মধ্যে উদ্দীপনার কোনো ঘাটতি নেই। মনে করার কোনো কারণ নেই, এসব কারণে নির্বাচনে হেরে যাবেন ট্রাম্প।

যুক্তরাষ্ট্রের তালিকাভুক্ত ভোটারদের মধ্যে স্বতন্ত্র তালিকাভুক্ত ভোটারদের সংখ্যা ২৯ ভাগেরও কিছু বেশি। এ স্বতন্ত্র ভোটারই প্রার্থীদের জয়-পরাজয়ের নির্ধারণী শক্তি।

যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নির্বাচন যেমন খুব সোজা, তেমনি জটিলও বটে। জনমিশ্রণের কারণেই হোক আর ঐতিহাসিক কারণেই হোক, নির্বাচনে কোন অঙ্গরাজ্যে কে জয়ী হবেন, তা অনেকটাই আগাম বলা যায়। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্রের রাজ্যগুলোর মধ্যে ডেমোক্র্যাট রাজ্য, রিপাবলিকান রাজ্য বেশ ভালোভাবেই চিহ্নিত।

নিউইয়র্ক ও ক্যালিফোর্নিয়ার মতো জনবহুল অঙ্গরাজ্যে ডেমোক্র্যাট প্রার্থীর জয় অবধারিত। এসব অঙ্গরাজ্যে দলীয়ভাবে ভোটার তালিকাভুক্তিতেও নির্বাচনের ফলাফল অনুমান করা যায়। বেশির ভাগ ভোটার নিজেকে তালিকাভুক্ত করার সময়ই দলের পরিচয় চিহ্নিত করতে পারেন। বেশির ভাগ ভোটার ডেমোক্র্যাট বা রিপাবলিকান হিসেবে তালিকাভুক্তি ফরমে নিজেদের চিহ্নিত করে রাখেন। বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে ভোটার তালিকাভুক্তির নিয়মও ভিন্ন ভিন্ন। নিজেকে স্বতন্ত্র ভোটার হিসেবেও তালিকাভুক্ত করা যায়। তালিকাভুক্তির পরও দল পরিবর্তনের কথা জানানো যায় এবং সে অনুযায়ী রেকর্ড করা হয়।

সারা দেশের তালিকাভুক্ত ভোটারদের মধ্যে ডেমোক্রেটিক পার্টির তালিকাভুক্তি বেশি। মোট তালিকাভুক্ত ভোটারের প্রায় ৪০ শতাংশ ডেমোক্র্যাট। রিপাবলিকান পার্টির তালিকাভুক্ত মোট ভোটারের প্রায় ২৯ শতাংশ। এবারই প্রথমবারের মতো দেখা যাচ্ছে ,আমেরিকায় স্বতন্ত্র তালিকাভুক্ত ভোটারদের সংখ্যাও ২৯ ভাগেরও কিছু বেশি। জাতীয়ভাবে এ স্বতন্ত্র ভোটারই নির্বাচনে প্রার্থীদের জয়-পরাজয়ের নির্ধারণী শক্তি।
যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে ইলেকটোরাল কলেজের ব্যাপারটি এখন অনেকেরই জানা হয়ে গেছে। জনবসতি অনুযায়ী অঙ্গরাজ্য অনুযায়ী ইলেকটোরেল ভোটের সংখ্যা ভিন্ন ভিন্ন। ফলে অঙ্গরাজ্যগুলো লক্ষ্য করেই প্রার্থীরা তাঁদের নির্বাচনী প্রচার পরিচালনা করে থাকেন। কোনো কোনো রাজ্য কখনো ডেমোক্রেটিক পার্টির পক্ষে ভোট দেয়, কখনো রিপাবলিকান দলের পক্ষে। তালিকাভুক্ত ভোটাররা আবার ভোটকেন্দ্রে যাবেনই বা ডাকযোগে ভোট দেবেন, এমন নিশ্চয়তা নেই।

২০১৬ সালের নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্য পেনসিলভানিয়াতে প্রায় ১ শতাংশ ভোটের ব্যবধানে রিপাবলিকান প্রার্থী ট্রাম্প জয়লাভ করেন। অথচ এ অঙ্গরাজ্যে রিপাবলিকান থেকে প্রায় সাড়ে ৭ লাখ বেশি তালিকাভুক্ত ভোটার ডেমোক্র্যাটদের। ফলাফল দেখে পরিষ্কার বলা যায়, তালিকাভুক্ত ডেমোক্র্যাট হয়েও এসব লোকজন ডেমোক্র্যাট প্রার্থীকে ভোট দিতে কেন্দ্রে যাননি।

