বুকের গভীরে স্বদেশ

সাদিয়া ফয়জুন্নেসা
সাদিয়া ফয়জুন্নেসা

আমাদের মেয়ে চারণ আর চিত্রণ একদিন প্রাইমারি স্কুলের শুরুতে খাতায় একটি নোটিশ নিয়ে ফিরল যার মূল সার কথা হচ্ছে, ক্লাসে ছাত্রছাত্রীদের নিজের দেশকে উপস্থাপন করতে হবে। কানাডায় বহু সংস্কৃতির অধিকারের আইনগত স্বীকৃতির অংশ হিসেবে স্কুলে এ ধরনের পাঠ্যক্রম থাকে।
‘হায়রে আমার মন মাতানো দেশ’—এই দেশাত্মবোধক গানটা পাঁচ বছরের চারণ আর চিত্রণ গাইতে পারে, ওরা সেটা গাইবে। দেশ থেকে আনা জাতীয় পতাকা বের করলাম। ইন্টারনেট থেকে মানচিত্রের প্রিন্ট আউট নেওয়া হলো। দেশ থেকে আনা অফসেটে ছাপা ফটোগ্রাফির বই থেকে বিভিন্ন ছবি নির্বাচন করা হলো, যেসব দেখে দেখে ফেলে আসা দেশ-গ্রাম মর্মে গেঁথে নিতে চাই আমরা।
ওরা পরবে জামদানি শাড়ি। সঙ্গে নেবে নকশি কাঁথা, বৈশাখী মেলা থেকে পটুয়ার তৈরি মাটির মা ও শিশু।
একটা পোস্টার বানাতে ওদের সাহায্য করলাম। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তর্জমা করে সংক্ষেপে সহজ ফরাসি ভাষায় লেখা হলো। বঙ্গবন্ধুর ছবি কেটে সেঁটে দিলাম। বাংলাদেশের মানচিত্র ফটোকপি করে তার চারপাশে লাল রং দিয়ে হৃদয়বৃত্ত এঁকে দিল ওরা। জাতীয় ফুল, ফল, পাখি এবং বড় করে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের ছবি দিয়ে আস্তে আস্তে পোস্টারে বাংলাদেশের ছবিটা যেন জীবন্ত হয়ে উঠল।
চারণ চিত্রণ ভারী খুশি, বলল—‘আমাদের দেশ কি সুন্দর!’

মানচিত্রের বাইরে গিয়ে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত ও পরিচিত করতে পেরেছেন যাঁরা, সাদিয়া ফয়জুন্নেসা তাঁদের একজন। নিউইয়র্কের প্রথম নারী কনসাল জেনারেল তিনি। লাখো শহীদের ত্যাগের বিনিময়ে যে স্বাধীন বাংলাদেশ আমরা পেয়েছি, তারই একজন গর্বিত সন্তান আপাদমস্তক বাঙালি এই মানুষটি। নারী-পুরুষ সমানাধিকারের প্রতীক তিনি
মানচিত্রের বাইরে গিয়ে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত ও পরিচিত করতে পেরেছেন যাঁরা, সাদিয়া ফয়জুন্নেসা তাঁদের একজন। নিউইয়র্কের প্রথম নারী কনসাল জেনারেল তিনি। লাখো শহীদের ত্যাগের বিনিময়ে যে স্বাধীন বাংলাদেশ আমরা পেয়েছি, তারই একজন গর্বিত সন্তান আপাদমস্তক বাঙালি এই মানুষটি। নারী-পুরুষ সমানাধিকারের প্রতীক তিনি

