ভাষণ বা বক্তৃতার সেকাল-একাল

ভাষণ বা বক্তৃতাও একটা শিল্প। যিনি যত সুন্দরভাবে, সহজ-সরল ভাষায় ও যুক্তিপূর্ণভাবে মানুষের চাওয়া-পাওয়া, প্রত্যাশার কথা বলতে পারবেন, তিনিই তত ভালো বক্তা। দেখা গেছে, যেসব ভাষণ বা বক্তৃতায় মানুষের মুক্তির কথা, স্বাধীনতার কথা, বাক্‌স্বাধীনতার কথা, সমতার কথা, সমবণ্টনের কথা, অধিকারের কথা, গণতন্ত্রের কথা, একতার কথা বলা হয়েছে সেগুলোই জনপ্রিয় হয়েছে। কোনো কোনো ভাষণ ইতিহাসের পাতায় স্থান পেয়েছে।
দু মিলিয়ন বছর আগে মানুষ যখন একে অন্যের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করে, তখন থেকেই মানুষের মধ্যে ভাষণ বা বক্তৃতা দেওয়ার প্রবণতা ছিল বলে গবেষকেরা অনুমান করেন। মানুষ যখন সমাজবদ্ধ হতে শুরু করে, তখনই সেই সমাজের নেতৃত্ব নেওয়ার প্রতিযোগিতা শুরু হয়। পেশিশক্তি দ্বারাই তখন সমাজপতি নির্ধারিত হতো। সেই সমাজপতিদের অন্যায়, অবিচারের প্রতিবাদ করতেন জ্ঞানী ও বুদ্ধিমানেরা। যারা প্রতিবাদ করতেন, তাঁদের ওপর নেমে আসত সমাজপতিদের খড়্গ। সেই সক্রেটিস থেকে আজকের হুমায়ুন আজাদ বা অভিজিৎ রায়—এই একই বাস্তবতার কথা বলে।
সভ্যতা বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের আচার-আচরণ পরিবর্তিত হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে ভাষণ বা বক্তৃতারও ধরন পাল্টাতে থাকে। সক্রেটিসকে তাঁর দর্শন, জ্ঞান, সরকারের সমালোচনা ও তরুণ সমাজকে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করার অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় খ্রিষ্টপূর্ব ৩৯৯ সালে। বিভিন্ন বক্তৃতায় যে কথাগুলো তিনি বলতেন, তা আজও ইতিহাস হয়ে রয়েছে। ‘নিজেকে জানো’, ‘মৃত্যুই হলো মানুষের সর্বাপেক্ষা বড় আশীর্বাদ’, ‘তুমি কিছুই জানো না—এটা জানাই জ্ঞানের আসল অর্থ’, আর মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তে তাঁর বলে যাওয়া, ‘আমি মরছি, তুমি বেঁচে থাকবে। কোনটি বেশি ভালো, তা শুধু ঈশ্বরই জানেন।’ মৃত্যুর ২৪০০ বছর পর আজও সক্রেটিস প্রাসঙ্গিক।
১৮৬৩ সালের ১৯ নভেম্বর আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন তাঁর গেটিসবার্গ ভাষণে বলেছিলেন, ‘সরকার জনগণের, জনগণের জন্য, জনগণের দ্বারা পরিচালিত। সে ভাষণের কথা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে তত দিন, যত দিন সভ্যতা টিকে থাকবে। ১৯৬৩ সালের ২৮ আগস্ট ওয়াশিংটনে এক জনসভায় মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র তাঁর ভাষণে বলেছিলেন, ‘আই হ্যাভ এ ড্রিম।’ সেখানে তিনি নাগরিক ও অর্থনৈতিক অধিকার এবং বর্ণবাদের সমাপ্তির কথা বলেছিলেন। তাঁর এই ভাষণ মার্টিন লুথার কিং স্পিচ হিসেবে জগদ্বিখ্যাত। মহাত্মা গান্ধীর ভাষণের, ‘আমাদের লড়াই ক্ষমতার জন্য নয়, বরং ভারতের স্বাধীনতার জন্য শুদ্ধতম অহিংস আন্দোলন’—এই অংশটুকু ইতিহাস হয়ে আছে।
১৯৬৪ সালের ২০ এপ্রিল রিভোনিয়া ট্রায়ালে আসামি পক্ষের ডক থেকে নেলসন ম্যান্ডেলা তিন ঘণ্টা ভাষণ দিয়েছিলেন। সেই ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘এটি এমন এক আদর্শ, যার জন্য আমি মরতে প্রস্তুত।’ সেই ভাষণটি দক্ষিণ আফ্রিকার গণতন্ত্রের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ হিসেবে স্থান করে নিয়েছে, যা বিশ শতকের অন্যতম ভাষণ। ১৯৪৪ সালের ৪ জুলাই ন্যাশনাল আর্মির এক র‌্যালিতে সেনাসদস্যদের প্রেরণা দিতে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস এক ভাষণে বলেছিলেন, ‘আমাকে রক্ত দাও আমি তোমাদেরে স্বাধীনতা দেব।’ তাঁর এই বাণী আজও মুক্তিকামী, স্বাধীনতাকামী মানুষের প্রেরণার উৎস। ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন তাঁর এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘একটি মিথ্যা বারবার বলা হলে তা সত্যে পরিণত হয়।’ চে গুয়েভারা এক ভাষণে বলেছিলেন, ‘যখনই তুমি অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে জ্বলে ওঠো, তখনই তুমি আমার একজন সহযোদ্ধা।’ আর কার্ল মার্ক্স বলেছিলেন, ‘ইতিহাস বারবার ফিরে আসে, প্রথমে আসে ট্র্যাজেডি হিসেবে, দ্বিতীয়বার প্রহসন হিসেবে।’ এই সব ভাষণ বা উক্তি আজও কত বাস্তব।
আধুনিক তুরস্কের জনক কামাল পাশা আতাতুর্ক তাঁর এক ভাষণে বলেছিলেন, ‘মায়েদের শিক্ষিত কর’, ‘নারীদের স্বাধীনতা প্রদান কর’। তিনি নারী শিক্ষাসহ শিক্ষা ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন আনেন। তিনি নারীদের ঘরের বাইরে এনে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে যুক্ত করেন। সাংবিধানিক নিয়মানুযায়ী আজও তুরস্কের জাতীয় দিবসে তাঁর ভাস্কর্যের সামনে দাঁড়িয়ে তাঁকে সম্মান জানানো হয়। ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ান বোনাপার্ট এক ভাষণে বলেছিলেন, ‘আমাকে শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদেরে শিক্ষিত জাতি উপহার দেব।’ ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ তার এই ভাষণে বাঙালি জাতি উদ্বোধিত হয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে পৃথিবীর মানচিত্রে জন্ম নেয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। আমরা পেলাম একটি জাতীয় পতাকা, একটি জাতীয় সংগীত।
আমেরিকার জনপ্রিয় ম্যাগাজিন নিউজউইক বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণকে বিশ্লেষণ করে তাঁকে রাজনৈতিক কবি উপাধি দেয়। এই ভাষণকে বিশ্বের প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেসকো। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে তোফায়েল আহমেদ, আব্দুর রাজ্জাক, মতিয়া চৌধুরী, মো. হানিফ, মিজানুর রহমান চৌধুরী, অলি আহাদ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদ, শিরিন আখতার, মোহাম্মদ ফরহাদ, মাহমুদুর রহমান মান্না, সুলতান মনসুরসহ অনেকের ভাষণ বা বক্তৃতা জনমনে প্রভাব ফেলেছিল। এসব বক্তারা মঞ্চে উপস্থিত থাকলে মানুষের মনে একটা কৌতূহল থাকত যে, তাঁরা কী বলেন। তাঁদের বক্তব্য শোনার জন্য মানুষ বসে থাকত।
স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় দেখা যায়, জাতীয় রাজনৈতিক নেতাদের চেয়ে ছাত্রনেতারা অধিক জনপ্রিয়। তাঁদের বক্তব্য শোনার জন্য মানুষ অধীর আগ্রহে বসে থাকত। কালের পরিক্রমায় এখন কেন যেন বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ রাজনৈতিক ভাষণ বা বক্তৃতার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। এখন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরাই শুধু তাঁদের শ্রোতা। অবশ্য ব্যতিক্রম একজন আছেন, আর তিনি হচ্ছেন আমাদের রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ। ইদানীং তাঁর ভাষণগুলো খুবই জনপ্রিয়। তাঁর ভাষণগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ও ইউটিউবে লাখো মানুষ দেখেন ও শোনেন। কারণ, তিনি হাসির ছলে বা কৌতুক করে অনেক গুরুত্বপূর্ণ জিনিস খুব সহজভাবে বলেন, যা মানুষের ভালো লাগে।
