ফেসবুক নস্টালজিয়া
“শেলী, উই কেয়ার অ্যাবাউট ইউ অ্যান্ড দ্য মেমোরিজ দ্যাট ইউ শেয়ার হিয়ার।উইথ দ্যাট ইউ উড লাইক টু লুক ব্যাক অনদিস পোস্ট ফ্রম ফোর ইয়ারস অ্যাগো”!
হ্যাঁ, ফেসবুক আমার প্রাণের সখা ও শুভাকাঙ্ক্ষী। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। দিনরাতের যতটা সময় ফেসবুকে কাটাই, নিজের জীবনের বিশেষ বিশেষ দিন, ঘটনা, তথ্য যতটা ফেসবুকে শেয়ার করি, ততটা আর কারও সঙ্গে করি কিনা সন্দেহ। নিজের ব্যক্তিগত আনন্দ, সুখ, দুঃখের অনুভূতিগুলো তৎক্ষণাৎ ফেসবুকে শেয়ার না করে মনে যেন শান্তি পাই না।
তাইতো ফেসবুক আমার সব কথাই জানে। জানে আমার জীবনে কবে, কখন, কোথায় কী কী ঘটেছিল। একমাত্র বিশ্বস্ত বন্ধুর মতোই আমার সব কথা, স্মৃতি সে মনে করে রাখে। ঠিক সময় মতো তা স্মরণ করিয়ে দেয়। এমনকি এখন আর আমাকে আমার সন্তান, প্রিয়জন, বন্ধু, আত্মীয়-স্বজন কারও জন্মদিন মনে করতে বেগ পেতে হয় না। ঠিক সময় মতো ফেসবুক আমাকে বলে দেয় আজওমুকের জন্মদিন। ‘উইশ হার অর হিম অ্যা হ্যাপি বার্থ ডে উইথ অ্যা গিফট কার্ড।’ অথবা ‘রাইট অন হিজ অর হার টাইমলাইন।’
আমিও তৎক্ষণাৎ ফ্রেন্ডলিস্টের উল্লেখিত বিশেষ মানুষটিকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে দিই। বিনিময়ে তাঁরাও আমাকে আমার জন্মদিনে উইশ করে। এভাবে আমার বিশেষ দিনটিতেও শত শত শুভেচ্ছা বার্তায় টাইমলাইন অভিষিক্ত হয়ে যায়।
প্রতিদিন ঘুম থেকে ওঠার পরপরই একবার হলেও ফেসবুক চেক করা আমার অভ্যাস। বদঅভ্যাসও বলা যায়। ফেসবুকে চোখে রাখলেই ফেসবুক আমাকে বলে দেয়, গত বছর বা গত কয়েক বছর আগে ঠিক এই দিনে আমি কোথায় গিয়েছিলাম, কী করেছি, কাদের সঙ্গে আড্ডা দিয়েছি, কী কী বিশেষ খাবার খেয়েছি ইত্যাদি ইত্যাদি। পুরোনো স্মৃতিগুলো প্রতিদিন এক এক করে তারিখ ও সময়ের হিসেব মিলিয়ে মেমোরি লাইনে এসে জড়ো হয়। বিস্মৃত হয়ে যাওয়া সেই মুহূর্তগুলো তখন সেলুলয়েডের পর্দার মতো চোখের সামনে ভেসে ওঠে। এই সব মেমোরি আমাদের অনেক আনন্দ দেয়। অনেক স্মৃতি নস্টালজিক করে তোলে।
তবে চলমান এই মহামারিকালে পুরোনো স্মৃতিগুলো যেন হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগায়। কত কত “আছে” মানুষেরা কোভিড-১৯ এর মতো একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীবাণুর সংক্রমণে মুহূর্তেই “নাই” হয়ে গেল। যাচ্ছে। ফেলে আসা দিনে তাঁদের সঙ্গে সেসব স্মৃতি কেবল কষ্ট বাড়িয়ে তুলছে।
