নির্ঘুম শহর নিউইয়র্ক

ম্যানহাটন। নিউইয়র্ক নগরের প্রাণকেন্দ্র এবং সারা পৃথিবীর অন্যতম অর্থনৈতিক, ব্যবসায়িক, সাংস্কৃতিক ও পর্যটনকেন্দ্র। পাঁচটি বরো নিয়ে গঠিত। নিউইয়র্ক সিটির প্রধান বরো হলো এই ম্যানহাটন। একেকটি বরোকে ঢাকা মহানগরের একেকটি থানার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। অন্য চারটি বরো হলো কুইন্স, ব্রুকলিন, ব্রঙ্কস ও স্টেটেন আইল্যান্ড।
ভৌগোলিক দিক থেকে ম্যানহাটনকে একটি দ্বীপ বলা যেতে পারে। কারণ, এর চারদিকেই রয়েছে নদী ও সমুদ্র। উত্তরে হারলেম রিভার, দক্ষিণে নিউইয়র্ক বে, পূর্বে ইস্ট রিভার এবং পশ্চিমে আছে হাডসন রিভার। ম্যানহাটনের আয়তন হলো প্রায় ৮০ বর্গকিলোমিটার অর্থাৎ প্রায় ৩১ বর্গমাইল।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৫২৪ সালে ইতালিয়ান নাবিক গিয়াভানি ডা ভেরাজানো প্রথম কোনো সাদা মানুষ ম্যানহাটনে আসেন। এর আগে এখানে আদিবাসী ইন্ডিয়ানদের বাস ছিল। ১৭৮৫ থেকে ১৭৯০ সাল পর্যন্ত নিউইয়র্ক সিটি আমেরিকার রাজধানী ছিল। ১৭৯২ সালে ম্যানহাটনে প্রথম স্টক এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর থেকেই ম্যানহাটন ব্যবসায়িক এবং আর্থিক লেনদেনের কেন্দ্রে পরিণত হয়। এই সিটির মেয়ররা সব সময়ই নিউইয়র্ককে পৃথিবীর রাজধানী বলে দাবি করে থাকেন আর এই রাজধানীর হেডকোয়ার্টার হলো ম্যানহাটন। ১৭৯০ সালে এর লোকসংখ্যা ছিল ৩৩ হাজার ১৩১ জন আর ২০০০ সালে এই সংখ্যা হলো ১৫ লাখ ৩৭ হাজার ১৯৫ জন। সারা দুনিয়ার এমন কোনো দেশ নেই, যে দেশের লোক এই ম্যানহাটনে নেই।
ম্যানহাটনকে মূলত তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। লোয়ার ম্যানহাটন বা ডাউন টাউন, মিড টাউন ও আপ টাউন। লোয়ার ম্যানহাটন হলো মূল অর্থনৈতিক এবং ব্যবসায়িক কেন্দ্র। পৃথিবীর নামকরা সব আর্থিক ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের সদর দপ্তর এখানে অবস্থিত। তাই লোয়ার ম্যানহাটনের আরেক নাম ফিন্যান্সিয়াল ডিস্ট্রিক্ট। এখানেই আছে বিশ্ববিখ্যাত ওয়াল স্ট্রিট, যেখানে নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জ অবস্থিত। ১৭৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত এই নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জ হলো পৃথিবী বৃহত্তম স্টক এবং বন্ড মার্কেট। এই স্টক মার্কেটে প্রায় ৩ হাজার ৭৫০টি কোম্পানির শেয়ার তালিকাভুক্ত আছে এবং পুঁজির পরিমাণ প্রায় ১২ ট্রিলিয়ন ডলার। এ ছাড়া এখানে আছে আমেরিকান স্টক এক্সচেঞ্জ, সিটি হলো (মেয়রের অফিস), ওয়ার্ল্ড ফিন্যান্সিয়াল সেন্টার। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরে ধ্বংসপ্রাপ্ত টুইন টাওয়ার এখানেই ছিল। লোয়ার ম্যানহাটনের অন্যতম আকর্ষণ হলো চায়না টাউন। পর্যটকেরা এখানে এলে চায়না টাউনের চায়নিজ খেতে ভোলেন না।
ফিফথ অ্যাভিনিউ হলো এখানকার একটি অন্যতম সড়ক, যেখানে আছে চোখধাঁধানো সব শপিং মল। এই অ্যাভিনিউকে আবার অনেকে মিউজিয়াম অভিযুক্ত বলে থাকেন। কারণ, এখানে আছে সারি সারি মিউজিয়াম। নিউইয়র্ক সিটিতে বিভিন্ন স্বাদের এবং বিভিন্ন বিষয়ের প্রায় ২৫০টি মিউজিয়াম আছে বলে জানা যায়। আর এর বেশির ভাগই আছে ম্যানহাটনে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শিল্পকলা কেন্দ্র হিসেবে সর্বজন স্বীকৃত এই শহরে আছে প্রায় ৪০০টি আর্ট গ্যালারি। আর তাই এই ম্যানহাটনই হলো চিত্রকর, শিল্পানুরাগী, শিল্পবোদ্ধা, শিল্প সংগ্রাহক এবং আর্ট ডিলারদের তীর্থকেন্দ্র। ম্যানহাটনের ম্যাডিসন অ্যাভিনিউ এবং সোহো এলাকাতেই বেশির ভাগ আর্ট গ্যালারি অবস্থিত। সোহো এলাকাটি আবার সম-লিঙ্গ (গে ও লেসবিয়ান) দম্পতিদের আবাস বলেও পরিচিত। এখানে শুধু কয়েকটি নামকরা মিউজিয়ামের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিচ্ছি।
মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অব আর্ট প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৮৭০ সালে। পৃথিবীর যত রকম শিল্পমাধ্যম আছে এবং যত রকম কৃষ্টি আছে, তার প্রতিটি থেকেই কিছু না কিছু সংগ্রহ করে রাখা হয়েছে এই মিউজিয়ামে। এই মিউজিয়ামের সংগ্রহে আছে প্রায় ৩০ লাখ সামগ্রী। এর সংগ্রহ এত ব্যাপক যে এর ৩০০ গ্যালারি এবং ৩২ একর বিশিষ্ট মেঝেতে একসঙ্গে শুধু পাঁচ ভাগের এক ভাগ সামগ্রী প্রদর্শন করা যায়। এটি হলো পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম আর্ট মিউজিয়াম। লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়াম এবং রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গের হারমিটেজ মিউজিয়ামের পরই এর অবস্থান।
আরেকটি মিউজিয়াম হলো মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্ট, যেখানে আছে বিংশ শতাব্দীর পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান চিত্রকলার সংগ্রহ। এই মিউজিয়ামটির প্রতিষ্ঠাকাল ১৯২৯ সাল। এর সংগ্রহের ক্ষেত্রে মূলত ১৮৮০ সালের পর যেসব শিল্পীর জন্ম, তাঁদের কাজকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।
১৮৬৯ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে আমেরিকান মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রি। এটি পৃথিবীর একটি অন্যতম প্রকৃতি বিজ্ঞানবিষয়ক মিউজিয়াম, যেখানে আছে ডাইনোসরের অস্থি, ফসিলসহ অনেক দুর্লভ সংগ্রহ।
আরও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য মিউজিয়াম হলো উইটনি মিউজিয়াম অব আমেরিকা, দ্য ফ্রিক কালেকশন, সলোমন গুজেনহেম মিউজিয়াম, ইন্টারন্যশানাল সেন্টার ফর ফটোগ্রাফি, স্টুডিও মিউজিয়াম ইন হারলেম, জুইস মিউজিয়াম। এ ছাড়া আছে পুলিশ, সি-পোর্ট, এয়ারক্রাফট ইত্যাদি নানা বিষয়ের মিউজিয়াম। আছে অঞ্চলভিত্তিক মিউজিয়াম যেমন মিসর, এশিয়ান আর্ট, রাশিয়া, আফ্রিকা ইত্যাদি দেশের কালচারের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা মিউজিয়াম।
পেশাদার নাটক, সংগীত এবং নৃত্যের জন্য ম্যানহাটনের ব্রডওয়ে হলো সারা পৃথিবীর আকর্ষণ। এখানে এত ভিন্ন স্বাদ ও বৈচিত্র্যের পরিবেশনা হয়, এত লোক তা উপভোগ করে, এত রাজস্ব আয় হয় যে এর তুলনা শুধু লন্ডনের থিয়েটারের সঙ্গেই চলতে পারে। ব্রডওয়েতে অবস্থিত লিংকন সেন্টার পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পারফর্মিং আর্টস সেন্টার। এখানে সারা বছর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আসা সাংস্কৃতিক দলের অনুষ্ঠান লেগেই থেকে। ছোট–বড় ১০টি বিল্ডিংয়ের সমন্বয়ে গঠিত অপূর্ব স্থাপত্যশৈলীবিশিষ্ট রকফেলার সেন্টার (১৯৩১) একই রকম আর একটি কেন্দ্র। ম্যাডিসন স্কয়ার সেন্টার (১৯৬৪) মূলত একটি ইনডোর স্টেডিয়াম। বছরের প্রতিদিন এখানে একটা না একটা অনুষ্ঠান লেগেই থাকে। জাকব জেভিট কনভেনশন সেন্টার হলো একটি বিশাল স্থায়ী ইনডোর প্রদর্শনী কেন্দ্র। সারা বছর এখানে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ের প্রদর্শনী চলতে থাকে।
