নিজের জন্য নয়, অন্যের জন্যও বাঁচতে হয়
বাইরে ঝকঝকে রোদ। এমন আবহাওয়ায় কেউ ঘরে থাকে না। কোলাহলমুখর থাকে চারদিক। বসন্তের আগমনী গান বেজে চলে। গাছে গাছে সবুজ পাতারা উঁকি দেয়। চোখ মেলে তাকায় ফুলের কুঁড়ি। মানুষের সমাগম, ব্যস্ততা থাকে চোখে পড়ার মতো। কিন্তু এসবের এখন কিছুই নেই। লকডাউনের ফলে ব্যস্ততম এলাকা খাঁ খাঁ বিরানভূমি। করোনা আমাদের ঘরবন্দী করেছে। আবহাওয়া যা-ই হোক রোদ বা বৃষ্টি, মেঘলা আকাশ বা ঝড়; আমরা ঘরে থাকছি। কারণ, নিজে বাঁচতে চাই এবং চাইছি অন্যরাও বাঁচুক।
লাখ লাখ মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে সুস্থ হয়েছে অনেকে। একজন চিকিৎসকের প্রাণপণ চেষ্টায় যখন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরছে রোগী, তখন মনে হয় এই মুহূর্তের মতো সুন্দর আর কিছু নেই। অনেকে হারিয়েছে তাদের আপনজন। তাদের পাশেও কিছু মানুষ ব্যক্তিগতভাবে সহযোগিতা করছে। খুব বেশি নয়। তবে দুঃসময়ে অল্প একটু সহযোগিতাই যেন বেঁচে থাকার প্রেরণা জোগায়।
‘বল কি তোমার ক্ষতি/ জীবনের অথই নদী/ পার হয় তোমাকে ধরে/ দুর্বল মানুষ যদি’— ‘মানুষ মানুষের জন্য’, ভূপেন হাজারিকার এই গান যতবার শুনি, মনে হয় সত্যি, তাই তো। আমাদের জীবন যাপনের জন্য শুধু অর্থ নয়, প্রয়োজন সহানুভূতি, মমতা। করোনার এই কালে অনেকে যখন দেখছে তার পরিবারে মানুষটি আক্রান্ত, তখন তারা দূরে সরে গিয়েছে, অবহেলা করেছে। আবার বিপরীত চিত্রও দেখেছি। দেখেছি, একজন মা করোনায় আক্রান্ত হয়ে বাচ্চাদের ফেলে যায়নি। বরং পাশের রুমে থেকে নিজেকে বন্দী করে দরজার ওপাশ থেকে কথা বলেছে। নিজের জন্য ভাবেনি; ভেবেছে সারাক্ষণ বাচ্চাদের কথা। দরজার ওপাশ থেকেই দিয়েছে বাচ্চাদের সান্ত্বনার বাণী। মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে লড়াই করেছে ভাইরাসের বিরুদ্ধে। এ এক কঠিন সময়। এই সময়ে পাশে থেকেছে কিছু মানুষ, সহযোগিতা করেছে আন্তরিকভাবে। কেউ রান্না করে বাইরে রেখে গেছে, কেউ বা বাজার করে দিয়ে গেছে।
এই যে অল্প একটু সহানুভূতি, পাশে থাকা—এটাই যেন বিরাট কিছু। দুঃসময়ে সাগরে ডুবে যাওয়ার সময় যেন বাঁচার একটু আশ্রয়। আমার প্রতিবেশী ভাইরাসে আক্রান্ত ছিল। হাসপাতালে যাওয়ার সময় দূর থেকে বলেছি তাকে, ‘ভয় পেয়ো না। সাহস রাখো; কিছু হবে না। কষ্ট পাবে কিছুদিন এই যা। দেখবে খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবে।’
সত্যি হয়েছেও তাই। মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছে সে। এখন সুস্থ সে। আমাকে বলেছে, ‘জানো, ভয় পেয়েছিলাম মনে মনে। তবে তোমার, আমার পরিবারের পাশে থাকার কথা মনে থাকবে।’ বললাম, ‘আমি তো কিছুই করিনি।’ বলে, ‘সাহস দিয়েছ। ওই সময়টায় এটার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল।’