কয়েক’মাস আগেই রোজার ঈদ হয়ে গেল। তখন ঢাকায় ছিলাম। মিরপুরের বাড়িতে। ১৮ বছর পর নিজের শৈশবের বাড়িতে লকডাউনে আটকে পড়ে ঈদ করলাম। আমার স্বামী ঈদের জামাত পড়লেন আমাদের ঘরের পূর্বের বারান্দায় জায়নামাজ পেতে, মসজিদের মাইকে ভেসে আসা ইমামের ইমামতি অনুসরণ করে। আমরা দুপুরে পোলাও-কোর্মা খেলাম ঘরের দরজায় খিল এঁটে। সেই ঈদের দিনে আমার ছোট ছেলে, একমাত্র ভাই, বোন তারাও ছিল করোনার রেডজোন নিউইয়র্কে গৃহবন্দী। সবাই এক সঙ্গে করোনাক্রান্ত হয়েছিল। ফেসটাইমে কল করে ঈদের সুখাদ্য খেতে খেতে শুনলাম, নিউইয়র্কে তাঁদের ঘরে খাবার কম। মহামারির প্রকোপে অনকল ডেলিভারিও বন্ধ হয়ে গেছে। শুনে গলার ভেতরের অর্ধভুক্ত মজাদার পোলাও কোর্মার স্বাদ বিস্বাদে পরিণত হলো। এভাবেই আমাদের জীবনে একটি ভয়াবহ ঈদ আমরা উদ্যাপন করলাম। ফেসবুক মেমোরিতে ভেসে ওঠা গত বছরের উদ্যাপিত ঈদের কয়েকটি ছবি তখন আমাদের মনে কিছুটা সান্ত্বনা এনেছিল। আহা, কী সুন্দর আনন্দঘন পারিবারিক ঈদের ছবি। যায় দিন ভালো। এখন না হয় আমরা একটা বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। সামনে নিশ্চয়ই সুদিন আসবে। সুদিন আসবেই।
আমার আজকের ফেসবুক মেমোরি মনে করিয়ে দিল, নিউইয়র্কের একটি বৃষ্টিমুখর অনাবিল সন্ধ্যার কথা। খুব বেশি দিনের কথা নয়। মাত্র চার বছর আগের একটি স্মৃতি; ইয়োগা শেষ করে, শান্তিময় একটি শাওয়ার নিয়ে সবে রাস্তায় বেরিয়েছি। তখন অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝরছে আকাশ জুড়ে। ফ্ল্যাট আয়রন বিল্ডিংয়ের সামনে ঝমঝম করে ঝরছে ঝরনা ধারা। আকাশে জলভরা টইটুম্বুর সজল মেঘ, সড়ক জুড়ে বৃষ্টির উতলধারা। বাতাসে সদ্য ভেজা উত্তপ্ত মাটি থেকে বের হচ্ছে মাদকতাময় সোঁদা গন্ধ। চারদিকে বইছে পাগলা হাওয়া। মন নেচে উঠল, তাধিন তিন! আজ আমাকে রুখবে কে?
‘পাগলা হাওয়ার বাদল-দিনে
পাগল আমার মন জেগে ওঠে।।
চেনাশোনার কোন বাইরে,
যেখানে পথ নাই নাই রে
সেখানে অকারণে যায় ছুটে।।’
মনের মতো ভিজলাম বৃষ্টির শীতল ঝরনা ধারায়। কারণ জায়গাটা ম্যানহাটন। ভয় নেই কেউ কিছু বলার। কোথাকার কোন এক বৃষ্টি পাগল বাঙালি ললনা ঝমঝম বৃষ্টির শব্দে নিজেকে হারিয়ে পাগল হয়ে উঠেছে, তাতে নিউইয়র্কবাসীর কারও কোনো মাথা ব্যথা বা ভ্রুক্ষেপ নেই। বরং অবাক হয়ে দেখলাম আমার পাগলামি সংক্রামিত হলো অনেক উৎসুক দর্শকের মধ্যেও। অফিস ফেরত ক্লান্ত অনেকেই কুণ্ঠাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নেমে পড়ল বৃষ্টির উতলধায়ায় অবগাহন করতে।
খানিকক্ষণ বৃষ্টিস্নান করে ভেজা জবুথবু শরীরে উঠে পড়লাম আপ টাউনগামী ডব্লিউ ট্রেনে। সহযাত্রীরা সরে গিয়ে জায়গা করে দিল দাঁড়াবার। ধরেই নিল আমি ছিলাম হঠাৎ বৃষ্টিতে ছাতা ছাড়া একজন নিরীহ পথচারী। কেউ কেউ সহানুভূতির সঙ্গে শ্লাগ করল, “ওয়াও! হোয়াট অ্যা ডে।” সহানুভূতির তোড়ে ঢাকা পড়ে গেল আমার পাগলামির ইতিহাস।
অনেক দিন ধরেই আমি ম্যানহাটনের মেডিসন স্কয়ারের একটি স্টুডিওতে যাই ইয়োগা করতে। সেই ২০১০ সালে আমার ইয়োগায় হাতেখড়ি হয়েছিল। খুব কাছের এক বন্ধুর অনুপ্রেরণায় আমার ইয়োগা লাইফের শুরু। ইয়োগা করা শুরুটাও হয়েছিল এই স্টুডিও থেকেই। ফ্ল্যাট আয়রন বিল্ডিংয়ের পাশেই এই ইয়োগা স্টুডিওটি। আমি তাদের বহু পুরোনো, একনিষ্ঠ, ইয়োগা প্রেমিক, একমাত্র বাঙালি সদস্য।
