বাবার কথা-ই সত্যি হলো
তপ্ত সূর্যের নিচে পেয়েছি যার ছায়া, তিনিই হলেন আমার বাবা। লেখালেখির কিছু চর্চা থাকলেও বাবাকে নিয়ে লিখতে গিয়ে বারবার ভাবছি। লেখাটা কীভাবে শুরু করব। কারণ বাবার সঙ্গে কখনো আন্তরিকতা ছিল না। বাবা কখনো জড়িয়ে ধরে বলেননি, তোমাকে অনেক ভালোবাসি। বাবাকে নিয়ে সন্তানের অনুভূতিগুলো মনের গহিনে চাপা পড়ে থাকে সব সময়। কারণ এ ভালোবাসা থাকে অপ্রকাশে। বাবার ত্যাগ–তিতিক্ষা, রাগ–অভিমান সবকিছুই সন্তানকে আগলে রাখে বুকের গহিনে। সন্তান কখনো মুখ ফুটে বলে না, বাবা তোমাকে অনেক ভালোবাসি। বাবাকে আমরা আব্বা, বাবা, ড্যাডি, পাপা—যে নামেই ডাকি না কেন, সব বাবাই তাঁর সন্তানের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ করেন। তাঁদের বাহ্যিক রূপ ভিন্ন থাকলেও অন্তরের রূপ একই চিহ্ন বহন করে, তিনি একজন বাবা। অনুভূতির জায়গা সবার কাছে একই। পৃথিবীর এমন কোন শব্দ বা বাক্যের আবিষ্কার হয়নি, যা বাবা নামক শব্দের অনুভূতিটুকুকে সম্পূর্ণ রূপে প্রকাশ করতে পারে।
আমার বাবা যেমন রাগী মানুষ ছিলেন, তেমন একজন দয়ালু ও কোমল মনের অধিকারী ছিলেন। তাঁর মধ্যে সব সময় একটা গাম্ভীর্য কাজ করত। বাবা যখন পাঁচ বছরের শিশু তখন ওনার বাবা, আমার (দাদা) মারা যান। আমার দাদির একমাত্র ছেলে হিসেবে অতি আদরে বাবার দিনগুলো কাটে।
শুনেছি দাদি ভীষণ সুন্দরী ছিলেন, কিন্তু তা সত্ত্বেও একমাত্র ছেলের ভবিষ্যৎ ভেবে দ্বিতীয় বিয়ের চিন্তা করেননি। কৈশোরে কিছু উষ্ণ উদ্দামতায় থেকে লেখাপড়ায় তেমন মনোযোগী ছিলেন না। তাই হয়তো নাম সাক্ষর পর্যন্তই শিক্ষার দৌড় ছিল। প্রথম যৌবনটা ঘুরেফিরে হেলায় কাটিয়েছেন হয়তো। কিন্তু পুরোনো দলিল দস্তাবেজ ঘাটতে দারুণ দূরদর্শিতা ছিল বাবার। আমি যখন ক্লাস সেভেন–এইটে পড়ি তখন আমাকে দিয়ে দলিল পড়াতেন। কিন্তু তখন দলিল লেখকদের ভাষা বোঝা আমার পক্ষে সম্ভব হতো না। তাই প্রায়শ বাবার রাগ দেখতে হতো। দাদির পছন্দ করা বউ ছিলেন আমার মা। শুনেছি, আমার মাকে নিয়ে বাইরের কোন এক কাজের মহিলার সাহায্য নিয়ে গৃহস্থালির কাজ সারতেন দাদি।
আমরা চার ভাইবোনদের সবার ছোট ছিলাম আমি। বড় ভাই বিদেশে চলে গেলেন। দুই বোনের বিয়ে হয়ে গেল। একমাত্র আমি বাবার মৃত্যু পর্যন্ত থেকেছি পাশাপাশি। মায়ের মুখে গল্প শুনেছি আমার বয়স যখন এক বছর, তখন বাবা চলে গেলেন পবিত্র হজব্রত পালনে। তখন নাকি জাহাজ যোগে হজে যেতে হতো। ছয় মাস চলে যেত হজব্রত পালনে। হাজিদের দারুণ সমীহ করত তখন আশপাশের গ্রামের মানুষ।
