মানুষের মৌলিক আবিষ্কার

মানুষের সবচেয়ে সফল ও মৌলিক আবিষ্কার হচ্ছে সময়। সময় একটি বিমূর্ত ধারণা মাত্র। সময়ের আদি–অন্ত নেই। ইংরেজিতে যাকে বলে ইটারনাল (Eternal)। আরও সহজ করে বলতে গেলে বলতে হয়, যার শুরু নেই, শেষও নেই। আসলে সময় বলতে কোনো কিছু নেই। দিন–রাত বলতে কোনো কিছু নেই। পৃথিবী ঘুরছে, ঘুরছে তো ঘুরছেই। এই ঘোরাটাও ইটারনাল, এটা কখন শুরু হয়েছিল কেউ জানে না। কখন শেষ হবে তাও কেউ জানে না। ঘুরতে ঘুরতে সূর্যের দিকে যে অংশটা পড়ে, তাতে সূর্যের আলো এসে পড়ে আর তা আলোকিত হয় বলে আমরা সে অংশটিকে তখন দিন বলি। অনুরূপভাবে যে অংশটি সূর্যের উল্টো দিকে পড়ে, সেই অংশটিতে সূর্যের আলো পড়ে না, তাই আলোকিতও হয় না। সেই অংশটিকে আমরা রাত বলি।
বস্তুত দিন ও রাত বলতে আসলেই কিছু নেই। তবুও দিন রাতের পার্থক্য অনেক। দিনে আলো আছে, রাতে নেই। আবার এই দিন বা রাত স্থায়ী নয়। পৃথিবী যেহেতু ঘুরছে। দিন রাত ও ঘুরছে। তাই একই সময়ে পৃথিবীর কোথাও দিন আবার কোথাও রাত। কোথাও মধ্য রাত কোথাও মধ্য দিন। কোথাও সকাল কোথাও সন্ধ্যা। কিন্তু একটু চিন্তা করে দেখলেই বোঝা যায় দিন বা রাত বলতে আসলে কিছু নেই। যেমন ধরুন সকাল ৭টা, পৃথিবীর কোনো না কোনো স্থানে প্রতিনিয়তই সকাল ৭টা বাজে। অর্থাৎ আপনি যেখানে আছেন সেখানে আপনার স্থানীয় সময় যাই হোক না কেন ঠিক ওই সময়ে পৃথিবীর কোথাও না কোথাও সকাল ৭টা বাজবেই।
সেই অর্থে সময় বলতেও আসলে কিছু নেই এটি একটি বিমূর্ত ধারণা বৈ কিছুই নয়। এই বিমূর্ততাকে মূর্ততাদান মানব সভ্যতার সবচেয়ে মৌলিক ও সফল উদ্ভাবন। সময়ের আবিষ্কারের ফলে আমরা সময়ের হিসাব করতে পারি। অর্থাৎ আমরা একটি নির্দিষ্ট সময়ের উল্লেখের মাধ্যমে কল্পনা করতে পারি একটি নির্দিষ্ট ঘটনা কত আগে ঘটেছিল বা একটি নির্ধারিত ঘটনা কত পরে ঘটবে। এটি কেবলই অনুমান করা, ধরা ছোঁয়ার কোনো বিষয় এতে নেই। এই যে ২০১৯ সাল বিদায় নিল এটাকে ধরা ছোঁয়ার কিছু আছে? ২০২০ শুরু হলো, এখন ২০১৯ এর কোনো সময়, দিন বা রাতের সঙ্গে ২০২০ এর কোনো সময়ের কোনো পার্থক্য আছে। রং, রস, স্বাদ কিংবা গন্ধে? নেই। থাকবে কী করে এত কেবলই বিমূর্ত ধারণা। সময় বলে তো আসলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই।
তবুও সময়েরই স্রোতে ভেসে চলেছি আমরা, আমাদের জীবন, আমাদের কর্ম, প্রচেষ্টা সবই সময়কেন্দ্রিক। আজ পৃথিবীতে প্রায় ৭০০ কোটি মানুষ আছে। আজ থেকে ১০০ বছর পর আজ যে শিশুটি জন্ম নিল, সেসহ এই ৭০০ কোটি মানুষের একটি মানুষও পৃথিবী নামক এই গ্রহটির ওপরে জীবিত থাকবে না। সবাই মাটির নিচে চলে যাবে বা মাটির সঙ্গে মিশে যাবে। কিন্তু আমি নিশ্চিত, পৃথিবীতে তখন কম করে হলেও ১৫০০ কোটি মানুষ থাকবে। ওই মানুষগুলো কারা? এখন ওরা কোথায় আছে? এরা কেউই আকাশে ‘মাকামে মাহমুদ’ বা আত্মাদের গোডাউনে জমা নেই। এরা সবাই আমাদের শরীরে, আমাদের সন্তানদের শরীরে আছে। সেখান থেকেই এরা সময় মতো বেরিয়ে আসবে। অনুরূপ আজ থেকে ১০০ বছর আগে, বর্তমানে যে ৭০০ কোটি মানুষ আজ পৃথিবীতে আছে তাদের কেউই ছিল না। কিন্তু পৃথিবীতে তখনো শত কোটি বা কয়েক শ কোটি মানুষ ছিল। তারা এখন কোথায়? সবাই জানি, তারা কোথায়। মাটির সঙ্গে মিশে গেছে।
সুতরাং একটু চিন্তা করলেই বোঝা যায়, এই আদি-অন্তহীন সময়ের একটি নির্দিষ্ট ক্ষণে আমরা এই পৃথিবীর বুকে বিরাজ করছি। যে যত ক্ষমতাবানই হই না কেন, সময়ের স্রোতে ভেসে আসা এই জীবন আবার সময়ের স্রোতে সময়মতোই ভেসে যাবে। স্থির থাকবে না। প্রশ্ন হচ্ছে, শুধুই কী মানুষের জীবন সময়ের স্রোতে ভেসে যাবে? না, সময়ের স্রোতে সবকিছুই ভেসে যায়, বদলে যায়। সভ্যতা ভেসে যাবে, মানুষের বিশ্বাস ভেসে যাবে, সাম্রাজ্য ভেসে যাবে, ক্ষমতা ভেসে যাবে—সব কিছুই ভেসে যাবে। পৃথিবীতে সময়ের চেয়ে সত্য আর কিছু নেই। ‘জানি প্রেম যত তীব্র, যত সত্য হোক সময়ের চেয়ে সত্য নয়।’
সবাইকে ইংরেজি নববর্ষের শুভেচ্ছা।
সুখ-সমৃদ্ধি, আনন্দ-ভালোবাসায়,
সফলতা-সার্থকতায় ভরে থাকুক
সবার জীবনে, ২০২০ সালের শুরুতেই
এই কামনা অহর্নিশ।