প্রতিদিনের মতো ভোর ছয়টায় রূপসজ্জার রুমে (লা গুয়ার্ডিয়া বিমানবন্দরের লেডিস বাথরুমের ড্রেসিং রুমে) আয়নায় দাঁড়িয়ে প্রসাধন নিচ্ছিলাম। সামনের বড় আয়নায় দেখলাম, একজন লেডি ক্যাপ্টেন খুব দ্রুতগতিতে ঢুকে বাথরুমে গেলেন। সম্ভবত অনেকক্ষণ ফ্লাইটে ছিলেন এবং নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে রেখেছেন। প্রায়ই দেখি যারা ফ্লাইটে কাজ করেন, তারা এমন হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসেন। সঙ্গে সঙ্গেই কানে এল কমোডে নির্গত জলপ্রবাহের শব্দ, আমার বুকের ভেতর যেন কেঁপে উঠল! কারণ একটা উচ্চ অবস্থান থেকে পুরুষরাই এমন শব্দে ছোট কর্মটি সারতে পারেন, মেয়েরা নয়।
এই নিউইয়র্ক শহরে চলতে চলতে নতুন পরিবেশে নিজেকে অনেক কিছুর সঙ্গে পরিচিত করে তুলেছি, মানিয়ে নিয়েছি নিজস্ব বুদ্ধিমত্তা দিয়ে। তবু কিছু অযাচিত চরিত্র মনে চাঞ্চল্য তৈরি করে। অনভ্যস্ত চোখেমুখে অজান্তে ফুটে উঠতে চায় আশ্চর্যবোধক চিহ্ন! মানুষকে জানার তীব্র ইচ্ছা বা আগ্রহ লেখকসত্তার কোন বৈশিষ্ট্য কি না জানি না, তবে খারাপ উদ্দেশ্যে গন্ধ শোঁকা নয়। বেরিয়ে এলে আমি ঘুরে গভীর চোখে দেখে নিলাম। উনি অনেক সুন্দরী, ফরসা মুখে মেয়েলি ছাপ বিদ্যমান। যাক বিষয়টা আমার মাথায় ক্লিক করল, বুঝলাম উনি ট্রান্সজেন্ডার বা লিঙ্গ রূপান্তরিত নারী। প্রথম দিন কাউন্টারে একজনকে দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম। তারপর ফ্লোরিডা থেকে আসার পথে ট্রেনে আমাদের পাশের আসনে দুটি মেয়ে ছিল, তারা শুধু বান্ধবী। দেখা আর জানার মধ্যে অনেক তফাত আছে। আমি অন্তত দশজনকে জিজ্ঞেস করেছি, যার মধ্যে আটজন বিদেশি, তারা তেমন কিছুই জানেন না বা জানলেও তা আবছা বা সমকামিতামূলক ধারণা। দুজন দেশির দুজন জানেন না কিছু।
আমার মেয়ে ২০১৫ সালে একজন সেলিব্রেটির (ক্যাটলিন জেনার) লিঙ্গ পরিবর্তনের আলোচনা প্রসঙ্গে আমাকে বিষয়টি সম্পর্কে বলেছিল। এই লিঙ্গান্তর বা ট্রান্সজেন্ডারকে আপাতদৃষ্টিতে মানে করলে মনে হয়, লিঙ্গের পরিবর্তন। পরিবর্তন বটে, কিন্তু পুরো বিষয়টার পরিবর্তন এবং সবার ক্ষেত্রে পুরো পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব হয় না। ইংরেজি ডিকশনারির সংজ্ঞা অনুযায়ী মানে করলে দাঁড়ায়, ‘এটা এমন ব্যক্তির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, যে কি না তার স্ব-পরিচয় পুরুষ বা মহিলা লিঙ্গের প্রচলিত ধারণার সঙ্গে একমত না।’ সহজভাবে বললে বলা যায়, একটা ছেলে বা মেয়ে জন্ম নেয় যে শরীর নিয়ে, সে সেটা গ্রহণ করতে রাজি নয়। কারণ সে মনে করে সে একটা ভুল দেহ নিয়ে জন্মেছে। তার বিপরীত লিঙ্গ হওয়ার কথা। ট্রান্সজেন্ডাররা তাদের পরিস্থিতি নিয়ে খুব উদ্বিগ্ন থাকে, অসন্তুষ্ট থাকে, যাকে ইংরেজিতে Dysphoria বলা হয়। অনেকে পোশাক–আশাকে, চললে–বলনে বিপরীত লিঙ্গ মেনে চললেও অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে যৌনাঙ্গের পরিবর্তন সবার পক্ষে সম্ভব হয় না। কারণ এটা যেমন ব্যয়বহুল, তেমন বেদনাদায়ক ও জটিল। এরা জৈবিকভাবে জন্মগ্রহণ করে ছেলে বা মেয়ে হিসেবে, তাদের মন-আত্মা পুরোপুরি নিজেকে অন্য লিঙ্গের মানুষ ভাবে। এটা হিজড়া দেহের সঙ্গেও সম্পর্কিত নয়। গবেষণা বলে যে, ব্রেইনের ডেভেলপে ফেমেনিন হরমোন বেশি উৎপাদিত হয় বলে তারা ছেলে হয়েও নিজেকে মেয়ে মনে করে, আবার মাসকুলিং হরমোনের জন্য মেয়ে হয়েও নিজেকে ছেলে বলে ভাবে।
বিষয়টি সহজভাবে বোঝার জন্য বিখ্যাত টিনএজার সেলিব্রেটি জ্যাজ জেনিংসের জীবনী সংক্ষেপ বলছি। জ্যাজ আমেরিকার ইউটিউব ও টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব এবং এলজিবিটি অধিকারকর্মী। তিনি সর্বজনীনভাবে নথিভুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে একজন যিনি ট্রান্সজেন্ডার হিসেবে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব ও সমাজের সর্বস্তরে বিষয়টিকে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে বদ্ধপরিকর। তিনি ২০০০ সালের ৬ অক্টোবর দক্ষিণ ফ্লোরিডায় ছেলে হিসেবে জন্ম নেন। তাঁর নাম ছিল ‘জ্যার্ড’ কিন্তু তিনি নিজে ‘জ্যাজ’ বলতেন এবং তার মা তাঁকে এ নামেই ডাকতে শুরু করেন। জ্যাজ বলেন, তিনি যখন মাত্র দুই–তিন বছর বয়সের, তখন থেকেই তিনি মনে করতেন তিনি ছেলে নয়, মেয়ে। সে বয়সে মা তাকে বলেছিলেন, গুড বয়, উনি কান্না জুড়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘say good girl, I am not a boy’, পাঁচ বছর বয়সে তিনি নিজেকে মেয়ে হিসেবে তুলে ধরেন।
প্রথম দিকে গুরুত্ব না দিলেও ছয় বছর বয়সে মা-বাবা তাকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান। সব সময় মেয়েদের পোশাক বেছে নিতেন। নিজের হাতে মৎস্যকন্যার পোশাক (লেজ) তৈরি করে সাঁতার কাটতেন। তিনি মাকে বোঝাতে সক্ষম হন, তিনি একটা ভুল দেহ নিয়ে জন্মেছেন, তিনি আসলে মেয়ে। জ্যাজের মা-বাবা যেমন আধুনিক তেমন বিত্তশালী। মাত্র ১১ বছর বয়সে তার বয়ঃসন্ধি পরিবর্তন বন্ধ করার চিকিৎসা দেন এবং ১২ বছর বয়সে তাঁর হরমোন পরিবর্তন করা হয়। এতে তাঁর চেহারা এবং বুক স্বাভাবিক মেয়েলি গড়নে বৃদ্ধি পায়। স্কুলজীবনে তিনি অনেক সমস্যার