নিজেকে স্থির রাখুন
আমাকে ভালোবাসার জন্য শুধু একজন মানুষ দরকার। সে একজন কে? পৃথিবীর সবাই আমাকে ভালোবাসবে না; এটাই স্বাভাবিক। এমনকি একটা সময় দেখলাম একজনও ভালোবাসে না। তবে কি আমার জীবনে ভালোবাসা একেবারেই শেষ? আমি কি তখন আত্মহননের পথ বেছে নেব? আমি যাকে আপন ভাবি, সে আমাকে আপন ভাবছে না। সে যেহেতু আপন ভাবছে না, তাহলে কি আমিও আপন ভাবা বন্ধ করে দেব?
একটা অনুষ্ঠানে গেলাম। কেউ আমাকে সম্মান দেখায়নি। সবাই নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত। আমার মন খারাপ হওয়াটাই কি স্বাভাবিক? আমি অনেক কষ্টে একটা খাবার বানালাম। পরিবারের কেউ মুখে নিয়েও দেখেনি। তারা বাইরে খেয়ে এসেছে। আমি কি হতাশ হব? নতুন বছর এল। আমি ভেবেছিলাম, আমার প্রেমিক বা স্বামী আমাকে কোনো সারপ্রাইজ গিফট দেবে; কিন্তু দেয়নি। সে আমাকে সামান্য একটা গোলাপের তোড়া দিয়েও শুভেচ্ছা জানাতে পারত। তাও দেয়নি। ফেসবুকে সবাই সমানে পোস্ট দিচ্ছে পরিবারের ছবি। কত কী উপহার? পার্টি! কেউ কেউ ডেস্টিনেশন সেলিব্রেশনও করছে। কিন্তু আমার তো এসব কপালেই নেই! সামনে যে ছিল, সে নতুন বছরের শুভেচ্ছা জানায়নি। কী একখান কপাল! এমন অসংখ্য দীর্ঘশ্বাস আমাদের প্রতিনিয়ত গ্রাস করে। আমরা কি এসব ভাবনায় ডুবে যাব?না এগুলোকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বলব, আমার কিছু চাই না?
এই যে এত এত ‘কেন’, তার উৎস মূলত আমাদের মন, আমাদের আত্মা। আমাকে ভালোবাসার জন্য একমাত্র যে ব্যক্তি প্রয়োজন, সে ব্যক্তি হচ্ছি আমি নিজে। যত সুন্দর মানুষ হোক না কেন একজন নারী বা পুরুষ কোনো না কোনোভাবে বঞ্চনা বা প্রত্যাখ্যানের সঙ্গে পরিচিত হয়। এটাই হয়তো প্রকৃতি নির্ধারিত ভাগ্য। এ নিয়ে নিজেকে আঘাতের কোনো মানে নেই। লোক আমাদের বঞ্চিত করবে, ছোট করবে; আমরা নিজেরা কেন করব? নিজেকে ভালোবাসতে পারলে এ প্রশ্নই আসবে না সামনে। যে ভালোবাসেনি, তার সে যোগ্যতা নেই। আমার প্রতি উদার হওয়ার ক্ষমতা তার নেই। সে নিজেই হয়তো ভালো নেই যে ভালোবাসা দেখাবে। এভাবে ভাবলে তখন নিজের চিন্তা দিয়ে নিজেকে আঘাতের মাত্রা কমে যায়। চাইলেই এ দীর্ঘশ্বাস বন্ধ করা যায়। খুব সামান্য নিয়েও সুখী থাকা যায়।
বিশ্বাস না হলে পরীক্ষা করে দেখবেন। ঘুম থেকে উঠে প্রথমেই নিজেকে বলুন যে, আজ যত কঠিন পরিস্থিতি আসুক না কেন, আমি দুঃখী হব না; খুশি থাকব। শুরুতে বুঝবেন না। কিন্তু একদিন দেখবেন যে, আপনার মন কোনোভাবেই আর সংযম হারাচ্ছে না। কে ভালোবাসল কি বাসল না, কে সম্মান করল না—এসব কোনো বিষয় আপনাকে বিচলিত করবে না। এমনকি কেউ কষ্ট দিলেও তা আপনার মানসিক শক্তিকে পরাস্ত করতে পারবে না। আপনি বুঝতে পারবেন, এটা একান্ত তাঁর নিজের আচরণ। হয়তো এটাই তাঁর অভ্যাস।
অনেক জ্ঞানীগুণী মানুষও বলেন, ‘ভালোবাসার অপর পৃষ্ঠায় থাকে ঘৃণা। কেন ঘৃণা হবে? আমি একটা ফুল ভালোবাসি। এখন সেটা হাতে করে নিয়ে আসতে পারলাম না বলে তাকে ঘৃণা করতে হবে?একজন মানুষকে আমি মনেপ্রাণে ভালোবাসতাম। সে-ই সারা জীবনের একমাত্র চাওয়া। কিন্তু সে ভালোবাসেনি বা কোনো কারণে তাকে পাইনি। এখন কি তাকে আমি ঘৃণা করব? আমার মধ্যে ভালোবাসা তৈরির জন্য সে হয়তো ছিল উদ্দীপক। তাঁর প্রতি আমার ভালোবাসার জন্য আমি তাকে দায়ী করব না। যখনই মানুষ অন্যের প্রতি ঘৃণা পোষণ করে, তখন তার শরীরের প্রতিটি কোষ বিষ উৎপন্ন করে, যা নিজেকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে।