পৃথিবীর অনেক নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান এই ম্যানহাটনে। এদের কয়েকটি হলো ঐতিহ্যমণ্ডিত কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি, সিটি ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক, কুপার ইউনিয়ন ফর অ্যাডভান্সমেন্ট অব সায়েন্স অ্যান্ড আর্টস, ফরডহাম ইউনিভার্সিটি, নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি, পেইস ইউনিভার্সিটি, ইয়াসিবা ইউনিভার্সিটি, ম্যানহাটন স্কুল অব মিউজিক, আমেরিকান স্কুল অব ড্রামাটিক আর্টস, স্কুল অব ভিজ্যুয়াল আর্টস। এ ছাড়া আছে আরও বিভিন্ন ধরনের বিষয়ভিত্তিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
সারা ম্যানহাটনে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য আধুনিক ও প্রাচীন স্থাপত্যশৈলীতে তৈরি আকাশচুম্বী ভবনের সারি। এমনই কয়েকটি হলো এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং (উচ্চতা ৩৮১ মি. /১২৫০ ফিট), ক্রাইস্টলার বিল্ডিং, সিটিকরপ সেন্টার, ইউনাইটেড নেশন হেডকোয়ার্টার, আইবিএম এবং এটিঅ্যান্ডটি বিল্ডিং। এখানের দর্শনীয় কয়েকটি চার্চ হলো সেন্ট পেট্রিক ক্যাথিড্রাল, ক্যাথিড্রাল অব সেন্ট জন দা ডিভাইন। পর্যটকেরা এখানে এলে এসব চার্চ দেখতে ভোলেন না।
ম্যানহাটনে কংক্রিটের সারির মধ্যেও আছে সবুজের ছোঁয়া। শহরজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অনেকগুলো পার্ক। মধ্য ম্যানহাটনে প্রায় ৮০০ একর জমির ওপর আছে বিশাল সেন্ট্রাল পার্ক। এই পার্কে আছে অসংখ্য খেলার মাঠ, ছোটদের জন্য চিড়িয়াখানা, সাইক্লিং এবং জগিংয়ের জন্য পৃথক লেন, বিশাল আকারের একাধিক দিঘি, সুইমিংপুল, টেনিস কোর্ট, শীতের সময় আইস স্কেটিংয়ের সুবিধা, বোটিংয়ের ব্যবস্থা। এ ছাড়া সামারে আছে ওপেন এয়ার কনসার্ট ও নাচের ব্যবস্থা, যা যেকোনো পর্যটকের মন জয় করতে যথেষ্ট।
সারা পৃথিবীর অভিবাসীদের বাস এই নিউইয়র্ক সিটিতে। অভিবাসীরা এখানে আসার সময় সঙ্গে নিয়ে আসেন তাঁদের সংস্কৃতি এবং তা এখানে যথাসাধ্য পালনও করে থাকেন। বছরের প্রতিদিনই তাই ম্যানহাটনে এ উপলক্ষে শোভাযাত্রা বা প্যারেড আয়োজন করা হয়। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো চায়নিজ নববর্ষ প্যারেড, পুয়ের্তোরিকান ডে প্যারেড, ইন্ডিয়ান ডে প্যারেড, গে ও লেসবিয়ান প্যারেড, থ্যাংকস গিভিং ডে প্যারেড।
সামারে ম্যানহাটন যেন উৎসবের নগরী। রংবেরঙের পোশাক পরা হাজার হাজার পর্যটক। হাতে ক্যামেরা পিঠে ব্যাক-প্যাগ নিয়ে ছুটছে শহরের এ–প্রান্ত থেকে ও–প্রান্তে। কখনো হেঁটে কখনো ট্যাক্সিতে আবার কখনো বা সাবওয়েতে। এখানে আছে প্রায় তিন হাজার বিভিন্ন রকমের রেস্তোরাঁ। আছে অসংখ্য আবাসিক হোটেল, যেগুলো সব সময়ই পর্যটকদের পদচারণে মুখরিত। রাতের ম্যানহাটন এর আরেক রূপ। বিশাল আকৃতির বিলবোর্ড, রংবেরঙের নিয়ন সাইন, বিশাল আকৃতির টিভি পর্দা সব মিলিয়ে এক অপরূপ দৃশ্য। বিশেষ করে টাইমস স্কয়ার এবং ব্রডওয়ের রাতের দৃশ্য দেখার মতো। এ ছাড়া সিটির রয়েছে পৃথক এক নাইট লাইফ। এই নাইট লাইফের ওপর ভিত্তি করে নির্মিত হয়েছে নামকরা এইচবিও সিরিজ সেক্স অ্যান্ড দ্য সিটি। সে এক আলাদা জগৎ। শীত, গ্রীষ্ম, রাত, দিন ম্যানহাটন সব সময়ই সরব। চলছে সবকিছু। কেউ হয়তো ভোর চারটায় কাজে যাচ্ছে আবার কেউবা কাজ থেকে ফিরছে। হোটেল–রেস্তোরাঁ বা বার ছাড়াও অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানও সারা রাত খোলা থাকে। আর তাই বোধ হয় এই সিটি সম্পর্কে বলা হয়, দ্য সিটি দ্যাট নেভার স্লিপস বা নির্ঘুম শহর।
ছবির ক্যাপশন: রাতের ম্যানহাটন।