ট্রাম্পের আহ্বানে ক্যাপিটলে সহিংসতার নতুন তথ্য

ডোনাল্ড ট্রাম্পের হাজারো উগ্র সমর্থকের হামলায় ৬ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাপিটল হিল পরিণত হয়েছিল আতঙ্কের কেন্দ্রে
ছবি: রয়টার্স

ওয়াশিংটন ডিসির পুলিশপ্রধানের বর্ণনায় ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল হিলে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থকদের সহিংসতা প্রতিরোধে প্রস্তুতির ঘাটতির চিত্র বেরিয়ে আসছে। ঘটনার জের ধরে পাঁচজনের মৃত্যু ছাড়াও দুই পুলিশ কর্মকর্তার আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। ট্রাম্প–সমর্থকদের সহিংসতা ও লুটপাট নিয়ন্ত্রণে আনতে সেনাসদস্যদের বিলম্বে সাড়া দেওয়া নিয়েও কথা উঠেছে।

ওয়াশিংটন ডিসি মেট্রোপলিটন পুলিশের ভারপ্রাপ্ত প্রধান রবার্ট জে কনটি কংগ্রেসের প্রতিনিধি পরিষদের এক শুনানিতে গত মঙ্গলবার দুই পুলিশ সদস্যের আত্মহত্যার তথ্য দিয়েছেন। সহিংসতা প্রতিরোধে ক্যাপিটল হিলে ন্যাশনাল গার্ডের বিলম্বে উপস্থিতি নিয়েও কথা বলেছেন তিনি।

প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত ছিল, পরিস্থিতির ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখা ও সম্ভব হলে সেনাসদস্যদের উপস্থিতি এড়িয়ে চলার। ফলে ট্রাম্প–সমর্থকদের বেপরোয়া আচরণকালে পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। তাই শুরুতে সীমিত প্রস্তুতি নিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হয় ক্যাপিটল পুলিশকে। দ্রুত মেট্রোপলিটন পুলিশের উপস্থিতি ঘটে। পরে ন্যাশনাল গার্ড পরিস্থিতি সামাল দিতে সক্রিয় হয়।

৬ জানুয়ারির ঘটনায় ৬৫ পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। এর মধ্যে গুরুতর আহত হননি এমন সদস্যদের ধরা হয়নি। ৬ জানুয়ারি বেলা ১টার কিছু আগে ক্যাপিটল পুলিশের পক্ষ থেকে জরুরি সাহায্য চেয়ে তাঁদের কাছে বার্তা পাঠানো হয়। ততক্ষণে সহিংসতায় জড়িতরা ক্যাপিটল হিলে প্রবেশ করতে শুরু করেন।

ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছিলেন, তিনি নিজেই ন্যাশনাল গার্ডকে সক্রিয় করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। যদিও মার্কিন সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছিল, কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে সভাপতিত্ব করা ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স ন্যাশনাল গার্ডকে সক্রিয় করার প্রথম নির্দেশ দেন।

ওয়াশিংটনে জড়ো হওয়া সমর্থকদের উদ্দেশে ট্রাম্প উসকানিমূলক বক্তৃতা দিয়েছেন। একই সময় ট্রাম্পের আইনজীবী রুডি জুলিয়ানিও বক্তব্য দেন। ট্রাম্প তাঁর বক্তৃতায় নির্বাচন চুরি হয়ে গেছে বলে সমর্থকদের উসকানি দেন এবং ক্যাপিটল হিলে যেতে সমর্থকদের আহ্বান জানান।

আহ্বানে সাড়া দিয়ে তাণ্ডবকারীরা ট্রাম্পের পক্ষে স্লোগান দিতে দিতে ক্যাপিটলে প্রবেশ করেন। প্রাথমিক ধাক্কায়ই পুলিশের বেশ কিছু সদস্য আক্রমণের শিকার হন। ঘটনার পরদিন আহত এক পুলিশ কর্মকর্তা মারা যান।

রবার্ট কনটি জানিয়েছেন, সহিংসতার দিন প্রথমে ক্যাপিটলের নিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশের সঙ্গে মেট্রোপলিটন পুলিশের প্রায় ৮৫০ জন সদস্য মোতায়ান করা হয়। পরে আরও ২৫০ জনকে যুক্ত করা হয়। ৬ জানুয়ারির সহিংসতার সপ্তাহে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি মোকাবিলায় মেট্রোপলিটন পুলিশ প্রায় ৮৮ লাখ ডলার খরচ করেছে বলে জানান তিনি।

রবার্ট কনটি জানান, হামলার ঘটনায় এক পুলিশ সদস্যসহ পাঁচজন নিহত হওয়া ছাড়াও ঘটনার জের ধরে দুই পুলিশ কর্মকর্তা জ্যাফরি স্মিথ ও হাওয়ার্ড লাইবেনগুড আত্মহত্যা করেছেন। তাঁরা মেট্রোপলিটন পুলিশ ও ক্যাপিটল হিল পুলিশের সদস্য। ট্রাম্প–সমর্থকদের সরাসরি আক্রমণে ব্রায়ান সিকনিকসহ নিহত তিন পুলিশ কর্মকর্তার প্রতি শ্রদ্ধা ও তাঁদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান কনটি।

প্রতিনিধি পরিষদে দেওয়া বক্তব্যে রবার্ট কনটি জানান, ৬ জানুয়ারির ঘটনায় ৬৫ পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। এর মধ্যে গুরুতর আহত হননি এমন সদস্যদের ধরা হয়নি। তিনি জানান, ৬ জানুয়ারি বেলা ১টার কিছু আগে ক্যাপিটল পুলিশের পক্ষ থেকে জরুরি সাহায্য চেয়ে তাঁদের কাছে বার্তা পাঠানো হয়। ততক্ষণে সহিংসতায় জড়িতরা ক্যাপিটল হিলে প্রবেশ করতে শুরু করেন। বেলা ২টা ২২ মিনিটে ক্যাপিটল পুলিশ, সেনা কর্তৃপক্ষ ও তাঁরা পরবর্তী অবস্থা নিয়ে আলোচনা করেন। কনটি জানান, সেনা কর্তৃপক্ষ থেকে ন্যাশনাল গার্ডকে দ্রুত সক্রিয় করতে উদাসীনতা দেখানোয় তিনি বিস্মিত হয়েছেন। সেনাবাহিনী থেকে বলা হচ্ছিল, তারা ক্যাপিটলে সেনা উপস্থিতি চাচ্ছে না। এ ছাড়া পরের পদক্ষেপ কী হবে, তা-ও জানতে চাওয়া হচ্ছিল।

বেলা আড়াইটার দিকে ওয়াশিংটন ডিসি কর্তৃপক্ষ আশপাশের রাজ্য থেকে অতিরিক্ত পুলিশ পাঠানোর অনুরোধ জানায়। অনুরোধ করা হয় দূরের রাজ্য নিউ জার্সি থেকেও পুলিশ পাঠানোর। সন্ধ্যা ছয়টা থেকে ওয়াশিংটন ডিসিতে কারফিউ জারি করা হয়। তখন সহিংসতায় জড়িত লোকজনকে নগরী থেকে বেরিয়ে যেতে প্রায় ৩ ঘণ্টা সুযোগ দেওয়া হয়েছিল।

প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত ছিল, পরিস্থিতির ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখা ও সম্ভব হলে সেনাসদস্যদের উপস্থিতি এড়িয়ে চলার। ফলে ট্রাম্প–সমর্থকদের বেপরোয়া আচরণকালে পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। তাই শুরুতে সীমিত প্রস্তুতি নিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হয় ক্যাপিটল পুলিশকে।

কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে নভেম্বরের নির্বাচনে জো বাইডেনের জয়ের শেষ সাংবিধানিক প্রক্রিয়া নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন আইনপ্রণেতারা। ট্রাম্পের সমর্থক শতাধিক রিপাবলিকান আইনপ্রণেতা তখনো নির্বাচনের ফলাফল পাল্টে দেওয়ার সুযোগ নিয়ে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। ট্রাম্প–সমর্থকদের অতর্কিত হামলায় অধিবেশন স্থগিত করার তড়িঘড়ি নির্দেশ দেন সভাপতির আসনে বসে থাকা ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স।

ট্রাম্পের আহ্বানে নির্বাচনের ফলাফল পাল্টে দেওয়ার আহ্বানে সাড়া না দেওয়ায় মাইক পেন্সও ট্রাম্পের উগ্র সমর্থকদের তোপের মুখে ছিলেন। মাইক পেন্স, স্পিকার ন্যান্সি পেলোসিসহ আইনপ্রণেতাদের কেউ বাথরুমে, কেউ টেবিলের নিচে, কেউ বিভিন্ন কক্ষে লুকিয়ে আত্মরক্ষা করেন। হামলাকারীরা পেলোসি ও পেন্সকে খুঁজতে থাকেন। তাঁদের চেয়ার দখল ও অফিস লুটপাট করেন।

কংগ্রেসওম্যান আলেকজান্দ্রিয়া ওকাসিও, ইহলান ওমর, গ্রেস ম্যাংগসহ অনেকেই পরে বলেছেন, হামলার সময় লুকিয়ে থাকা অবস্থায়ও মৃত্যুভয় তাঁদের তাড়া করেছে। হামলাকারীদের হাতে প্রাণহানির আশঙ্কা করছিলেন এই আইনপ্রণেতারা।

যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ক্যাপিটল হিলে এমন হামলা আর কখনো ঘটেনি। এর জের ধরে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় দফা অভিশংসন প্রস্তাব গ্রহণ করেছে কংগ্রেস। মার্কিন সিনেটে এরই মধ্যে তাঁর অভিশংসন বিচার নিয়ে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

সহিংসতায় লন্ডভন্ড হওয়া ক্যাপিটল হিলে স্থগিত হওয়া অধিবেশন ৬ জানুয়ারি রাত ৮টার দিকে পুনরায় শুরু হয়েছিল। ঘটনায় ক্ষুব্ধ ও হতাশ আইনপ্রণেতাদের কণ্ঠে তখন সহিংসতার বিরুদ্ধে জোরালো উচ্চারণ। দেশের স্বার্থে ঐক্য ও সংহতির কথা বলেন উভয় দলের আইনপ্রণেতারা। তখনই ট্রাম্পের অপমানজনক ও নিন্দনীয় বিদায়ঘণ্টা বেজে ওঠে।

হামলা–সহিংসতার ঘটনার জের ধরে গোটা যুক্তরাষ্ট্রে এখনো ধরপাকড় চলছে। সহিংসতায় যোগ দেওয়া লোকজনকে ফোন ও সামাজিক যোগাযোগের নানা সূত্র ধরে চিহ্নিত করা হচ্ছে। এফবিআই বলেছে, যারাই সহিংসতায় জড়িত ছিল, তাদের প্রত্যেকের দরজায় কড়া নাড়া হবে। তাদের বিচার করার বিষয়টি নিশ্চিত করা হবে।