খুব সত্য কথা যে, আমাদের চিন্তাই আমাদের অনুভূতির উৎস, যার সঙ্গে যোগ রয়েছে স্বাস্থ্যের। আমাদের সব চিন্তাভাবনার প্রকাশ ঘটে আমাদের আচরণে। আর এর মধ্য দিয়েই অন্যের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের ভিতটি তৈরি হয়। আমাদের সব চিন্তার একটি প্রভাব পড়ে পরিবেশের ওপরও। আমাদের চিন্তাই আমাদের কর্ম তৈরি করে, যা আমাদের ভাগ্যের নিয়ন্তা। প্রতিকূল পরিস্থিতিও কোনো সমস্যা তৈরি করবে না, যদি চিন্তা যদি ঠিক থাকে। এমনকি শুধু চিন্তার কারণেই পরিস্থিতি অনুকূলে কাজ করতে পারে। চারদিকে এখন এত কনটেন্ট! আমরা দেখছি, পড়ছি ও শুনছি। এগুলো মস্তিষ্ক ও ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। এ জন্য উচিত কী দেখছি, কী পড়ছি, কী শুনছি—সে বিষয়ে সজাগ থাকা।
অন্যের আচরণের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিজেকে পরিবর্তন করলে, অন্যের বাজে আচরণ আমার মধ্যেও বাজে বিষয়গুলো সঞ্চারিত করবে। অন্যের নীচতা আমার মধ্যেও বাসা বাঁধবে। আসলে আমাদের ইগো এসে কানে কানে বলে, ‘সে তোমার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করছে না, তুমি কেন করবে?’ এই এক মন্ত্রই যথেষ্ট। শুধু ইগো কেন, আশপাশের মানুষও এসে এমনটিই বলে। তবে ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়। তবে তার সংখ্যা খুব কম। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, কারও বাজে আচরণ আপনি ক্ষমা করে দিলেও আপনার পরিচিত কেউ এসে হয়তো বলছে, ‘তোমার এত ভালো হওয়ার প্রয়োজন কী?’ আপনি হয়তো ভালো চিন্তা করছেন। কারও উপকার করছেন। আরেকজন বলল, ‘এত ভালো হওয়ার দরকার নেই।’ আপনি কি সে কথা শুনবেন? ভেবে দেখুন। নিজের সদ্গুণ থেকে সরে যাওয়াটা ভালো নয়। ক্ষমতা কারও পদ-পদবির ওপর নির্ভর করে না। ক্ষমতা হচ্ছে নিজেকে স্থির রাখতে পারার মধ্যে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে বাইরের কোনো ঝড় মনকে নাড়াতে পারবে না।
ছোট ছোট কারণে মানুষের মন অস্থির হয়। অনেককে দেখা যায় নিজের পেশার কথা বলতে গিয়ে কুঞ্চিত হন। কারণ, আমাদের শেখানো হয়েছে পদ বড় তো ব্যক্তি বড়, সম্মান বড়। কিন্তু সম্মান এত ঠুনকো নয়। অনেকে সংসারে অশান্তি করেও পার্টিতে যোগ দেন। অনুষ্ঠান আমাদের আনন্দ দেয় সত্যি। কিন্তু সুখী করে না। অনেক হল্লা করে ফিরে আসার পর স্থির দুঃখই আবার পেয় বসবে। আবার সব চাহিদা পূর্ণ না করেও সুখী থাকা যায়।
নতুন বছরে কি আমরা নিজেকে স্থির রাখার সংকল্প দিয়ে শুরু করতে পারি না? আধ্যাত্মবাদীরা বলেন, পরিবারে একজন মানুষ যদি সঠিক ব্যবহার সৃষ্টি করতে পারেন, সেই পরিবারের পুরো কাঠামো সঠিক হয়ে যাবে। সুতরাং আপনার পরিবারকে আপনি রক্ষা করতে পারেন। শুধু নিজেকে ঠিক রাখা জানতে হবে। খারাপ-ভালো যেকোনো পরিস্থিতির সঙ্গে আপনি নামবেন, পরিবারের বাকিরাও নামবে আপনার সঙ্গে সঙ্গে। এমন অসংখ্য উদাহরণ আছে। পরিবেশ পরিস্থিতি, মানুষ আপনাকে সম্মানের সঙ্গে গ্রহণ করবে কি করবে না—সেটা তাঁদের ব্যাপার। আপনি নিজেকে স্থির রাখুন।