বাইডেনের জন্য বন্ধুর পথ রেখে যাচ্ছেন ট্রাম্প

ডোনাল্ড ট্রাম্প ও জো বাইডেন
ছবি: এএফপি

ডেমোক্র্যাট শিবির এখন আঙুলের কর গুনছে। প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প আর কদিন আছেন, প্রতিনিয়ত তার গণনা চলছে। তারপর হাঁপ ছেড়ে বাঁচার পালা। আর ঠিক এক সপ্তাহের মাথায় ট্রাম্প ক্ষমতা থেকে বিদায় নেবেন। ট্রাম্প বিদায় নিলেও তিনি ঘরে-বাইরে যে পরিস্থিতি রেখে যাচ্ছেন, তা সামাল দেওয়া নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের জন্য কঠিনই হবে।

করোনায় যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থা জেরবার। দেশটিতে ২ কোটি ৩৩ লাখের বেশি মানুষ করোনায় সংক্রমিত। প্রাণ গেছে ৩ লাখ ৯০ লাখের বেশি মানুষের। শুরু থেকেই করোনার ভয়াবহতাকে অবজ্ঞা-অবহেলা করে আসছেন ট্রাম্প। করোনা মোকাবিলায় বিজ্ঞানী-বিশেষজ্ঞদের মতামতকে করেছেন উপেক্ষা।

৩ নভেম্বরের নির্বাচনের আগ থেকে শুরু করে তিন-চার মাস ধরে ট্রাম্পের রাষ্ট্রীয় কাজে মন নেই। শেষের দুই মাস তো তিনি ভোট জালিয়াতির ভুয়া অভিযোগ, মামলাবাজি করেই কাটালেন। এদিকে এ সময়েই যুক্তরাষ্ট্রে করোনা পরিস্থিতি মারাত্মক রূপ নিয়েছে। ফলে টিকা দেওয়া শুরু হলেও দেশটিতে এখনো প্রতিদিন বিপুলসংখ্যক মানুষ সংক্রমিত হচ্ছেন এবং মারা যাচ্ছেন। তা ছাড়া টিকাদানের কার্যক্রম আশানুরূপ গতি পায়নি।

জো বাইডেন যাতে দায়িত্বের প্রথম দিন থেকেই কাজে লেগে পড়তে পারেন, সে জন্য তিনি জয়ের পরপরই ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া শুরুর দাবি জানিয়েছিলেন। কিন্তু ট্রাম্প নিজেকে নির্বাচনে জয়ী দাবি করে এ প্রক্রিয়া বিলম্বিত করেছেন। বাইডেন সে সময়ই আশঙ্কা করেছিলেন, এই বিলম্ব, এই অসহযোগিতা বড় ক্ষতির কারণ হবে। বিশ্বে করোনার সংক্রমণ-মৃত্যুতে সবার শীর্ষে থাকা যুক্তরাষ্ট্রে এই মহামারির অবসান ঘটানোর মতো এক গুরুভার বাইডেনের কাঁধে চাপছে। পাশাপাশি অর্থনীতিসহ করোনার অন্যান্য ক্ষতি কাটানোর দায়িত্বও তাঁকে নিতে হবে। এ কাজ করাটাই হবে তাঁর প্রশাসনের প্রথম ও সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

ট্রাম্প তাঁর ক্ষমতার এক মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে বিভেদ, বিভক্তি, ঘৃণার বিষবাষ্প অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন। তার ফল যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যে ভোগ করছে। নতুন প্রশাসন এলে অবস্থার আশু পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই; বরং ট্রাম্পের লাগানো বিষবৃক্ষ ডালপালা ছড়াবে। ফলে এই সামাজিক ক্ষত বহু দিন থাকবে। ভোগ করতে হবে তার নেতিবাচক ফল।

স্বাস্থ্যসেবা, অভিবাসনের মতো গুরুত্বপূর্ণ অভ্যন্তরীণ নীতির ওপর খড়্গহস্ত চালিয়েছেন ট্রাম্প। এ অবস্থার পরিবর্তনে বাইডেনের প্রতিশ্রুতি আছে। তাই এ নিয়ে তাঁকে কাজ করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক প্রতিষ্ঠানকে দুর্বল করেছেন ট্রাম্প। সেগুলোকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে বাইডেনকে।