আমার বয়স তখন ১০-১২ বছর হবে। তখন আমাদের ঘরটা পাকা ছিল না। একদিন রাতে প্রবল ঝড়–বৃষ্টিতে ঘরের বেড়াটা পড়ে গেল। সেদিন দেখেছি বাবার কী করুন চেহারা। মনে হচ্ছিল, সম্ভব হলে তখনই ঘরটা পাকা করার কাজে হাত দিতেন। কয়েক দিন যেতে না যেতেই ইটভাটা করতে মনস্থ করলেন। তখন গ্রামাঞ্চলে পাকা বাড়ি করতে নিজের জমির মাটি থেকে ইট বানানোর ব্যবস্থা করতে হতো। পেশাদারি লোকের মাধ্যমে ইটভাটা তৈরি করতে মাস খানিক সময় লেগে যেত। পরে লাকড়ির সাহায্যে ইট পুড়িয়ে সেই ইট দিয়ে ঘর পাকা করার প্রচলন ছিল।
আমি তখন ক্লাস ফাইভে পড়ি। ঘর তৈরির ব্যয়, মিস্ত্রির সঙ্গে লেনদেন সবকিছু বাবা আমাকে দিয়ে করাতেন। তখন ইঞ্জিনিয়ারিং প্ল্যান ছিল না। রাজমিস্ত্রির প্ল্যান অনুযায়ী বিল্ডিং বানানো হতো। বাবা মাঝেমধ্যে প্ল্যান বুঝিয়ে দিতেন। মিস্ত্রি বলতেন, ঠিক আছে এভাবেও করা যাবে। মনে হতো, মিস্ত্রিরা পারে না এমন কোন কাজ নেই। ঘরের কাজ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাবার নিজস্ব আইডিয়ায় কাঠমিস্ত্রি দিয়ে একটি বিরাট হস্তচালিত টানা পাখা তৈরি করালেন। সাত ফুট লম্বা আর তিন ফুট প্রস্থ কাঠের ফ্রেমে চটের বস্তা কেটে কভার করে। তার ওপরে ভারী কাপড় সংযোগ করে বানানো হল পাখা। রশির সাহায্যে টানানো হল ওপরে কাঠের সঙ্গে। আরেক রশি দিয়ে নিচে থেকে টানলেই আরামদায়ক প্রচুর বাতাসের সৃষ্টি হয়। বাবার চিন্তাধারা গ্রামের অন্য যেকোনো ধনী লোকদের চেয়ে ব্যতিক্রম ছিল।
বাবা প্রচুর পান খেতেন। তিন পকেটওয়ালা ফতুয়া জাতীয় পাঞ্জাবির দুই পকেটে সব সময় পান সুপারির কটুরী আর চুন তামাকের পিতলের তৈরি কৌটা রাখতেন। তর্জনী আঙুলে চুনের রেশ সব সময়ই লেগে থাকত। বাবার একটা কাজ ছিল, যা আমার কাছে খুবই অপছন্দ লাগত। তা হলো সপ্তাহে অন্তত তিন দিন নিজের বাড়িতে সালিশি বৈঠক করা। ফজরের নামাজের পরপরই দেখতাম গ্রামের পাঁচ/ছয়জন মুরব্বি আমাদের বাড়িতে হাজির। গ্রামের কারও লাউ চুরি, কারও প্রতিবেশীর সঙ্গে ঝগড়া ইত্যাদি বিষয়ের সুরাহা করতে বৈঠক। সঙ্গে চলতো চা আর নলযুক্ত হুক্কায় ধূমপান। গরুর রাখাল ছেলেটা হাঁপিয়ে উঠত তামাক সাজাতে। তারা বসতেন আমার শোবার ঘরের সামনে। তাতে আমার সকালের ঘুম মাটি হলেও এখন বিষয়টা নিয়ে চিন্তা করতে খারাপ লাগে না।
আমার প্রতি বাবার ভীষণ নজর ছিলে, আমি যেন সৎ আর পরহেজগার হই। লোকে যেন না বলে, হাজির ছেলে পাঁজি হয়েছে। কিন্তু আমাকে কখনো শাসন করার প্রয়োজন মনে করেননি বাবা। আমার কৈশোরে একবার আমাদের গ্রামে রূপবান যাত্রা পালা হবে। কয়েক দিন আগে থেকেই বাবার সতর্ক দৃষ্টি আমার ওপর। মাকে সতর্ক বার্তা শুনিয়ে রাখলেন। কিন্তু আমিও নাছোড় বান্দা। এই প্রথম গ্রামে রূপবান যাত্রাপালা হবে, না দেখে আমার যেন তর সইছে না।
কিন্তু যাব কীভাবে! সন্ধ্যা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের বাড়ির পেছনের রাস্তা দিয়ে লোকের শোরগোল কানে আসছে, সবাই যাত্রা দেখতে যাচ্ছে। বাবাকে বিশ্বাস দিতে আমি বিনা কারণেই বাবার সামনে ঘুর ঘুর করতে লাগলাম। যখনই বাবা নামাজে দাঁড়ালেন, অমনি মাকে ইশারায় বলে পেছন দরজা দিয়ে ছুটে পালালাম।