জাতীয় নির্বাচন নিয়ে আমেরিকার আগ্রহ থাকলেও নির্বাচনী প্রচার চলছে কয়েকটি অঙ্গরাজ্য ঘিরে। অ্যারিজোনা, ফ্লোরিডা, নর্থ ক্যারোলাইনা, ওহাইও, পেনসিলভানিয়া এবং উইসকনসিন অঙ্গরাজ্যজুড়ে প্রচার দেখলেই টের পাওয়া যায় আমেরিকার এবারের নির্বাচনে এসব রাজ্য কতটা গুরুত্বের। জনমত জরিপে বাইডেন জাতীয়ভাবে এগিয়ে থাকলেও এসব রাজ্যে দুই প্রার্থীর অবস্থানের ব্যবধান এখন খুব অল্প। তালিকাভুক্ত ডেমোক্র্যাটদের কেন্দ্রে উপস্থিত না করাতে পারলে বা ডাকযোগে ভোট প্রদান নিশ্চিত না করতে পারলে ডেমোক্র্যাট দলকে এই দফাতেও হোয়াইট হাউসের বাইরে অবস্থান করতে হবে বলে মনে করা হচ্ছে।

করোনা মহামারির কারণে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রচার জুলাই মাস পর্যন্ত বেশ নিয়ন্ত্রিত ছিল। এ সময়টিতে ট্রাম্পের প্রচার শিবির বসে থাকেনি। পেনসিলভানিয়ার উদাহরণ দিলেই দেখা যাবে, প্রচার ও নির্বাচনী কৌশলে অনেকটা পিছিয়ে আছে ডেমোক্রেটিক পার্টি।

২০১৬ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে পেনসিলভানিয়াতে প্রায় দুই লাখ নতুন রিপাবলিকান ভোটার তালিকাভুক্ত হয়েছেন। একই সময়ে ডেমোক্র্যাটদের তালিকায় মাত্র ২৯ হাজার ভোটারের তালিকা বৃদ্ধি ঘটেছে। মহামারির লকডাউনের সময় ডেমোক্র্যাটদের প্রচারে ছিল ভার্চ্যুয়াল সভা-সমাবেশ। ট্রাম্পের সমর্থকেরা এসবের পরোয়া না করেই দরজায় দরজায় কড়া নেড়েছেন। প্রতিযোগিতাপূর্ণ অঙ্গরাজ্যগুলোকে টার্গেট করে তাঁরা গির্জার বাইরে ভোটার তালিকাভুক্তির প্রচার চালিয়েছেন। এসব ভোটার তালিকাভুক্তির জন্য নির্বাচনী কর্মীদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তালিকাভুক্ত ভোটারদের দলীয় পরিচয় পাল্টানোর নিয়ম-পদ্ধতি নিয়ে রিপাবলিকান শিবির থেকে চেষ্টা চলছে।

নির্বাচনী প্রচারে এগিয়ে আছেন ট্রাম্প। তবে তিনি সর্বশেষ ধরা খেয়েছেন বব উডওয়ার্ডের সঙ্গে তাঁর কথোপকথন নিয়ে। ‘রেইজ’ নামের একটি বই লিখছেন উডওয়ার্ড। আমেরিকার প্রখ্যাত এই সাংবাদিক সাবেক প্রেসিডেন্টদের নিয়েও এমন বই লিখেছেন। ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে এ বইয়ের অনেক বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন উডওয়ার্ড। ট্রাম্পের অনুমতি নিয়েই এসব কথাবার্তা তিনি রেকর্ড করেছেন।
করোনায় বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর দেশ আমেরিকা। এ নিয়েই ট্রাম্পের ভাবমূর্তি সমালোচনার মুখে পড়েছে।

ডেমোক্রেটিক দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী জো বাইডেন বলেন, ট্রাম্প করোনা মোকাবিলায় ব্যর্থ। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ‘চায়না চায়না’ করে মাঠ গরম করছেন। বলছেন, আমেরিকার স্বার্থরক্ষার জন্য উৎপাদিত পণ্যকে সেরা করে তুলবেন। বাইডেন বলেন, বাস্তবে এসব কথার কোনো প্রতিফলন নেই। এখনো বাইরের দেশের উৎপাদনের সঙ্গে মার খাচ্ছে আমেরিকার পণ্য। চার বছরে এ নিয়ে দৃশ্যমান কিছুই করতে পারেননি ট্রাম্প।