নতুন স্নায়ুযুদ্ধ শুরুর আশঙ্কা

জাতিসংঘ
ছবি: রয়টার্স

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৬তম অধিবেশন সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনকে নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধ শুরুর ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছেন সংস্থাটির মহাসচিব। একই সঙ্গে বিশ্ব সংস্থার এই বার্ষিক সম্মেলন সামনে রেখে দেশ দুটিকে নিজেদের মধ্যকার ‘সম্পূর্ণ অকার্যকর’ সম্পর্ক মেরামতের পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। খবর আল–জাজিরার।

জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, ‘আমাদের যেকোনো মূল্যে স্নায়ুযুদ্ধ এড়াতে হবে। নতুন করে এ যুদ্ধ বাধলে তা হবে আগেরটি থেকে আলাদা। সম্ভবত তা হবে আরও বিপজ্জনক এবং সেটি থামানোও হবে বেশি কঠিন।’
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব এবং করোনা মহামারি মোকাবিলায় প্রচেষ্টা জোরদার করার লক্ষ্য নিয়ে চলতি সপ্তাহে নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে সমবেত হচ্ছেন বিশ্বনেতারা। এ সম্মেলনের আগে জাতিসংঘের মহাসচিব যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের উদ্দেশে এ সতর্কবার্তা উচ্চারণ করলেন।

অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসকে গত শনিবার দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে গুতেরেস আরও বলেন, বিশ্বের দুই প্রধান অর্থনৈতিক শক্তির (যুক্তরাষ্ট্র ও চীন) উচিত জলবায়ু নিয়ে সহযোগিতা করা এবং বাণিজ্য ও প্রযুক্তি নিয়ে দৃঢ়ভাবে সমঝোতায় উপনীত হওয়া। যদিও দুই দেশের মধ্যে মানবাধিকার, অর্থনীতি, অনলাইন নিরাপত্তা ও দক্ষিণ চীন সাগরে সার্বভৌমত্ব নিয়ে রাজনৈতিক বিবাদ আছে।

গুতেরেস বলেন, ‘দুঃখজনকভাবে, আমরা এখন শুধু বিবাদেই জড়িয়ে আছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘ওই দুই শক্তির মধ্যে একটা কার্যকর সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা দরকার।’
প্রসঙ্গত, ইতিপূর্বে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং এর পূর্ব–ব্লকের মিত্ররা যুক্তরাষ্ট্র ও এর পশ্চিমা মিত্রদের সঙ্গে তথাকথিত স্নায়ুযুদ্ধে জড়িয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটার পরপরই এ যুদ্ধ শুরু হয়। তা শেষ হয় ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার মধ্য দিয়ে। পরমাণু বোমার অধিকারী দুই পরাশক্তির আদর্শগত ওই লড়াইয়ের এক পাশে ছিল সমাজতন্ত্র ও কর্তৃত্ববাদী শাসন এবং অন্য পাশে পুঁজিবাদ ও গণতন্ত্র।

সম্প্রতি ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্য অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে একটি চুক্তি হয়েছে। এইউকেইউএস নামের এই চুক্তির অধীনে অস্ট্রেলিয়াকে পারমাণবিক সাবমেরিনের প্রযুক্তি সরবরাহ করবে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য।
ত্রিদেশীয় এই নিরাপত্তা চুক্তির আগে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ফ্রান্সের সাবমেরিন-সংশ্লিষ্ট একটি চুক্তি হয়েছিল। এই চুক্তি অস্ট্রেলিয়া বাতিল করেছে। এতে শতকোটি ইউরোর অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়েছে ফ্রান্স। এ কারণে ত্রিদেশীয় নিরাপত্তা চুক্তি নিয়ে ফ্রান্স ভীষণ ক্ষুব্ধ।

যুক্তরাষ্ট্র-চীনকে নিজেদের মধ্যকার ‘সম্পূর্ণ অকার্যকর’ সম্পর্ক মেরামতে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান আন্তোনিও গুতেরেসের। তিনি বলেছেন, নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধ বাধলে তা হবে আগেরটি থেকে আলাদা ও বিপজ্জনক, সেটি থামানোও হবে বেশি কঠিন।

তবে এইউকেইউএস নিয়ে ফ্রান্সের দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই বলে উল্লেখ করেছেন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘এই চুক্তি নিয়ে কারও চিন্তা করার কিছু নেই, বিশেষ করে আমাদের ফরাসি বন্ধুদের।’
আর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ঘোষণা দিয়েছেন, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার এই প্রতিরক্ষা চুক্তিকে ব্যাপকভাবে চীনের উত্থানকে প্রতিহত করার লক্ষ্য হিসেবেই দেখা যায়।

এ পরিস্থিতিতে উত্তর কোরিয়াও হুঁশিয়ার করে বলেছে, চুক্তিটি এই অঞ্চলে পরমাণু অস্ত্র প্রতিযোগিতার জন্ম দিতে পারে। ইতিমধ্যে ত্রিদেশীয় চুক্তির নিন্দা জানিয়ে চীন বলেছে, এই তিন দেশের জোট ‘অত্যন্ত দায়িত্বজ্ঞানহীন’ ও ‘ছোট মানসিকতার’। এটা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য অত্যন্ত দায়িত্বজ্ঞানহীন হুমকি।

চীনের ফরেন অ্যাফেয়ার্স ইউনিভার্সিটির সামরিক বিশেষজ্ঞ লি হাইদং বলেছেন, স্নায়ুযুদ্ধের সময় ইউরোপে রাশিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে যুক্তরাষ্ট্র যে পদ্ধতি নিয়েছিল, এবার এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনকে দমন করতে ঠিক একই কৌশল নেওয়া হয়েছে। এটি স্নায়ুযুদ্ধেরই মানসিকতা।

চীনের রাষ্ট্রীয় প্রকাশনা গ্লোবাল টাইমস অস্ট্রেলিয়াকে যুক্তরাষ্ট্রের ‘ঘুঁটি’ হিসেবে বর্ণনা করেছে। এর মধ্য দিয়ে অস্ট্রেলিয়া বিচার–বিবেচনাহীনভাবে যুক্তরাষ্ট্রের স্নায়ুযুদ্ধের বাজিতে অর্থ জোগানোর পথ বেছে নিয়েছে বলে উল্লেখ করেছে প্রকাশনাটি। এ ছাড়া অঞ্চলটিতে সামরিক মহড়া হলে অস্ট্রেলিয়া সবচেয়ে বিপজ্জনক পরিণতির মুখোমুখি হতে পারে বলেও সতর্ক করা হয়েছে।

যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন অবশ্য বলেছেন, চুক্তিটি চীনকে প্রতিপক্ষ করার উদ্দেশ্যে করা হয়নি। তবে বরিসের এই উদ্যোগ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে। এই চুক্তি যুক্তরাজ্যকে চীনের সঙ্গে যুদ্ধে টেনে নিতে পারে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি।