বিশৃঙ্খল বিতর্কে বেয়াড়া ট্রাম্পের উদ্বেগজনক বার্তা

বিতর্কে মুখোমুখি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দুই প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প (বাঁয়ে) ও জো বাইডেন। গত মঙ্গলবার ওহাইও অঙ্গরাজ্যের ক্লিভল্যান্ডেছবি: রয়টার্স

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী জো বাইডেনের মধ্যে গত মঙ্গলবার রাতে অনুষ্ঠিত বিতর্ক যে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের সবচেয়ে বিশৃঙ্খল এবং মানহীন বলেই চিহ্নিত হবে, এ বিষয়ে সংশয়ের কোনো কারণ নেই। পাঁচটি নির্ধারিত বিষয়ের ওপর বিতর্কের কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত সেগুলোর কোনো বিষয়েই কোনো রকম বিতর্ক হয়নি। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই বিতর্কে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আচরণ ও কথাবার্তার মধ্য দিয়ে কিছু সুস্পষ্ট বার্তা প্রকাশিত হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের দেওয়া এসব বার্তা মার্কিন রাজনীতি, নির্বাচন এবং গণতন্ত্রের জন্য ইতিবাচক তো নয়ই, বরং উদ্বেগজনক।

সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিয়োগ, করোনাভাইরাস, বর্ণবাদ, বিভিন্ন শহরে সহিংসতা ও নির্বাচনের সততা বা ইন্টেগ্রিটি—এই পাঁচ বিষয় নিয়ে একটানা ৯০ মিনিট দুই প্রার্থী সঞ্চালক ক্রিস ওয়ালেসের প্রশ্নের উত্তর দেবেন বলে নির্ধারিত ছিল। কিন্তু বিতর্কের শুরু থেকেই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প পূর্বনির্ধারিত নিয়মকানুন, যা তাঁর নির্বাচনী দলের সম্মতিতে ঠিক করা হয়েছিল, উপেক্ষা করে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীর ওপর আগ্রাসী আক্রমণ চালান।

বিতর্কের পুরো সময় ধরে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প একধরনের উদ্ধত আচরণই শুধু করেননি, ব্যক্তিগত বিষয়েও আক্রমণ করেন। জো বাইডেনের জন্য নির্ধারিত সময়ে তাঁর বক্তব্যের মধ্যে তাঁকে থামিয়ে দিয়ে কথা বলেন, এমনকি একপর্যায়ে সঞ্চালকের সঙ্গে বিতর্কেও জড়িয়ে পড়েন। ট্রাম্পের এসব আচরণের কারণে অনেক সময়ই ডেমোক্রেটিক প্রার্থী জো বাইডেন তাঁর চিন্তার খেই হারিয়ে ফেলেন। সঞ্চালক ফক্স টেলিভিশনের উপস্থাপক ক্রিস ওয়ালেস প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এসব আচরণ বন্ধে কোনো ধরনের কঠোর অবস্থান নিতে পারেননি। ৯০ মিনিটের বিতর্কের ৭৩ মিনিটের মাথায় তিনি প্রথমবারের মতো ট্রাম্পকে সতর্ক করলেও ট্রাম্প তার তোয়াক্কা করেননি।

বিতর্কের আগেই অনুমান করা গিয়েছিল যে ট্রাম্প প্রতিদ্বন্দ্বী বাইডেনের বিরুদ্ধে কঠোর হবেন এবং তাঁকে কোণঠাসা করে রাখতে চাইবেন। কিন্তু তার রূপ যে ন্যূনতম নিয়ম না মানা এবং কার্যত একধরনের তর্জনে রূপান্তরিত হবে, তা সম্ভবত কেউ অনুমানও করতে পারেননি। কোনো বিশ্লেষকই এমন ধারণা দিতে পারেননি। ফলে বিতর্কের পর গণমাধ্যমে সাধারণত যে আলোচনা হয়—কে জিতেছে, কে হেরেছে, তা আর গুরুত্ব পায়নি।

