নিউইয়র্কে ঈদের ভিন্ন রূপ

নিউইয়র্কে একটি ঈদের জামাতে মুসল্লিরা
নিউইয়র্কে একটি ঈদের জামাতে মুসল্লিরা

নিউইয়র্কে ঈদুল আজহা পালিত হলো তিন দিন আগে। ঈদের আগের শেষ জুম্মাবারে বলে দেওয়া হলো কোরবানির তারিখ। তাতে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গেল নিউইয়র্কবাসী। জ্যামাইকা, জ্যাকসন হাইটসের দিকের মসজিদগুলোয় বলা হলো, ২১ আগস্ট হবে ঈদ। কুইন্স ভিলেজের কোনো কোনো মসজিদ থেকে বলা হলো, ঈদ হবে ২২ আগস্ট।
এ নিয়ে অনেক কথাবার্তাও হলো বাঙালিদের মধ্যে। কেউ বললেন, সৌদি আরবে যেদিন ঈদ হয়, তার পরদিনই নিউইয়র্কে ঈদ হয়ে আসছে, তাই এবার ২১ আগস্ট ঈদ হওয়াই ঠিক। কেউ বলল, নিশ্চয়ই চাঁদ দেখার

ব্যাপার-স্যাপার আছে। তাই যেভাবে বলে দেওয়া হয়েছে, সেভাবে ঈদ হলেই ভালো।

তবে নিউইয়র্কে যে যেখানেই থাকুক না কেন, এই দুদিনের যেকোনো একদিন ঈদ পালন করতে পারে তারা। কুইন্স ভিলেজের কোনো কোনো মসজিদে ২১ আগস্টই ঈদের জামাত হলো। একটা মসজিদে হলো সকাল ৬টায়, অন্যটায় সকাল সাড়ে সাতটায়। যাঁরা কোরবানি দেওয়ার জন্য দূরে চলে যাবেন, ছটায় হলো তাদের জন্য। এখানে একটা গায়ানিজ মসজিদ আছে (অর্থাৎ যার রক্ষণাবেক্ষণ করে গায়ানিজরা), সেখানে ঈদের নামাজ ছিল সকাল সাড়ে সাতটায়।
তবে আমরা ঠিক করলাম, ভোরবেলায় স্নান সেরে জ্যামাইকা মুসলিম সেন্টারের জামাতেই যাব। এখানে জামাত হবে সকাল ৯টায়। বড় ভাই বললেন, এই বড় মাঠটায় আগে কখনো ঈদের নামাজ পড়া হয়নি, তাই এবার সেখানেই যাওয়া হোক।
আমার জানাশোনা যাঁরা আছেন, তাঁদের বেশির ভাগ মানুষই ২১ আগস্ট মঙ্গলবার ঈদ পালন করেছেন। বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে তিনভাবে ঈদ পালন হলো। প্রথমভাগে থাকলেন তাঁরা, যাঁরা এখানে কোরবানি দেন। দ্বিতীয় ভাগে তাঁরা, যাঁরা দেশে কোরবানি দেন, এখানে ঈদের দিন ছুটি নিয়ে রান্নাবান্না করেন। তৃতীয় ভাগে আছেন তাঁরা, যাঁরা ঈদের দিন অফিস করেন, অফিস শেষে ঈদের আনন্দে শরিক হন।
নিউইয়র্কের ঈদে এই তিন ধরনের মানুষের সঙ্গেই আমার দেখা হয়েছে।
জ্যামাইকা মুসলিম সেন্টারে জামাত শুরু হওয়ার আগে নিউইয়র্কের রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনের নেতারা স্থানীয় মুসলমানদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখেন। প্রতিটি বক্তৃতাই হচ্ছিল ইংরেজিতে, তবে মাঝেমধ্যে আরবি শব্দও থাকছিল। নেতাদের প্রত্যেকেই বলছিলেন, নিউইয়র্কের মুসলিম মহলের জন্য তাঁরা কী কী করেছেন। বিশেষ করে স্কুলে হালাল টিফিনের কথা জোর দিয়ে বললেন কেউ কেউ। এ ছাড়া রোহিঙ্গা আর সিরিয়ার জনগণের প্রতি সৌহার্দ্য জানিয়েও বক্তব্য রাখলেন কেউ কেউ।
নিউইয়র্কের কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেল সরাসরি এই মাঠ থেকে ঈদের অনুষ্ঠান সম্প্রচার করেছিল।