এমনও হয়েছে যে দেখেছি, একই ফ্যামিলির সবাই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। সবাই আলাদা আলাদা রুমে ছিল। চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়েছে বাসা থেকেই। দুজন সুস্থ হয়ে গেছে। একজন হাসপাতালে আছে। তবু কেউ কাউকে ছেড়ে যায়নি। এই যে পাশে থাকা, এটা তাদের বাঁচতে সহযোগিতা করেছে।
শুনলাম, দেশে নিজের মাকে পর্যন্ত দূরে সরিয়ে দিয়েছে, ভাইরাস আক্রান্ত বাবাকে হাসপাতাল রেখে চলে গেছে ছেলে। কী নির্মম! অথচ তাদের পাশে সবার আগে আপজনেরাই থাকার কথা। জীবন থেকে পালিয়ে কি বাঁচা যায়? যায় না। আমরা যদি পাশের মানুষটির কথা ভাবি, তাকে সহানুভূতি জানাই, প্রতিবেশীর খোঁজ-খবর রাখি নিজের সাধ্য অনুযায়ী, তাহলে খুব বেশি কি ক্ষতি হবে? হবে না। স্বার্থপর হলে সম্পদ করা যায়। কিন্তু আনন্দ নিয়ে বাঁচা যায় না। অন্যের জন্য কিছু করতে পারার মধ্যে যে আনন্দ, তা আর কিছুতেই নেই। এটা সবার বোঝার কথা নয়। যারা করছে, তারা জানে এ কাজে কত তৃপ্তি।
চলছে রমজান মাস। মুসলমানদের কাছে এই মাস অনেক আবেগের মাস; প্রার্থনার মাস। আগে পরিবারের সবাই একসঙ্গে ইফতার করত। পরিবারের মা, বিশেষ করে বিভিন্ন রকমের ইফতার বানাতেন, তাঁকে অন্যরা সাহায্য করত। এবার সেসবের কিছুই নেই। বরং কোনো রকমে সুস্থ থাকাটাই হচ্ছে আনন্দের। কারণ, করোনাভাইরাসের কারণে দূরত্ব বজায় রাখতে হচ্ছে।
সবচেয়ে কষ্টের কথা হচ্ছে এই মাসে কিছু ব্যবসায়ী জিনিসপত্রের দাম দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে জরিমানা করা হচ্ছে, পুলিশ সিলগালা করে দিচ্ছে দোকান। অথচ হওয়ার কথা ছিল উল্টোটা। আমরা অতি লোভী। লালসা আমাদের বিবেক ধ্বংস করে দিয়েছে। আমাদের আরও চাই। কিন্তু সামান্য, খুব বেশি না আমরা যদি অন্যের কথা ভাবি, তাদের পাশে একটু থাকি তাহলে কত সুন্দর না হয় জীবন। আমার কাছে যা সামান্য, অন্যের কাছে হয়তো তা-ই অনেক কিছু।
এক মাসের বেশি বাসায় লকডাউনে আছি। এই এক মাসে জেনেছি যে, অনেকের জীবন ওলট-পালট হয়ে গেছে। করোনা যেন কালসাপের মতো বিষাক্ত ছোবল মেরে বিষ ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে মানুষের জীবনে। অনেকে ভেঙে পড়েছে মানসিকভাবে, অনেকে আর্থিকভাবে। আমরা যদি তাদের পাশে একটু থাকি, একটু সহযোগিতার হাত বাড়াই—ক্ষতি তো নেই। অনেকে করছে। তাদের এমন কাজ দেখে মন থেকেই শ্রদ্ধা চলে আসছে। ‘নিজে ভালো আছি, আর কি চাই’—এই ভাবনার মধ্যেই কেমন দৈন্য প্রকাশ পায়। মনের সংকীর্ণতা দূরে ঠেলে একটু যদি অন্যের পাশে থাকি, তাহলে সেটাই হবে বাঁচা। শুধু নিজের জন্য নয়, অন্যের জন্যও বাঁচতে হয়।