সম্মুখীন হন। ব্যাপারটা অনেকে সহজভাবে নিত না। তিনি জেদ করেই মেয়েদের দলে অংশ নিয়ে সকার খেলতেন। সাধারণত এ ধরনের বৈশিষ্ট্যের মেয়েরা মেয়ে বাথরুম ব্যবহার করে। তিনিও করতেন। তবে তখনো তাঁর শরীরের যৌনাঙ্গটি পুরুষের। এই লেখার শুরুতে উল্লেখ করা ক্যাপ্টেনের ক্ষেত্রেও এমনটাই প্রযোজ্য। তিনিও মনেপ্রাণে নিজেকে মেয়ে ভাবেন, কিন্তু তাঁর বিশেষ অঙ্গটা পুরুষের।
তারপর জ্যাজ ১৬ বছর বয়সে মা-বাবাকে সঙ্গে নিয়ে নারী যৌনাঙ্গ প্রতিস্থাপনের জন্য চিকিৎসকের সঙ্গে আলোচনা করতে যান। আলোচনায় চিকিৎসক পুরো ব্যাপারটা তাঁকে বুঝিয়ে বললেন এবং সেই সঙ্গে এটাও বললেন যে, এটি খুবই ব্যথাদায়ক প্রক্রিয়া। টিস্যু এক্সপান্ড করার জন্য একটি সুচালো এক্সপান্ডার দীর্ঘদিন তাকে বহন করতে হবে, যা শুনে তিনি কেঁদে ফেলেন। কিন্তু তিনি নিজের এ লিঙ্গান্তরের জন্য নিজের সঙ্গে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ২০১৬ সালে তাঁর সফল অস্ত্রোপচার হয়। তাঁর একজন ছেলেবন্ধু আছে এবং তিনি ভবিষ্যতে মা হওয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন।
এই লিঙ্গ পরিবর্তন একটা ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া, তাই সবাই কিন্তু পরিবর্তন করে না। তা ছাড়া বয়সসহ আরও অনেক কিছু অনুকূল থাকে না। জ্যাজ তাঁর এক গরিব বন্ধুর জন্য ফ্লোরিডার পথে বন্ধুদের নিয়ে গাড়ি ধুয়ে দানের অর্থ সংগ্রহ করেন। এক বিকেলে বক্সে প্রায় হাজার ডলার পান। এভাবে ৮/১০ বাক্স হয়ে যায়। অনেকে খুশি মনে ৫০/১০০ ডলার দিলেও এক চালক বিরূপ মন্তব্য করেন, তখন তিনি খুব রাগান্বিত হয়ে বলেন, ‘এটা আমাদের দেহ, আমাদের মন আমরা বুঝব কী করতে হবে? তুমি উৎসাহিত করতে না পার, দান না করো, অন্তত নিরুৎসাহিত করো না’। তারা শুধু মেনে নিতে পারে না দেহটা, মনে মনে অসন্তুষ্টি, ভয় থাকে। কিন্তু জীবনযাপন করে বিপরীত লিঙ্গের মতো। সাধারণ লিঙ্গন্তরিতদের জীবনও এ রকম। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে পারিবারিক সমর্থন থাকে না বরং নির্যাতন সহ্য করতে হয়। যারা বড় হয়ে করে তাদের দৈহিক গঠন অনেক সময় চোখে পড়ে। যেমন দেহ পুরুষালি কিন্তু স্তন উন্নত, চুল দীর্ঘ, পোশাক মেয়েদের।
গবেষণায় দেখা গেছে, ট্রান্সজেন্ডাররা বেশ মেধাবী হয়। জ্যাজের সঙ্গে এক আলোচনায় বিশ্বের বেশ কয়েকজন চিকিৎসক, গবেষক অংশ নেন। তাঁদের মধ্যে ট্রান্সজেন্ডারও ছিলেন। আটলান্টার গবেষক জিনিয়া জোনস নিজে একজন লিঙ্গান্তরিত মহিলা ও সন্তানের মাতা। তাঁদের আলোচনার বিষয় ছিল, ‘Is Gender Dysphoria is a passing phase?’
