
কবিতার মাস এবং ‘অ্যাকাডেমি অব আমেরিকান পোয়েটস’-এর ৮৫তম বার্ষিকী উপলক্ষে গত ২৪ এপ্রিল সন্ধ্যায় লিঙ্কন সেন্টারের এলিস টালি হলে আয়োজন করা হয়েছিল ‘পোয়েট্রি অ্যান্ড দ্য ক্রিয়েটিভ মাইন্ড’ শীর্ষক কবিতা পাঠের আসর। এবার ছিল এই আয়োজনের ১৭তম বার্ষিকী। কবি শামস আল মমীন কিছুদিন ধরে খোঁজ রাখছিলেন অনুষ্ঠানটির। টিকিট সংগ্রহ করার দায়িত্বও নিয়েছিলেন তিনি। সবচেয়ে কমদামি টিকিটের মূল্য সব খরচ মিলিয়ে পড়ল ৫৬ ডলার। কবিতার জন্য এক–দেড় ঘণ্টার আসর আমার মতো স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য একটু যেন উচ্চ মাত্রার বিলাসিতা হয়ে যায়! কিন্তু এটুকু বিলাসিতা না করলে তো আমেরিকার মূলধারার কবি সমাজের সংস্কৃতি সামান্যও অনুধাবন করা যাবে না! আর লিঙ্কন সেন্টার তো নিউইয়র্কের উচ্চতম সাংস্কৃতিক পিঠস্থান। এর স্বাদ মাঝেমধ্যে একটু–আধটু না নিলে নিউইয়র্কে বাসই যে বৃথা হয় আমার!
বন্ধু কবি শামস আল মমীন মাঝেমধ্যে এখানকার কবিতা পাঠের আসরে যান। আমাদের আরেক বন্ধু হাসান আল আবদুল্লাহ তো বিভিন্ন শহরের কবিতা পাঠের আসরে হাজির থাকেন ফিচার পয়েট হিসাবে। কিন্তু এমন বড় আসরে উপস্থিত থাকার অভিজ্ঞতার কথা আমার পরিচিত পরিমণ্ডলের কারও কাছ থেকে শুনেছি বলে মনে পড়ে না!
লিঙ্কন সেন্টার ১৬ দশমিক ৩ একরের বিশাল এক অঙ্গন। নিয়মিত এখানে যাতায়াত না থাকলে লক্ষ্যস্থল খুঁজে পাওয়াটাই একটি ঝকমারি। এলিস টালি হল খুঁজে পেতে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করতে হলো! বাইরে থেকে হলটার জাঁকজমক তেমন নেই, ফলে আমরা আয়োজনের বিশালত্ব ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না। হলটির সৌন্দর্য ও উপযোগিতার বাহাদুরি এর ভেতরটায়।
১৯৬৯ সালে উদ্বোধনের পর থেকে নিউইয়র্ক ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল ও চেম্বার মিউজিক সোসাইটি অব লিঙ্কন সেন্টারের মূল কেন্দ্র হিসাবে চিহ্নিত হয়ে আসছে এই এলিস টালি হল। অনেক বড় মাপের শো এখানে অনুষ্ঠিত হয়ে রীতিমতো ইতিহাস সৃষ্টি করে রেখেছে। একই সঙ্গে এই হলে ১ হাজার ৮৬ জন বসে অনুষ্ঠান উপভোগ করতে পারে!
আমরা পৌঁছেছিলাম অনুষ্ঠান শুরুর আধঘণ্টা আগে। সবকিছু বুঝে আমাদের জন্য নির্ধারিত আসন খুঁজে বসতে বসতে আরও লেগে গেল ১৫ মিনিটের মতো। বসে চারদিকে তাকিয়ে পরিবেশটাকে বুঝে নিতে চেষ্টা করলাম। দেখলাম, হল পুরো ভর্তি কবিতাপ্রেমী বা কবি যশোপ্রার্থীতে! মাঝেমধ্যে দু-একটা খালি আসনও আমার দৃষ্টি খুঁজে পেল না! প্রবেশমুখে প্রত্যেকের হাতেই একটা করে ব্রশিউর দিল আয়োজক প্রতিনিধিরা। আমরা সেটি উল্টেপাল্টে দেখতে দেখতে নির্ধারিত সময় যে কখন পেরিয়ে গেল, তা টেরই পেলাম না। সাত–আট মিনিট পর একজন মাইক্রোফোনে একটু আওয়াজ তুললেন। এত বড় একটা আয়োজন, কিন্তু সবকিছু এত সুশৃঙ্খল যে, ঠিকমতো বুঝেই উঠতে পারলাম না কোথা দিয়ে কী হয়ে যাচ্ছে!
ব্রশিউর থেকে জেনেছিলাম, নিউইয়র্ক নগরে ১৯৩৪ সালে একাডেমি অব আমেরিকান পোয়েটস-এর প্রতিষ্ঠা। www.poets.org নামে একটি ওয়েবসাইট চালায় সংস্থাটি। আমেরিকান পোয়েটস প্রাইজ নামে একটা পুরস্কারও দেয় তারা। নিয়মিত বের করে American Poets Magazine নামে একটা কবিতাবিষয়ক পত্রিকা। আছে poem-a-day কর্মসূচি। বছরজুড়ে কবিতা নিয়ে রয়েছে তাদের নানা আয়োজন।
দ্য একাডেমি অব আমেরিকান পোয়েটস নামের এই সংস্থাটি ‘ন্যাশনাল পোয়েট্রি মানথ’ চালু করেছিল ১৯৯৬ সালে। সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ তাদের শিক্ষা কর্মসূচি। কবিতার মাসে তারা আমেরিকাজুড়ে কবিতাপ্রেমী গড়ে তুলতে এক লাখ শ্রেণিকক্ষ ও লাইব্রেরিতে বিনা মূল্যে পাঠসামগ্রী পাঠায়। ৫০ হাজার শিক্ষক কবিতার উদ্যাপনের এই কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত থাকেন। বছরজুড়ে শিক্ষা কর্মসূচির আওতায় কবিতা আস্বাদনের পাঠসামগ্রী তৈরি করা হচ্ছে!
একাডেমি অব আমেরিকান পোয়েটসের সভাপতি মাইকেল জ্যাকবস ও নির্বাহী পরিচালকের কথা থেকে জানা গেল, দিনে দিনে কবিতার লেখক বাড়ছে যেমন তেমনি বাড়ছে প্রকাশক; কবিতার জন্য বাড়ছে আর্থিক অনুদানও। আমাকে সবচেয়ে আনন্দ দিল যে খবর সেটি হল, কবিতার পাঠক নাকি বেড়েই চলেছে! আরও জানা গেল, কবিতা পাঠের এই আসরটি কবিতা বিষয়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় আয়োজন!
আবার আসরে ফিরে আসি। মাইক্রোফোনে নেপথ্য থেকে শোনা গেল একেকটি নাম আর একেকজন আসতে লাগলেন মঞ্চে। প্রথমে আসলেন মাস্টার অব সেরেমনিজ ও একাডেমি অব আমেরিকান পোয়েটসের চ্যান্সেলর এলিজাবেথ আলেক্সান্ডার। তারপর একে একে ঢুকলেন কবিতা পাঠকেরা। তাঁদের মধ্যে প্রথমে প্রবেশ করলেন আলেক্সানড্রা কনট্রেরাস-মন্টেসানো। তাঁর পরিচয় দেখলাম ব্রশিওরে, তিনি ন্যাশনাল স্টুডেন্ট পোয়েট! তারপর একে একে আসলেন ডেভিড রকফেলার জুনিয়র, জোশ চার্লস, টোইন ওজিহ্ ওডুটোলা, স্টিফেন মেরিট, ড্যানিয়েল রোজ, ড্যানিয়েল মুলহাল, অ্যান কুরি, স্যাভিয়ন গ্লোভার, অ্যালেন বার্স্টিন। ব্রশিওরে দেখলাম প্রত্যেকেরই জীবন বর্ণাঢ্য! কেউ অভিনেতা, কেউ গীতিকার-সংগীতজ্ঞ, কেউ টেলিভিশনের সংবাদ উপস্থাপক, কেউ ট্যাপ ড্যানসার-কোরিওগ্রাফার; একজনকে পেলাম আমেরিকায় নিযুক্ত আয়ারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত ড্যানিয়েল মুলহ্যাল। তিনি যাঁদের কবিতা পড়লেন তাঁদের একজন সবার চেনা আইরিশ কবি সিমাস হীনি।
ব্রশিওরে কবিতার পাঠকদের সবার যে সংক্ষিপ্ত পরিচিতি দেওয়া আছে, তা উপলব্ধি করতে গিয়ে দেখলাম তাঁদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় লিখতেও অনেক পৃষ্ঠা লেগে যাবে। তাই তা থেকে বিরত রইলাম!