নয়টা বাজার আগে বক্তৃতা পর্ব শেষ। আটটা চল্লিশ মিনিটের আগপর্যন্ত মাঠে মানুষ ছিল কম। এরপর জনস্রোতে ভেসে গেল মাঠ। সামনের সারিগুলোয় পুরুষেরা বসেছেন, একটু ফাঁকা রেখে পিছনে সারিগুলোয় নারীরা। ঈদের কারণে নিউইয়র্কের গলির রাস্তাগুলোয় পার্কিং বাধ্যবাধকতা উঠিয়ে নেওয়া হয়েছিল। এর অর্থ হলো, আজ যে কেউ যেকোনো জায়গায় পার্কিং করতে পারবেন। একটু বুঝিয়ে বলি। জনস্বার্থে নিউইয়র্কে একটা পার্কিং বিধি আছে। কোনো কোনো রাস্তার কোনো কোনো জায়গায় লেখা—এখানে কোনো সময়েই পার্কিং করা যাবে না। তার একটু দূরেই হয়তো লেখা, এখানে শুধু বৃহস্পতিবার সকাল ৬টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত পার্কিং করা যাবে। কোথাও লেখা, প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত, শুক্রবার ছাড়া। যে সব জায়গায় এই সাইনগুলোর কোনোটাই নেই, সে সব জায়গায় যেকোনো সময় পার্কিং করা যাবে। ঈদের দিন এই বিধিনিষেধ থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে জনগণকে। তারা গাড়ি নিয়ে আসতে পেরেছে এবং যেখানেই খালি পেয়েছে জায়গা, ট্রাফিক সংকেতগুলোর কথা মাথায় না রেখে সেখানেই রাখতে পেরেছে গাড়ি।
নিউইয়র্কের যে কটা বাড়িতে গিয়েছি, সব জায়গায়ই ঈদের আয়োজন ছিল চোখে পড়ার মতো। সেমাই, ফিরনি তো ছিলই। ছিল পোলাও, গরুর মাংস, মুরগির রোস্ট অথবা তন্দুরি-চিকেন, চায়নিজ চিকেন ভেজিটেবল, চিংড়ি, রুই মাছ ইত্যাদি। কেউ কেউ হালিম আর চটপটি করেছেন। তবে এক বাড়িতে সেমাই-পিঠা, আরেক বাড়িতে দেশ থেকে আনা পায়েস দেখে চমকে গিয়েছিলাম।
কোরবানির ব্যাপারটা বলি। যাঁরা কোরবানি দেবেন, তারা আগে থেকেই খামারে গিয়ে গরু পছন্দ করে আসেন, ভোরবেলায় নামাজ পড়ে কোরবানির জন্য চলে যান। আবার কেউ কেউ গ্রোসারি শপ বা সুপারমলেও কোরবানির জন্য টাকা দিয়ে দেন। যাঁরা নিজেরা কোরবানি দিচ্ছেন, তাঁরা চলে যান কসাইখানায়। সেখানে কোরবানির পর পশুর মাংস ছোট ছোট টুকরো করা হয় তারপর তা নিয়ে আসা হয় বাড়িতে। এ কাজটা খুব সহজসাধ্য নয়। নম্বর অনুযায়ী গরু আসে কোরবানির জন্য। কোরবানি হওয়ার পর কাটাকাটি হয়। তারপর সাতজনের জন্য ভাগ হয়। কাজটা হতে হতে কখনো বিকেল গড়িয়ে যায়, কখনো রাত হয়ে যায়। গ্রোসারি শপেরও একই অবস্থা। বিকেলের আগে সেখান থেকেও মাংস পাওয়া যায় না। তাই রান্নাবান্না যা করার, তা আগেই করা হয়ে যায়। দুপুরে বা রাতে খাওয়া-দাওয়া হয়। কোরবানির মাংস এলে তা ভাগ করে কিছুটা চড়িয়ে দেওয়া হয় রান্নার জন্য, বাকিরা ডিপ ফ্রিজে রেখে দেওয়া হয়। কেউ সেদিনই ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলে যদি গাড়ি নিয়ে বের হতে পারেন, তাহলে মাংসের বিলিবণ্টনটাও করে ফেলতে পারেন। অন্যরা বিলি করার জন্য বেছে নেন অন্য কোনো দিন।
গরু সাত ভাগ করা হলে এক এক ভাগে আশি পাউন্ডের মতো মাংস হয় (৪০ কেজির কাছাকাছি)। একজনকে জিজ্ঞেস করে জানলাম, এক ভাগ কোরবানি দিতে ৪৭০ ডলার লেগেছে। গরু ভেদে দামের হেরফের হয়।
রাস্তাঘাট দেখে বোঝার উপায় নেই যে এখানে ঈদ হচ্ছে। কিন্তু কখনো কখনো চলতি পথে পায়জামা-পাঞ্জাবি, শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ পরা মানুষদের দেখলে বোঝা যায়, এখানে আজ ঈদ। তবে বাঙালিদের বাড়িতে বাড়িতে যে ঈদের আয়োজন, তা ছিল দেখার মতো। এখানে বৈচিত্র্যময় লোভনীয় রান্নাগুলো ঈদের আনন্দকে পূর্ণ করে তোলে।
তবে ঈদের সময় বিনোদনের জন্য কোথাও ঘুরতে যেতে দেখিনি পরিচিত কাউকে। ভ্রমণের জন্য বছরের অন্য সময় বেছে নেন তাঁরা। ঈদটা আনন্দ করে নিউইয়র্কেই কাটিয়ে দিতে চান তাঁরা।