ছোটবেলায় এমনটি ভীতিমূলক মনে হলেও বড় হতে হতে তা মন থেকে চলে যায়। এ মর্মে আমি ছোট্ট একটি ঘটনা বলতে পারি। আমার এক বান্ধবীর ছোট বোন তাকে সব সময় ছেলে হিসেবে উপস্থাপন করত, বাসায় নতুন কেউ এসে তার নাম জিজ্ঞেস করলে বলত কি...আলী। যারা জানতেন, তাদের কোনো ভাই নেই, কবে তাঁদের ছেলে হলো? তারা একটু ধরা খেতেন, সে থাকতও ছেলেদের মতো। এ রকম অনেক বাচ্চা আমাদের দেশেও আছে। কিন্তু যেহেতু কড়া শাসনের মধ্যে আমরা বড় হয়, বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এ সব আদিখ্যেতা চাপা পড়তে বাধ্য। এ আলোচনায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সুজান ব্র্যাডলি (Dr. SuSan Bradley, The Clark institute Canada) বলেন, এ জন্য ছোট বেলায় কোনো চিকিৎসা না নেওয়া ভালো। কারণ এ সময় চলে গেলে নিজের দেহের সঙ্গে মনকে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা তৈরি হতে পারে। যদিও তাঁর কথার তীব্র প্রতিবাদ করেছেন জ্যাজ, কেন আমি একটা ভুল জীবনযাপন করব? ডা. সুজান বলেন, ৮৫ ভাগ জেন্ডার ডিসফোারিয়া (gender Dysphoria) থেকে লিঙ্গান্তরিত হন, বাকি ১৫ ভাগ অনেক ক্ষেত্রে সমকামিতার জন্য চলনে–বলনে বদলে যান। তবে এ ক্ষেত্রেও অনেকে অস্ত্রোপচারের শরণাপন্ন হন। ভারতে যেহেতু বিষয়টা গ্রহণযোগ্য নয়, তাই এক ছেলে তার লিঙ্গ পরিবর্তনের টাকা সংগ্রহের জন্য খুন করে।
আবার বিপরীত দিক থেকে যদি লক্ষ্য করি, তবে কি দেখব? তা কি চলে যায়? জ্যাজ কি ঠিক বলেছেন? যেমন অভিনেত্রী সেইটলিন জেনারস একজন পুরুষ হিসেবে তাঁর জীবনের অধিকাংশ সময় কাটানোর পর ২০১৫ সালে লিঙ্গান্তরিত হন। তিনি ছয় সন্তানের জনক, আর্থিক ও দুনিয়া জুড়ে সফল একজন মানুষ। [William Bruce Jenner, October 28, 1949 (age 69) New York , U.S.]
মডেল কেন্ডাল জেনার সেইটলিনের মেয়ে। শোনা যাচ্ছে তাঁর বন্ধু সোফিয়া নামে আরেক লিঙ্গান্তরিত মেয়েকে বিয়ে করতে যাচ্ছেন। তাঁর থেকে ৪৭ বছরের ছোট। অনেকে বলছেন টাকার জন্য এ মেয়ে এসব করছে। তবে উনি যৌনাঙ্গ প্রতিস্থাপনে সক্ষম নন। পশ্চিমা এই দেশে ৭০ জন লিঙ্গান্তরিত অভিনেতা-অভিনেত্রী আছেন। সাধারণদের আমরা চলতে ফিরতে পাই।
যাই হোক, বিষয়টি অনেক জটিল, বিশাল ও গভীর। আমি অন্তত ২৫টি ইউটিউব ভিডিও দেখেছি, অনেক গবেষণাপত্র পড়েছি, মনোযোগ কাড়ার মতো আকর্ষণীয় বিষয় এটি। এর গভীরে না গেলে তা কারও হৃদয় স্পর্শ করতে পারবে না। কারণ সব মানুষই বিনা কারণেই অস্বাভাবিকতা অপছন্দ করে। পৃথিবীতে মানব মন আসলেই এক রহস্যের আধার, তাতে মানুষ নানাভাবে তাড়িত হয়। জ্যাজের ভাষ্য অনুয়ায়ী, তিনি এটিকে সমঅধিকার দিতে চান। সব লিঙ্গের মতো সর্বক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবে দেখা হোক। সমাজের প্রতি তার আহ্বান, মানুষের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ুক, যেন কেউ তাদের ঘৃণার চোখে না দেখে। কেন সে অন্য একজনের দেহ বয়ে বেড়াবে? একটু গভীর ও সহজভাবে যদি আমরা ভাবি, তাহলে অনুভব করব, বিষয়টা তো মিথ্যে নয়!
যেমন এখন যদি আপনাকে কেউ ঐশ্বরিয়া রায়, টম ক্রুজ, সালমান খানের দেহ দিয়ে দিল। কিন্তু আপনি জানেন আপনি কে? আপনি কি সুখী হতে পারবেন? তাই ঘৃণা নয়, যে যেভাবে বাঁচতে চায়, তাকে সেভাবে বাঁচতে দিন।