বেশ কয়েক দিন বাবার সামনে পড়া এড়িয়ে চললাম। বাবার সঙ্গে এমন অনেক ঘটনা আছে, যা লিখে শেষ করা যাবে না। বাবা আমাকে প্রায়ই বলতেন, তোমার রোজগার আমি খেয়ে যেতে পারব না। বাবার কথায় আমি মনে মনে বিরক্ত হতাম। বলতাম, বাবা তোমার ভুল ধারণা, আমার রোজগারের সবকিছু তোমার জন্য তুলে রাখব।
১৯৬৯ সাল। আমি তখন ক্লাস টেনে পড়ি। একদিন শুনলাম বাবা ভীষণ অসুস্থ, ছুটে গেলাম বাড়িতে। গিয়ে দেখি বাবা শয্যাশায়ী। কথা–বার্তায় জড়তা। আমাকে বললেন, সিলেট হাসপাতালে নিয়ে যেতে। এটাও বললেন, তুমি তো একা এসব সামলাতে পারবে না। ভাতিজা খালেক মাস্টারকে খবর পাঠিয়েছি। সে আসলেই আমরা সিলেট যাওয়ার ব্যবস্থা করব।
ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও হাসপাতালে কোন কেবিনের ব্যবস্থা করা গেল না। কারণ, ওই দিন কয়েকজন বর্ডার সিকিউরিটি গার্ড তামাবিল বর্ডার থেকে আহত হয়ে কেবিনজুড়ে বসল। তাই রেগুলার সিটেই বাবাকে সিলেট সদর হাসপাতালে ভর্তি করালাম।
দিনের পর দিন বাবার শরীরের অবনতি লক্ষ্য করলাম। খাওয়ার রুচি কমতে লাগল। বাবার মুখখানা শুকিয়ে এমন হলো যে, বাবাকে দেখে আর চেনা যায় না। বাবা কথায় ভীষণ জড়তা। আমি ঠিকমতো সব কথা বুঝতে পারি না। যতটুকু বুঝলাম, বাবা বলছেন, লন্ডনে আমার বড় ভাইকে টেলিগ্রাম করতে। ওই দিন আর ভাইকে টেলিগ্রাম করা হল না। আমি কখনো ভাবিনি বাবা এত তাড়াতাড়ি চলে যাবেন। অবশ্য এর আগে মৃত্যু সম্পর্কে আমার কোন ধারণাই ছিল না। আমি ও আমার চাচাতো ভাই পালা করে হাসপাতালে বাবাকে রাতে পাহারা দিতাম। ওই রাতে আমি চলে গেলাম হোটেলে ঘুমাতে। মধ্যরাতে কড়া নাড়ার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। দরজা খুলে দেখি খালেক ভাই। আমাকে বলছেন, তাড়াতাড়ি হাসপাতালে চলো। চাচার অবস্থা ভালো না।
বাবা তখন বিড়বিড় করে কিছু বলছেন। আমি কিছু উঁচু স্বরে বাবাকে ডাকলাম। একবার শুধু আমার প্রতি তাকালেন। আবার বিড়বিড় করে কিছু বলতে লাগলেন। আমি দৌড়ে ডাক্তারকে ডাকতে গেলাম। এসে দেখি, বাবা অসহায়ের মত ফ্যালফেলিয়ে তাকিয়ে আছেন। আমি কান্নায় ভেঙে পড়ে বাবার হাতখানা জড়িয়ে ধরলাম। ইতিমধ্যে ডাক্তার এসে বাবার দুচোখ বুজিয়ে দিলেন।
বাবা বলেছিলেন, আমার রোজগার খেয়ে যেতে পারবেন না। তাই সত্যি হলো, কিন্তু বাবার রুহের মাগফিরাত চেয়ে আজীবন গরিব–দুঃখীদের মধ্যে আমার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার দিতে চাই। বাবার জীবনের অপূর্ণ চাওয়াগুলো আমি পূরণ করতে চেষ্টা করে যাব। মহান আল্লাহ যেন আমাকে সেই তৌফিক দান করেন।