জো বাইডেনও কখনো কখনো প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে তীক্ষ্ণ মন্তব্য ছুড়েছেন। একপর্যায়ে তিনি প্রেসিডেন্টকে ক্লাউনও বলেছেন, চুপ করতে বলেছেন। অন্য যেকোনো সময় এসব নিয়ে বাইডেনকেও সমালোচনার মুখোমুখি হতে হতো। তিনি করোনাভাইরাস মোকাবিলায় ট্রাম্পের ব্যর্থতার দিকে অঙ্গুলিসংকেত করতে সক্ষম হয়েছেন, কিন্তু তাঁর জন্য চ্যালেঞ্জ ছিল উত্তেজনা পরিহার করা। তিনি সেটা করতে পারলেও তাঁর বক্তব্য যে খুব বেশি আকর্ষণীয় ছিল এমনটাও বলা যাবে না। কিন্তু এই সবকিছুকে ছাপিয়ে গেছে ট্রাম্পের নাটকীয়তা ও তাঁর দেওয়া বার্তা।

মার্কিন রাজনীতি যে গুণগতভাবে কতটা পতিত হয়েছে, তা দেখিয়ে দিয়েছে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এসব আচরণ। এটি রাজনীতির ব্যাপারে উৎসাহীদের জন্য দুঃসংবাদ, যা মানুষকে রাজনীতির ব্যাপারে আরও বেশি অনীহ করবে। সঞ্চালকের প্রশ্নের উত্তরে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের নিন্দা করতে রাজি হননি। সহিংসতার জন্য দায়ী করেছেন বামপন্থীদের এবং ফ্যাসিবাদবিরোধী বাম ধারার রাজনৈতিক আন্দোলন অ্যান্টিফার বিরুদ্ধে বিষোদ্‌গার করেছেন। তিনি শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী একটি নাৎসিবাদ সমর্থক মিলিশিয়া প্রাউড বয়েজকে বলেছেন ‘স্ট্যান্ড ব্যাক, স্ট্যান্ড বাই’, যার অর্থ আপাতত কিছু না করা, এ হচ্ছে অপেক্ষমাণ থাকার জন্য আহ্বান। এটি তাঁদের কাছে যে বার্তা পাঠায়, তা ভয়াবহ। বিশেষ করে যেখানে তিনি ফেডারেল সরকারের কর্মচারীদের বর্ণবাদবিষয়ক প্রশিক্ষণ বাতিল করার কারণ হিসেবে বলেছেন যে এই ধরনের প্রশিক্ষণ ‘আমাদের দেশকে ঘৃণা করতে শেখায়’।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কিছুদিন ধরেই ডাকযোগে দেওয়া ভোটকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে নির্বাচনের সততাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করে আসছেন। বিতর্কে সে কথাই আবার বলেছেন তিনি। মার্কিন গণতন্ত্রের একটি অন্যতম ভিত্তি হচ্ছে সুষ্ঠু নির্বাচন এবং তার ফলাফল সব পক্ষের মেনে নেওয়া। ট্রাম্প সেই প্রতিশ্রুতি দিতে রাজি হননি। তিনি এটা স্পষ্ট করে বলেছেন, তিনি মনে করেন যে নির্বাচনের ফলাফল আদালতেই চূড়ান্ত হবে। সে কারণেই তিনি তাঁর মনোনীত বিচারপতি অ্যামি কোনি ব্যারেটকে সুপ্রিম কোর্টে দেখতে চান। তার অর্থ হচ্ছে, যে কোটি কোটি মানুষ ভোট দেবেন, তাঁদের এই ভোটের প্রতি তিনি আর নির্ভর করছেন না।

বিতর্কের সময় আচরণ দিয়ে প্রেসিডেন্ট দেখিয়েছেন যে তিনি কোনো নিয়মকানুন মানতে রাজি নন, দরকারমতো তিনি নিয়ম তৈরি করবেন। অথচ গণতন্ত্রের এক অবশ্য প্রয়োজনীয় শর্ত হচ্ছে নিয়ম মানা। নির্বাচনের ফল নিজের অনুকূলে না গেলে তিনি যে এই আচরণ করবেন, সে ইঙ্গিতই দিচ্ছে মঙ্গলবারের বিতর্ক। যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের প্রতি এর চেয়ে বড় হুমকি আগে এসেছিল কি না, সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ।

আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর