বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য অপসারণে ঔদ্ধত্বপূর্ণ বক্তব্যের প্রতিবাদে উদীচীর বিবৃতি

বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য অপসারণে ঔদ্ধত্বপূর্ণ বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়েছে উদীচী যুক্তরাষ্ট্র। এক বিবৃতির মাধ্যমে এই প্রতিবাদ জানায় সংগঠনটি।

বিবৃতিতে বলা হয়, বেশ কিছুদিন ধরে স্বাধীনতাবিরোধী মৌলবাদী গোষ্ঠী স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধকে কটাক্ষ করে সাম্প্রদায়িক উসকানি সৃষ্টি করে চলেছে। সম্প্রতি বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য অপসারণের যে হুংকার তারা দিয়েছে, তা স্বাধীন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার শামিল। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে মীমাংসিত প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় নীতিকে চ্যালেঞ্জ করে ধর্মান্ধ গোষ্ঠী পরাজিত পশ্চাৎপদ পাকিস্তানি নীতিকে প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্র করছে। তারই অংশ হিসেবে সম্প্রতি এই গোষ্ঠী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য অপসারণের দাবি জানিয়েছে, যা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রগতিশীল নীতি, স্বাধীনতা ও লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত সংবিধানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার শামিল।

বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী যুক্তরাষ্ট্র সংসদের পক্ষ থেকে উগ্রবাদী ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর এমন হুংকারের তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলা হয়, এমন নগ্ন আস্ফালনের পরও সরকারের নীরবতায় আমরা লজ্জিত। সম্প্রতি ইসলামি আন্দোলনের সিনিয়র নায়েবে আমির, চরমোনাই পির মোহাম্মদ ফয়জুল করীম ও খেলাফত মজলিশের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব ও হেফাজতে ইসলামের নেতা মামুনুল হক প্রকাশ্যে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যকে উপড়ে বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দেবেন বলে হুংকার দিয়েছেন। দেশ যখন স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর দ্বারপ্রান্তে, দেশে যখন বঙ্গবন্ধুর শততম বার্ষিকী উদ্‌যাপিত হচ্ছে, তখন ধর্মান্ধ শক্তির এমন হুংকার স্বাধীনতার মৌলচেতনায় বিশ্বাসী মানুষকে তীব্র আঘাত করেছে। স্বাধীনতা, প্রগতিকামী, গণতান্ত্রিক ও উদার সংস্কৃতি বোধসম্পন্ন দেশপ্রেমিক জনতা আজ উদ্বেগ ও বিপন্নবোধ করছে। ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক কূটকৌশলের সুযোগ নিয়ে, এমনকি ক্ষমতাসীনদের মদদ ও পৃষ্ঠপোষকতায় আজ এ গোষ্ঠী বিষবৃক্ষে পরিণত হয়েছে। বলা চলে, নিজ হাতে গড়া দৈত্যই আজ টুঁটি চেপে ধরতে চাইছে।

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও নীতি ভুলে ক্ষমতার স্বার্থে এ ধর্মান্ধ গোষ্ঠীকে বারবার রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছে এযাবৎকালের সবগুলো সরকার ও শাসকগোষ্ঠী। স্বৈরাচারী সামরিক শাসক জিয়া ও এরশাদের হাত ধরে মুক্তিযুদ্ধের সংবিধানের সাম্প্রদায়িকীকরণ ঘটেছে। সেই ধারাকে বিনা প্রশ্নে হৃষ্টপুষ্ট করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। অথচ মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী এ দলের কাছেই বাংলাদেশ, তার সংবিধান ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক অগ্রসরতা নিরাপদ থাকবে বলে ভেবেছিল বাংলাদেশের মানুষ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা ঘটেনি। এ গোষ্ঠী বরাবরই এ দেশের গণতন্ত্র, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, মুক্তচিন্তা, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও ধর্মনিরপেক্ষ নীতির বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে সভা-সমাবেশ করেছে। হত্যা করেছে বহু প্রগতিশীল লেখক, বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিপ্রেমীদের। বাংলার বৈচিত্র্যপূর্ণ জাতি-ধর্ম-বর্ণ সমন্বয়ে গড়ে ওঠা সমন্বয়বাদী সংস্কৃতির বিরুদ্ধে উগ্র বক্তব্য-বিবৃতি দিয়ে বারবার পার পেয়েছে তারা। কোনো সরকারকেই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। এবার তারা আঘাত করতে চাইছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যকে।

বিবৃতিতে বলা হয়, এই দেশে বাঙালি ও অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর লড়াইয়ের গৌরবপূর্ণ ইতিহাস রয়েছে। ভাস্কর্য ও শিল্পকলার মধ্য দিয়ে সেসব ইতিহাসকে আমরা প্রজন্মান্তরে রেখে যেতে চাই। শিল্পকলা দর্শন ও পাঠের মধ্য দিয়ে জাতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে জানার দরজা খুলে দিতে চাই। এটাই প্রগতির শর্ত। অথচ ধর্মান্ধ গোষ্ঠী প্রগতির এ যাত্রাকে রুদ্ধ করতে বারবার উদ্ধত হয়েছে। এখনো তাদের আস্ফালন টিকে আছে কেবল ক্ষমতাবলয়ের আশ্রয়ে। অবিলম্বে এসব মৌলবাদী জঙ্গিগোষ্ঠীকে আইনের আওতায় এনে যথোপযুক্ত বিচারের ব্যবস্থা করার দাবি জানাচ্ছে উদীচী যুক্তরাষ্ট্র। সেই সঙ্গে ইতিহাস, সংস্কৃতি ও জাতীয় চেতনার বিরুদ্ধে ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্রকে প্রতিহত করার আহ্বান জানাচ্ছে।