রাজনীতিকেও কলুষিত করেছেন ট্রাম্প। তিনি দেশটির বহু বছরের রাজনৈতিক রীতি, নীতি, শিষ্টাচার, ঐতিহ্য, সাংস্কৃতিকে ভূলুণ্ঠিত করে অসংখ্য বাজে উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর রাজনীতিতে ক্ষমতার অপব্যবহার, মাফিয়াতন্ত্র, দুর্বৃত্তায়ন, হানাহানি নিয়ে যে যুক্তরাষ্ট্র সব সময় উচ্চকিত থাকে, সেই তারাই আজ ট্রাম্পের কারণে এসবের সাক্ষী।

নির্বাচনে পরাজয় না মেনে, ফলাফল উল্টে দিতে ট্রাম্প তাঁর উগ্র সমর্থকদের দিয়ে ৬ জানুয়ারি দেশটির কংগ্রেস ভবনে হামলা চালিয়ে যে ন্যক্কারজনক নজির স্থাপন করেছেন, তার তুলনায় খোদ রিপাবলিকান রাজনীতিকেরাই ‘বানানা রিপাবলিক’ প্রসঙ্গ টানছেন। গণতন্ত্র সমুন্নত রাখতে, ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ হস্তান্তর নিশ্চিত করতে আজ যুক্তরাষ্ট্রকেই অন্যদের বিবৃতি শুনতে হচ্ছে।

ট্রাম্প চলে গেলেই যে যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের ঐতিহ্য ফিরে আসবে, তেমনটা মনে করার কারণ নেই। কারণ, তিনি তাঁর নৈরাজ্যবাদী চেতনা রেখে যাচ্ছেন। তাঁর এই চেতনা ধারণ করে তা চর্চা করার লোকও অনেক তৈরি হয়ে গেছে। ফলে ট্রাম্পবাদ সহজে যাচ্ছে না। ক্ষমতায় না থাকলেও ট্রাম্পকে মোকাবিলা করতে হবে বাইডেনকে।

কূটনীতির মাঠও বাইডেনের জন্য সহজ হবে না। বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব-প্রতিপত্তি আর আগের মতো নেই। ট্রাম্প জামানায় বিশ্বমঞ্চে ক্ষমতার লড়াইয়ে যুক্তরাষ্ট্র অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছে। অন্যদিকে, প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিপক্ষ রাশিয়া ও চীন। সম্প্রতি সিএনএনের এক বিশ্লেষণে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে চীন নির্বিঘ্নে তার ভূরাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। শুধু চীন নয়, ট্রাম্পের দুর্বলতার সুযোগ রাশিয়াও নিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র বলে পরিচিত, ইউরোপের এমন অনেক দেশকে দূরে ঠেলে দিয়েছেন ট্রাম্প। এই সম্পর্ক পুনর্গঠন করতে বাইডেন প্রশাসনকে খাটতে হবে। হুট করেই সম্পর্ক পুনর্গঠন সম্ভব হবে না। তা ছাড়া রাশিয়া, চীন, ইরান, ফিলিস্তিনি, ইসরায়েল, ইয়েমেন, সিরিয়া, আফগানিস্তান, তাইওয়ান, কিউবা, উত্তর কোরিয়া প্রভৃতি ইস্যুতে ট্রাম্পের রেখে যাওয়া বিতর্কিত কূটনৈতিক প্রেক্ষাপট বাইডেন প্রশাসনকেই সুরাহা করতে হবে।

ট্রাম্প বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলাকে অবজ্ঞা করেছেন। ঐতিহাসিক প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। বাইডেনকে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বিশ্বের সঙ্গে নতুন করে কাজ শুরু করতে হবে।

ট্রাম্প প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ১২ দেশের চুক্তি (টিপিপি) থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের ইতি টেনেছেন। ইউনেসকো থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করেছেন। সামরিক জোট ন্যাটোকে খাটো করেছেন। এভাবে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা-জোট থেকে দূরে সরিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে একাকী করেছেন ট্রাম্প। বাইডেনকে এ নিয়েও নতুনভাবে কাজ শুরু করতে হবে।

ট্রাম্প আরেক দফায় ক্ষমতায় থাকছেন না, তাঁর বিদায়ের দিন গণনা চলছে, এটা অনেকের কাছে স্বস্তির বিষয়। কিন্তু বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাঁর উত্তরসূরির জন্য একটা বন্ধুর পথ রেখে যাচ্ছেন। ফলে ২০ জানুয়ারি মার্কিন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেওয়ার মুহূর্ত থেকেই বাইডেনকে নানামুখী চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যেতে হবে।