প্রবাস জীবনে চাপা পড়া কষ্ট

দেশে থাকতে রহমান ভাই খুব রাগী লোক ছিলেন। গম্ভীর চেহারার দিকে তাকিয়ে সরাসরি কথা বলার সাহস অনেকেরই হতো না। তিনি ছিলেন খুব সৎ, আর সাহসী। নির্দিষ্ট কোনো কাজ না থাকলেও আর্থিক সমস্যা কোনো দিনই ছিল না। বাবার রেখে যাওয়া সম্পত্তি তদারকি করে মোটামুটি ভালোভাবেই সবকিছু চলছিল। দু বোনের একজন আমেরিকায়, অন্যজন ইংল্যান্ডপ্রবাসী। একমাত্র ছোট ভাইটিও পড়াশোনার জন্য অস্ট্রেলিয়া গিয়ে সেখানেই সেটেল্ড। একসময় মা ও এ পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন। রহমান ভাইয়ের পিছুটান কিছুই ছিল না। নিজের তিন ছেলেমেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে সুখের সংসার ছিল। মাঝেমধ্যে তাঁর মনে হতো, তিনিই বোধ হয় পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ। বোনের অ্যাপ্লাইয়ে আমেরিকার ভিসার জন্য প্রথম ডাকে সাড়া দেননি। পরে তাঁর এক ছেলে যখন অপহরণ হলো, তখন ভাইবোনের চাপাচাপি ও বাচ্চাদের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে সম্মত হয়েছিলেন দেশের বাইরে পা রাখতে। অনেক ঝামেলা ও টাকা-পয়সা খরচের পর অবশ্য ছেলেকে ফেরত পেয়েছিলেন সেবার।
এই রহমান ভাই এখন নিউইয়র্কে ফুডভেন্ডরের কাজ করেন! আমার কাজে আসা-যাওয়ার পথেই তাঁর ভেন্ডর স্পট, প্রায়দিনই টুকটাক কথা হয়। যে মানুষটা দেশে থাকতে নিশ্চিন্তে বিলাসী জীবন কাটিয়েছেন, সন্তানের নিরাপদ ভবিষ্যৎ চিন্তায় তিনি এখন একজন ফুডভেন্ডর। পাঁচ সদস্যের পরিবারে বাসা ভাড়াতেই রোজগারের বেশির ভাগ চলে যায়। আমি জানতে চেয়েছিলাম, ‘ভাল কোনো কাজ, যেমন ডানকিন ডোনাট কিংবা গ্রোসারিতে কাজ করলে ভালো হতো, অন্তত রোদ বৃষ্টি কিংবা স্নোর আক্রমণ থেকে রেহাই পেতেন।’ উত্তরে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রহমান ভাই বলেছিলেন, ‘একটা ডানকিনে কাজ পেয়েছিলাম, কিন্তু তারা আমাকে বেশি ঘণ্টা কাজ দিত না। বাংলাদেশি একটা গ্রোসারিতে কিছুদিন কাজ করেছিলাম; তারা বলে, আমি খুব স্লো। তাদের কথাবার্তাও আমার ভালো লাগেনি।’
সেদিন আমি কাজ থেকে ফিরছি। অঝোরে তুষার পড়ছে। আমি ছুটছি সাবওয়ের দিকে। রহমান ভাইয়ের স্পটের কাছে আসতেই কেন জানি আমার হাঁটার গতিটা কমে গেল। প্রচণ্ড তুষারপাত ও হাড় কাঁপা শীতের মধ্যেও তিনি একটা রেইনকোট পরে ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন। রাস্তায় সবারই প্রচণ্ড তাড়া। কোনো রকমে ট্রেন বা বাসস্টপে গিয়ে তুষারের আক্রমণ থেকে রেহাই পেতে চাইছে সবাই। একমাত্র রহমান ভাইয়েরই কোনো তাড়া নেই। যে রহমান ভাই দেশে থাকতে কোনো দিন কোনো জায়গায় বসেও কাজ করেননি, তিনিই আজ রোদ-বৃষ্টি কিংবা তুষারপাত উপেক্ষা করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে কাজ করছেন। ঠিকমতো কাজ না করলে মালিক তাঁকে বাদ দিয়ে দেবে। তখন বাড়ি ভাড়া সংসার খরচ—এগুলো কোথা থেকে আসবে? এই অঝোর তুষারপাতের মাঝে আমাকে দেখেই তাঁর মুখের কোনায় হাসির ঝিলিক, যেন অসংখ্য ভিনদেশির ভিড়ে নিজের একান্ত আপনজনের মুখ দেখেছেন। আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেমন আছেন ভাই?’
-আমি ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?
-এই তো কাজ শেষ করে ঘরে ফিরছি।
এমন সময় দুজন কাস্টমার তাঁর কাছ থেকে কিছু ফলমূল কিনল। পঞ্চাশ ডলারের একটা নোট দিয়ে ভাংতির জন্য ওরা খুব তাগাদা দিচ্ছিল। রহমান ভাই ভাংতিগুলো খুব সতর্কভাবে গুনছিলেন। কিন্তু ওরা যেন অধৈর্য। রাগত স্বরে একজন চেঁচিয়ে উঠল, ‘কাম’ন ম্যান, ইউ সো স্লো, উই গেটিং ওয়েট, ইউ আর (এফ) বুলশিট।’
রহমান ভাই যে রকম রাগী মানুষ, দেশে থাকলে এমন পরিস্থিতিতে হয়তো কষে থাপ্পড় মারতেন। কিন্তু এখানকার পরিস্থিতি ভিন্ন। ভাংতিগুলো দিয়ে তিনি অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে আছেন! তুষারের ঝাপটায় চেহারা এমনিতেই বিধ্বস্ত; তারপরও আমি দেখলাম তাঁর চোখ দুটো ছলছল করছে, হয়তো এখনই বৃষ্টি নেমে সব বিবর্ণতাকে ধুয়েমুছে দেবে। আমাকে দেখার পর যে নিষ্পাপ হাসি তাঁর চেহারায় ছিল, এখন অপমানে তা উধাও। তাঁর মনের অবস্থা যে খুবই বিপর্যস্ত, তা বুঝতে পেরে আর কথা না বাড়িয়ে সামনে পা বাড়ালাম আমি।
এভাবেই এই নিউইয়র্কের বুকে কত শত রহমান ভাই ভিন্ন পরিস্থিতিতে নিজের সঙ্গে, নিজের আত্মমর্যাদাবোধের সঙ্গে লড়াই করে যাচ্ছেন, সন্তানের নিরাপদ ভবিষ্যতের জন্য অবর্ণনীয় অপমান সহ্য করছেন, পরিবারের সবাইকে সুখী করতে নিজের সব সুখ, সব চাওয়াকে প্রতিনিয়ত বিসর্জন দিচ্ছেন—সেই হিসেবটা আমরা কয়জন জানি?