পরদিন ওরা স্কুল থেকে ফিরে জানাল যে ক্লাসে পনেরোটা দেশের মধ্যে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়েছে। ক্লাসের সবাই বাংলাদেশ নিয়ে সাধারণ একটা ধারণা পেয়ে গেছে! প্রাইমারি স্কুলের পাঁচ বছরে আমার মেয়েদের নিজেদের জাতিগত উৎস নিয়ে আর বাড়তি কথা বলতে হয়নি। বরং ক্ষেত্রবিশেষে ওদের শিক্ষক তথ্য খুঁজে দিয়েছেন এবং নিয়েছেন।
একটা সময় ছিল দেশের বাইরে এসে ‘আমি বাংলাদেশের’, বললে -‘এই দেশটা কোথায়? এ প্রশ্ন শুনতে হতো। কিন্তু এখন আমাদের প্রাণের দেশ বিশ্ব মানসে আসন তৈরি করে নিয়েছে।
আয়তনে ছোট, বিপুল জনসংখ্যার একটা গরিব দেশ নিয়ে বিদেশে বিশেষ করে ধনী দেশে বসে অস্বস্তিতে ভোগার কারণ যে ঘটে না তা নয়। কিন্তু এই দেশ যদি স্বাধীন না হতো, ধরা যাক এখনো অঙ্গরাজ্য হয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে ঝুলে থাকত, দেশ নিয়ে এমন একটা পোস্টার বানাতে পারতাম? যেটা নিয়ে আমার সন্তান বুক ফুলিয়ে স্কুলে গেছে!
বাংলাদেশের জনসংখ্যা একটি বিশাল সম্পদ। স্বাধীন দেশ থেকে এই জনসম্পদ দূতাবাসগুলোতে সরাসরি বা এজেন্সির মাধ্যমে যোগাযোগ করে ভিসা, ইমিগ্রেশন ইত্যাদি নিয়ে বিদেশে চলে আসতে পারছে, তখন কি এটা সম্ভব হতো? ধরা যাক, পঞ্চগড় থেকে কেউ আমেরিকা আসতে চাইলে তাকে ঢাকা এসে তারপর প্লেনে ইসলামাবাদ গিয়ে ভিসা সংগ্রহ করতে হতো। এখন যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা বাংলাদেশ আয় করে, তখন তার পরিমাণ কমে কি দাঁড়াতো আমি জানি না, তবে এত এত মানুষ পাকিস্তানের মতো সমস্যাসংকুল দেশ থেকে পৃথিবীর বুকে ছড়িয়ে পড়তে যে দীর্ঘ সময় ও সংকটের সৃষ্টি হতো, তা সহজেই অনুমান করা যায়।
আজ অভিবাসী বাঙালি পৃথিবীতে পরিশ্রম ও সততার পরিচয় অর্জন করেছে, তা আমাদের দেশের মানচিত্রকে অন্যরকম মাত্রা দিয়েছে। পৃথিবীতে এমন অনেক দেশ আছে যাদের অভিবাসীরা বিদেশে এসে নিজেদের আত্মপরিচয় হারিয়ে ফেলে। আবার ফরাসি, ইতালিয়ান কিংবা চীনাদের কথা বলা যায়, যারা নিজেদের স্বকীয়তা বিসর্জন না দিয়ে দেশের বাইরে নিজেদের যে পরিচয় প্রতিষ্ঠা করেছে, তা নিয়ে তাদের নিজ নিজ দেশ অহংকার করে। বাংলাদেশের অভিবাসীরা বিদেশের মাটিতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বাংলাদেশ তৈরি করে নিয়েছে, ভাষা ও সংস্কৃতির চর্চা চালিয়ে যাচ্ছে, এটা সম্ভব হয়েছে আমাদের নিজস্ব মানচিত্রের কারণে। আমরা প্রিয় স্বদেশ বুকের ভেতরে বহন করে চলি বলে।
দেশ মানে ভূখণ্ড ও মানুষ। অভিবাসী মানুষেরাও এক একটা দেশ। অন্তর্জালের যুগে যখন দূরত্বের ভেদাভেদ কম্পিউটারের মাউসের ক্লিকে এসে যাচ্ছে, তখন দেশ মানে বুকের ভেতরে আবেগ, দেশের যেকোনো সংকট কিংবা সম্মানে যে আবেগ টগবগ করে ওঠে।
মানচিত্রের বাইরে গিয়ে নিজেদের পরিচিত ও প্রতিষ্ঠা করার অহংকারী সময় পার করছে বাংলাদেশের অভিবাসীরা।