ন্যাশনাল স্টুডেন্ট পোয়েট আলেক্সানড্রা কনট্রেরাস-মন্টেসানোকে ডাকা হলো সবার আগে। তিনি প্রথমে আবৃত্তি করলেন নিজের লেখা কবিতা ‘আই অ্যাম ইংলিশ’ ও পরে তারফিয়া ফাইজুল্লাহ-র ‘পোয়েম ফুল অফ ওরি এনডিং উইথ মাই বার্থ’।
ডেভিড রকফেলার জুনিয়র প্রথমে আবৃত্তি করলেন এলিজাবেথ বিশপের সনেট, তারপর হেরম্যান মেলভিলের ‘দ্য ম্যালডিভ শার্ক’ আর সারাহ কে-এর কবিতা ‘জাকার্তা’ জানুয়ারি’।
নাহ, কে কী পড়লেন তার পরিচয় দিতেও অনেক কথা বলতে হবে। যাঁরা অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন না, হয়তো আমার এত কথা তাঁদের ভালোও লাগবে না! যাঁদের কবিতা পড়া হলো, আমার মতো অর্বাচীন পাঠক তাঁদের চিনবে কেন! চিনলাম মাত্র কয়েকজনকে। চিনলাম মার্কিন কবি ওয়ালেস স্টিভেন্সকে, মায়া অ্যানগেলু আর নাওমি শিহাব নাঈকে। এঁদের মধ্যে আবার আমার কাছে বেশি পরিচিত নাওমি শিহাব নাঈ। আশির দশকে তিনি ঢাকায় গিয়েছিলেন। মনে পড়ছে, তরুণ নাওমির স্বকণ্ঠ কবিতা পাঠ দেখেছিলাম বিটিভিতে। হায়দার রিজভীর প্রযোজনায় বিটিভিতে কবি শামসুর রাহমান একটা সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন নাওমির। আমার দেখা বিটিভির নান্দনিক দৃশ্যগুলোর একটি ছিল সেই সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠানটি! নাওমির দু–একটি কবিতা শামসুর রহমান অনুবাদও করেছিলেন মনে পড়ছে!
পাঠকদের একজনের কথা একটু বলতে ইচ্ছে করছে। তিনি স্টিফেন মেরিট। পরিচিতিতে দেখলাম, তিনি গীতিকার ও সংগীতজ্ঞ। শুধু তাঁর জন্যই মঞ্চের একপাশে একটা গিটার রাখা ছিল আগে থেকেই! তিনিই কেবল আবৃত্তি করলেন একটু আলাদাভাবে, মানে গিটার বাজিয়ে গাইলেন আর কী! তিনিও কিন্তু নিজের লেখা গীতি কবিতা পাঠ করলেন না! পড়লেন (গাইলেন বললেই বোধ হয় ঠিক হতো!) থম গান, স্টিভ স্মিথ ও কিম ব্রিজফোর্ডের কবিতা!
কবিতা পাঠকদের প্রত্যেকেই স্ব স্ব ক্ষেত্রের উঁচু স্তরের মানুষ। অথচ তাঁরা এখানে নিছকই একজন কবিতা পাঠক! প্রত্যেকেই নিজের জন্য আগে থেকে নির্দিষ্ট করা কবিতাই পড়েছেন। প্রত্যেকের হাতে কবিতার মুদ্রিত নিভাঁজ কাগজ ছিল। প্রত্যেকেই এমন চমৎকার পড়লেন! না, এই পাঠ আমাদের গতানুগতিক আবৃত্তিকারের পাঠের মতো অহেতুক সুরেলা ও কৃত্রিম কণ্ঠবাজি নয়, তাঁরা নিজেরা কবিতাকে কীভাবে অনুভব করেছেন, তা যেন পাঠের মাধ্যমে উপস্থিত শ্রোতাদের মর্মমূলে পৌঁছে দিতে চেয়েছেন। কোথাও একটু টাল খেল না তাঁদের পড়া। শতবার অনুভবগ্রাহী পড়ার অনুশীলন না করলে এমন পাঠ করা যায়!