ফ্ল্যাট আয়রন হলো নিউইয়র্কের একটি আইকনিক বিল্ডিং। এই বিল্ডিংয়ের সামনে খোলা চত্বর, মেডিসন স্কয়ার পার্ক, ফিফথ অ্যাভিনিউ, সিক্সথ অ্যাভিনিউ এবং ক্রমাগত হেঁটে গিয়ে ফোরটিন অ্যাভিনিউতে ইউনিয়ন স্কয়ার পার্কটি ছিল আমার পদযাত্রার প্রিয় স্থান।
আবহাওয়া ভালো থাকলে প্রায়ই আমি ইয়োগা শেষে এসব জায়গা চষে বেড়াতাম। এমনকি টুয়েন্টি থার্ড স্ট্রিট থেকে হাঁটতে হাঁটতে চলে যেতাম ওয়াশিংটন স্কয়ার পার্কে। আমার অন্যতম একটি ভালোবাসার জায়গা এই পার্কটি। ওয়েস্ট ভিলেজের এই পার্কটির চরিত্র খুব বিচিত্র। এখানে নানা রঙের, নানা রুচির বিচিত্র সব মানুষের সমাগম ঘটে। নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ, প্রাণবন্ত ছাত্রদের নিরবচ্ছিন্ন আড্ডা চলে রাত্রির অন্ধকার নেমে আসার আগ পর্যন্ত। এটি পুরোপুরিভাবে একটি ফান এলাকা। এখানে আনন্দের কোনো সীমা পরিসীমা নেই। এসব জায়গায় এলে আমি আমার বয়সের সংখ্যা ভুলে যাই। মানুষের তারুণ্য যেন আমার মাঝেও সংক্রামিত হয়। বয়সের সংখ্যাগুলো ধাপে ধাপে নিচে নামতে শুরু করে। ভেতরের চির তরুণ আমিটা জেগে ওঠে।
নিউইয়র্ককে বলা যায় ‘সিটি অব লাভ’। এই নগরী আসলেই মানুষকে ভালোবাসতে শেখায়। বিশেষ করে নিজেকে ভালোবাসতে। ‘মি টাইম’ উদ্যাপন করতে। নিউইয়র্কে এসে আমি যেন নতুন করে নিজেকে ভালোবাসতে শিখেছি। প্রাণ খুলে হাসতে শিখেছি। স্বাধীন হতে শিখেছি। তাই আমি ইয়োগা করি, শহরের অলিগলিতে হেঁটে বেড়াই। শহরটির সঙ্গে নিজেকেও আবিষ্কার করি। এই আবিষ্কার পরম আনন্দের। এই আনন্দ সম্পূর্ণ নির্দোষ। কাউকে কষ্ট দিয়ে নয়। কারও পেছনে কারও নামে কথা বলে নয়। এই আনন্দে কোনো টিন তৈরি হয় না, বরং ভেতরে জমে থাকা টিন বের হয়ে যায়। ফ্রেশ অক্সিজেনে ভরপুর হয় হৃদয় ও ফুসফুস।
কিন্তু মহামারি এসে হানা দিয়েছে আমাদের এই আনন্দময় জীবনে। সবকিছু কেমন ওলটপালট হয়ে গেছে। বইমেলায় অংশ নিতে গিয়ে লকডাউনে আটকা পড়েছিলাম ঢাকায়। ঢাকায় বসে শুনলাম, আমার ছোট ছেলেটি কোভিড আক্রান্ত। প্রাণ যাই যাই করছিল। কেবলই ছটফট করছিলাম নিউইয়র্কে ফিরে আসার জন্য। মনে হচ্ছিল, এসেই ঝাঁপিয়ে পড়ব আমার প্রাত্যহিক জীবনে। নিজ হাতে রান্না করে ছেলেকে খাওয়াব। প্রাণ ভরে শ্বাস নেব। বুক ভরাট করব বিশুদ্ধ অক্সিজেন দিয়ে। কিন্তু বিধি বাম। এসেই করোনার প্রবল থাবায় নিজেও শয্যাশায়ী হয়ে পড়লাম। আবারও আইসোলেশনে অবরুদ্ধ হলো জীবন। ধীরে ধীরে সুস্থও হলাম। করোনা মুক্তির সনদ হাতে এল। বাইরে বের হয়ে বড় বড় নিশ্বাস নিলাম। দম ছাড়লাম। আবারও দম নিলাম। আহা, মুক্তির কী আনন্দ!
কিন্তু অনুভব করলাম, নিউইয়র্কও কেমন যেন বদলে গেছে। এমন থমকে যাওয়া, এমন ঝিমিয়ে পড়া, বিষণ্ন নিউইয়র্ক সিটিকে আমি কখনো দেখিনি। নিজেও যেন আর আগের সেই আমি নেই। ছয় মাসের লকডাউন আর আইসোলেশনে গৃহবন্দী থেকে থেকে আমার ওজন বেড়েছে কয়েক গুণ। ১২০ পাউন্ড থেকে আমি এখন ১৩৬ পাউন্ডে পরিণত হয়েছি। বাড়তি ১৬ পাউন্ড কী করে ওড়াব সেই দুশ্চিন্তায় অস্থির।
দমে না গিয়ে, মহা উৎসাহ নিয়ে নতুন পরিকল্পনা তৈরি করলাম। ইতিমধ্যেই ফল বিদায় নিয়ে সামার শুরু হয়ে গেল। ভাবলাম সকাল বিকেল দুই বেলাই হাঁটতে শুরু করব। পরিকল্পনা মাফিক হাঁটতেও বের হই। কিন্তু লক্ষ্য করলাম, সামারের ঝকঝকে তীব্র রোদ সহ্য করার মতো শক্তি আমার দেহ হারিয়ে ফেলেছে। একটু হাঁটলেই আমার বুক ধড়ফড় করে। আমি ঘেমে নেয়ে উঠি। বড় বড় শ্বাস নিই। বসার জায়গা পেলেই ধপ করে বসে পড়ি। পিপাসায় গলা বুক শুকিয়ে চৌচির হয়ে যায়।
অথচ খুব বেশি দিন আগের কথা নয়, মাত্র ছয় মাস আগেও আমি কী নিবিড়ভাবেই না অভ্যস্ত ছিলাম এই জীবনে। এমনকি সকাল, বিকেল, ঝড়, বৃষ্টি, বরফেও আমি থমকে যেতাম না। ছুটতাম দুর্নিবার বেগে। ছুটে চলাই ছিল আমার জীবন। এখন কেমন যেন একটা স্থবিরতা এসে ভর করেছে শরীরে, মনে। ট্রেনে উঠে ম্যানহাটন যেতেও আমার মনে ভয় কাজ করছে। অথচ কুইন্স আমার ঘর হলে ম্যানহাটন ছিল আমার খোলা বারান্দা। প্রতিদিন আমি সেখানে যেতাম কাজ করতে, ইয়োগা করতে, প্রাণ ভরে নিশ্বাস নিতে। এখন এই করোনার জন্য মাস্ক পরে, গ্লাভস হাতে দিয়ে, রেডি হয়ে ঘর হতে বের হতেই আমার নাভিশ্বাস ওঠে।
দেখতে দেখতে আবারও আরেকটি ঈদ চলে এল। রাত পোহালেই ঈদ। ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ। মহামারিকালের এই কোরবানির ঈদ কী পারবে মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে? ইতিমধ্যেই অনেক বুক খালি হয়েছে, অনেক ঘর শূন্য হয়ে গেছে। অনেকেই হাসপাতালে বা ঘরে আইসোলেশনে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন। অনেক মানুষ কর্মহীন, হাতে টাকা নেই। মাথার ওপর ছাদ নেই। তাঁদের ঘরে কী ঈদের আনন্দ পৌঁছাবে? তবুও ঈদ হবে। আমরা পশু কোরবানি করব। কিন্তু আমাদের ভেতরের লালিত পশুটা ঠিকই অক্ষত রয়ে যাবে।
এভাবেই ফেসবুক মেমোরি নিরলসভাবে আমাদের স্মৃতিগুলো ক্রমাগত জমা করে রাখবে। আবার আগামী দিনে স্মরণ করিয়ে দেবে করোনাকালীন এই জীবন। এই মহামারি দুঃস্বপ্নের মতোই আমাদের তাড়িত করবে। ভয়াবহ বেদনার এই স্মৃতিগুলোর সঙ্গে কিছু কিছু সুখের স্মৃতি হয়তো আমাদের বাঁচিয়ে রাখবে।