দুঃখ যেন সাগরের ঢেউয়ের মতো

মন খারাপ হয় না—এমন মানুষ নেই। মন খারাপ হলে আমরা দুঃখ পাই। আমাদের দুঃখগুলো জমা হয় মনের ব্যাংকে। অনেকে আবার কারণে কিংবা খেয়ালিপনা করে দুঃখ পুষে। দক্ষিণা বাতাস যেন চুপি চুপি বলে যায় দুঃখগুলো উড়িয়ে দাও। এভাবে দুঃখ পুষতে নেই। চার দেয়ালের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে দেখ সবুজ মাঠ, খোলা আকাশ। যেতে পার সাগর পারে। সাগরের বিশালতার দিকে তাকালে মন কোথায় যেন হারিয়ে যায়। দুঃখগুলো ঢাকা পড়ে যায়। সাগরের ঢেউগুলো যেমন পাড়ে এসে আছড়ে পড়ে তেমনি দুঃখগুলো আছড়ে পড়ে বুকের গহিনে। শব্দ তুলে যায়, বুকের ভেতর তোলপাড় হয়, কেউ দেখে না, কেউ জানে না, কেউ বুঝে না। এক তোলপাড় করা গর্জন হয়। একেকটা গর্জন বুকে আছড়ে পড়ে আবার মিলিয়ে যায় সাগরের ঢেউয়ের মতো।
অনেকে দুঃখ পেলে, কষ্ট পেলে সাগরের কাছে চলে যায়, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে সাগরের বিশালতা। খেয়ালি বাতাস দোলা দিয়ে ছুঁয়ে যায় মন। মানুষ দুঃখ ভুলে যায় মুহূর্তেই। কিংবা গোধূলি বেলায় লাল সূর্য ডোবার সময় জানান দিয়ে যায়, দেখ আমি ডুবে যাচ্ছি আবার
ফিরব বলে। ভুলে যাও জীবনের ক্ষোভ-দুঃখ। আবার শুরু কর নতুন করে নতুন ভোরের আশায়। দুঃখের সাগরে
ডুব দিয়ে আবার উঠে, আবার চলতে শুরু করে। সাগর
কি ধরে রেখেছে তার ঢেউগুলোকে? না পারেনি। মানুষের মন সাগরের মতো সেখানে দুঃখের ঝড় উঠে আবার মিলিয়ে যায়।
আমি নিজেও মাঝে মাঝে মন খারাপ হলে সাগর পাড়ে চলে যাই। বিকেলের ডুবন্ত সূর্যের লাল আভা দেখি। দেখি সাগরের ঢেউয়ের ওপর পড়ে লাল আভা চিক চিক করে। ঢেউগুলো ছুঁতে চাইলে মিলিয়ে যায়। এক অপূর্ব দৃশ্য। এ দৃশ্য দেখতে দেখতে মনে হয় পৃথিবীর কত সুন্দর, কত অজানা আমরা জানি না, দেখি না। প্রকৃতি আমাদের দুঃখ ভুলিয়ে দেয়।
সাগর পাড়ে গেলে দেখি, কত মানুষ, কত ভিড়, কেউ হাঁটু পানিতে নেমে খেলছে, কেউ সাঁতার কাটছে, কেউ বা পাড়ে বসে দেখছে সেই সব মানুষের দৃশ্য। কেউ এই কোলাহলের ভিড়েও নিজেকে একা ভাবছে। যে যাই করুক না কেন, একটা বিষয় লক্ষণীয় কোথায় যেন সবাই হারিয়ে যায়।
সামার এলেই সবাই ছুটে সাগর পাড়ে। যেন সারা বছর অপেক্ষায় থাকে কখন সামার আসবে। মনের তৃষ্ণা মেটাবে। মন, হা এক অদ্ভুত বৈচিত্র্য। মনেরও খোরাক আছে, কান্না আছে, দুঃখ আছে সেই মন আমাদের নিয়ে ছুটে চলে, আমরাও চলি তার হাত ধরে। মন ভালো তো আমরাও ভালো। সামারে রাস্তার দুপাশে পোশাকহীন দাঁড়িয়ে থাকা মৃত গাছগুলো সবুজ পাতা মেলে জানান দেয়, আমরা মরিনি, দেখ বেঁচে আছি। সবুজ পাতা আর ফুলে ফুলে যেন সাজিয়ে দেয় চারপাশ। যেন বলে যায়, তোমাদের ভালোবাসায় আমরা জেগে উঠেছি।
আজ আটলান্টিক সাগর পাড়ে যখন হাঁটছিলাম, কেন জানি গ্রামের সেই পদ্মদীঘির নিটোল পানিতে ভেসে থাকা শাপলা ফুলের কথা মনে পড়ছিল। দিঘিজুড়ে ছিল এক অদ্ভুত মায়াময় শাপলার সৌন্দর্য। দমকা বাতাসে ঢেউ খেলে ফুলগুলো দুলে উঠত লাজুক বউয়ের লজ্জা রাঙা হাসির মতো। অনেক দিন শাপলা ফুল দেখি না। সেই দিঘিটি আছে কিনা জানি না। তবে স্মৃতিগুলো রয়ে গেছে অম্লান হয়ে। এখানে পুকুর নেই, শাপলা নেই আছে সাগর। আছে সাগর পাড়ে ঝিনুক আর বালি। বালি কেমন যেন ছন্নছাড়া। পায়ের তলায় লাগলেও আটকে থাকে না। অনেকটা সম্পর্কের মতো, আমার স্পর্শ পাবে কিন্তু আমায় পাবে না। বালিরাও ঢেউয়ের স্পর্শে ভিজে আবার রোদের স্পর্শে শুকিয়ে যায়। যেন লুকোচুরি খেলা করে নিজের সঙ্গে নিজে। সাগরের মাতাল ঢেউ বালির ওপর আছড়ে পড়ে বালির মাঝে হারিয়ে যায়। আমাদের দুঃখগুলোও সাগরের ঢেউয়ের মতো, একের পর এক আসে বুকে আছড়ে পড়ে আবার হারিয়ে যায়।