কবিতা পাঠের আগে ছোট্ট একটু আনুষ্ঠানিকতা ছিল। মাস্টার অব সেরেমনি এলিজাবেথ আলেক্সান্ডারের ডাকে অ্যাকাডেমি অব আমেরিকান পোয়েটস্-এর সভাপতি মাইকেল জ্যাকবস ও নির্বাহী পরিচালক জেনিফার বেনকা এলেন মঞ্চে। আগে বললেন জেনিফার। বলেই মঞ্চের একপাশে দাঁড়িয়ে রইলেন। বেশ বয়স্ক নারী তিনি, এলিজাবেথ তো বলেই দিলেন, তিনি এখানে সর্বজ্যেষ্ঠ! কিন্তু তাঁদের জন্য কোনো আসন নেই! আসন নেই চেয়ারম্যান মাইকেল জ্যাকবসের জন্যও! উপস্থাপকের কথাসহ ৭/৮ মিনিটের মধ্যে দুজনের বক্তৃতা শেষ হয়ে গেল! আমাদের মঞ্চ আলো করা সভাপতিদের মতো বিরাট চেয়ার দেওয়া হয়নি সভাপতি ও নির্বাহী পরিচালকের জন্য, সময়ও নষ্ট হয়নি ভুয়া আনুষ্ঠানিকতায়! আবৃত্তিকারদেরও বসতে দেওয়া হয়েছে হাতলবিহীন চেয়ারে। কারণ তাঁরা দর্শকদের চেয়ারে বসে-থাকা দেখাতে আসেননি, এসেছেন কবিতা পাঠ করতে! যাঁর পড়া হয়ে গেল, তিনি মঞ্চ থেকে নেমে উধাও হয়ে গেলেন না! সমগ্রের পূর্ণতার জন্য যে তাঁদের এখানে পুরোটা সময় বসে থাকতে হবে, সে কথা তাঁদের কারও বলে দিতে হয়নি!
আরেকটা কথা। মাস্টার অব সেরেমনি মঞ্চে ছিলেন শুরুর আনুষ্ঠানিকতার সময়। পরে কিন্তু বারবার আসা-যাওয়া করে শ্রোতাদের মনঃসংযোগ বিনষ্টে বকর বকর করেননি। একজনের পড়া শেষ হলে আবৃত্তিকারেরা একের পর এক উঠে এসেছেন পোডিয়ামের সামনে!
আমরা যারা বসে ছিলাম দর্শকদের আসনে, তারা সারাক্ষণ রইলাম পিনপতন নীরবতায়! আস্ত একটা কাশি দিলেও এর শব্দ ছড়িয়ে পড়ছিল। সুতরাং কয়েকবার কাশি আটকে রাখতে গিয়ে আমার চোখ থেকে রীতিমতো পানি ঝরতে শুরু করেছিল। আবারও অনুভব করলাম, সত্যিকারের দর্শক বা উপভোগকারী হওয়ারও সংস্কৃতি আছে। এর জন্যও সংস্কৃতিমান হতে হয়!
আমি এ ধরনের অনুষ্ঠানের অভিজ্ঞতার স্মৃতি ধরে রাখতে ভেবেছিলাম মোবাইল ক্যামেরায় নিঃশব্দে ছবি তুলব। কিন্তু পরিবেশটা সেখান এমন ছিল যে, ক্যামেরা বের করতেই অস্বস্তি হলো! কারণ কাউকেই দেখলাম না, মুঠোফোন বা ক্যামেরা বের করতে। শুরুতে সবাইকে অনুরোধ করা হয়েছিল মোবাইল ফোন নীরব রাখতে। দেড় ঘণ্টার বেশি সময়ে একবারও মুঠোফোন বাজার শব্দ শুনলাম না! অনুষ্ঠান শেষে বেরও হলাম আমরা সুশৃঙ্খলভাবে! ছবি যা দু–একটা তুলেছি তা অনুষ্ঠান শুরুর আগে ও পরে!
লিঙ্কন সেন্টারের এলিস টালি হলো থেকে বের হয়ে একটু এগিয়ে আমরা একটা কফিশপে বসলাম কফি খেতে। একজন এসে বসলেন আমাদের কাছের এক টেবিলে। দেখে ইউরোপীয় বংশোদ্ভূত বলেই মনে হলো তাঁকে। হাতে ব্রশিওর দেখে বোঝা গেল তিনিও ছিলেন ওই অনুষ্ঠানে। শামস আল মমীন জিজ্ঞাসা করলেন, তিনি কবিতা লেখেন কিনা। ভদ্রলোক বললেন, হাঁ, লেখেন। মমীন এবার জিজ্ঞাসা করলেন তাঁর প্রকাশিত কোনো কবিতার বই আছে কিনা। ভদ্রলোক প্রথমে বললেন, না নেই! কিন্তু একটু পরেই বললেন, আছে, তবে প্রকাশিত বই নয়, একটা ‘chapbook’! শামস আল মমীন বললেন, ভদ্রলোক কবিতা শোনেন, কবিতা লেখেন, কবিতা ভালোবাসেন, কিন্তু কবি খ্যাতিলাভের জন্য কাঙাল নন!’ কথাটা শুনে আমার মনে হলো, আমাদের সমাজে ওই ভদ্রলোকটির মতো কবিতা শোনা, কবিতা পড়া, কবিতা লেখা বা কবিতা ভালোবেসে কবিতার সঙ্গে জীবন যাপন করার চেয়ে কবি যশোপ্রার্থীর সংখ্যাই বেশি!