এবার আসি রাজনীতির বাইরেও কিছু মানুষ আছেন, যাদের ভাষণ বা বক্তৃতা শোনার জন্য মানুষ এখনো অপেক্ষা করে। অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সাঈদ, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। তাঁদের বক্তব্য শোনার জন্য আজও হাজারো তরুণ-তরুণী ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। প্রয়াত হুমায়ুন আজাদ, তিনি যেখানেই দাঁড়াতেন সেটা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর হোক আর বইমেলার মাঠ হোক, আজিজ সুপার মার্কেট হোক বা হোক সেটা শাহবাগের মোড়—সেখানেই তাঁকে ঘিরে লোকজন দাঁড়াত তাঁর মুখ থেকে দুটি কথা শুনতে। তিনি ছিলেন সেই সময়ের একজন স্পষ্ট বক্তা। ছিলেন আরেকজন। তিনি হচ্ছেন প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক। তিনি বাংলাদেশের তরুণদের স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেছিলেন, হয়ে উঠছিলেন এ প্রজন্মের প্রেরণা ও সাহসের উৎস। তাঁর এক ভাষণে তিনি তরুণদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘আমি আনিসুল হক যদি মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে এসে মাইলের পর মাইল পথ হেঁটে মফস্বলের স্কুলে লেখা পড়া করে ঢাকা শহরের মেয়র হতে পারি, তবে তোমরাও একদিন পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ নাগরিক হতে পারবে।’
এবার সংক্ষেপে প্রবাসে বাঙালির ভাষণ বা বক্তৃতা নিয়ে একটু বলি। প্রবাসের প্রায় প্রতিটি অনুষ্ঠানেরই এক বিরাট অংশজুড়ে থাকে আয়োজকদের ভাষণ বা বক্তৃতা। সেই ভাষণ কেউ শুনছে কি না, সেটা তাঁদের কাছে তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। কেউ কেউ বক্তব্য শুরু করলে আর থামতে চান না। সেসব ভাষণে শুধু ‘আমি আর আমি’। ‘আমি এই করেছি’, ‘আমি এই করলাম’, ‘আমি এই করব’ ইত্যাদি। মানুষ এখন আর এসব অর্থহীন ভাষণ শুনতে আগ্রহী নয়। তাই দেখা যায়, নেতারা যখন ভাষণ দেন সামনের আসনগুলো থাকে ফাঁকা। ভাষণ পর্ব শেষ হলে ধীরে ধীরে মানুষজন আসেন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখতে। গত বছর গ্রীষ্মে নিউইয়র্কে লাখ লাখ ডলার ব্যয়ে এক অনুষ্ঠানে আয়োজকেরা যখন একের পর এক বক্তব্য দিতে থাকেন, তখন দর্শকেরা চিৎকার দিয়ে বলতে থাকেন, ‘আমরা টিকিট কেটে আপনাদের বক্তৃতা শুনতে আসিনি। আমরা এসেছি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখতে।’ দর্শকদের হইচইয়ের একপর্যায়ে আয়োজকেরা তথাকথিত ভাষণ বন্ধ করে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু করতে বাধ্য হন।
একসময় যে ভাষণ বা বক্তৃতা শোনার জন্য মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকত, এখন কেন সেই একই মানুষ বক্তৃতার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। কারণ হচ্ছে, এখন সবাই নেতা, সবাই বক্তা। একসময় যোগ্য মানুষেরাই নেতৃত্বে আসতেন এবং তাঁরাই বক্তব্য দিতেন। সেসব বক্তৃতায় থাকত মানুষের কথা, মানবতার কথা, শিক্ষার কথা, সমাজের কথা, আশার কথা, সংস্কৃতির কথা, ঐক্যের কথা, মঙ্গল, কল্যাণ, ভালোবাসা, সত্য, সুন্দর, তথা ইতিবাচক চেতনা ও আত্মিক সূচিতা অর্জনের কথা। ভালো বক্তা হতে হলে ভালো ভালো বই পড়তে হবে, মহীয়সীদের আত্মজীবনী পড়তে হবে, ইতিহাস জানতে হবে। আর সকল ক্ষুদ্রতা পরিহার করে মুক্তবুদ্ধির চর্চা করে মানুষে মানুষে হৃদ্যতা বাড়িয়ে মানবতার জয়গান গাইতে হবে।