যুক্তরাষ্ট্র এখন কী করবে

২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলা হয়ছবি: রয়টার্স

বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য বিস্তারের ইতিহাস বেশ পুরোনো। এই প্রবণতা থেকে যুক্তরাষ্ট্র স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বিভিন্ন দেশে জাতি গঠনের ‘গুরুদায়িত্ব’ নিজ কাঁধে তুলে নেয়। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের (৯/১১) সন্ত্রাসী হামলা এই বিশ্ব মোড়লের হাতে নতুন অজুহাত তুলে দেয়। সেই অজুহাতকে অস্ত্র করে আফগানিস্তানসহ বিভিন্ন দেশে সামরিক অভিযান শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। আফগানিস্তানে ২০ বছর ধরে যুদ্ধ করে বিফল হওয়ার পর এখন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন বোধোদয় হয়েছে। তারা আর জাতি গঠনের কাজে নেই।

জর্জ ডব্লিউ বুশ
ছবি: রয়টার্স

পরাশক্তিদের কারও দায়িত্ব দিতে হয় না। যুক্তরাষ্ট্রও এর ব্যতিক্রম নয়। গত শতকে তারা জাপান, জার্মানি, সোমালিয়া, বসনিয়া, কসোভো, হাইতিসহ বিভিন্ন দেশে জাতি গঠনের কাজ করেছে।

রিপাবলিকান পার্টির জর্জ ডব্লিউ বুশ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার আগে দেশটির জাতি গঠনের এই নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। তিনি এ নিয়ে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনকে খোঁচাও দিয়েছিলেন। সেই বুশই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে চলতি শতকের শুরুর বছরই জাতি গঠনে নেমে পড়েন। বুশ অবশ্য তাঁর আত্মজীবনীতে দাবি করেছেন, প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর একটি ভয়ংকর ঘটনা তাঁর মন বদলে দেয়।

৯/১১-এর জের ধরে আফগানিস্তানে আগ্রাসন চালায় যুক্তরাষ্ট্র
ছবি: রয়টার্স

২০০১ সালের ২০ জানুয়ারি বুশ মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। একই বছরের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা হয়। এই হামলার ঘটনায়ই বুশের মন বদলে যায় বলে দাবি তাঁর।

৯/১১-এর হামলার জের ধরে যুক্তরাষ্ট্র এক দীর্ঘমেয়াদি ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে’ নামে। তৎকালীন তালেবানশাসিত আফগানিস্তানে সামরিক অভিযান চালানোর মধ্য দিয়ে এই সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটে। তারপর ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়ায়ও সামরিক অভিযানে যায় যুক্তরাষ্ট্র। তবে তারা কোথাও সফল হতে পারেনি। উল্টো বিশ্বে আরও সন্ত্রাসবাদের বিস্তার ঘটে।

যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে নামলেও দেশটির কার্যক্রম শুধু সন্ত্রাস দমনের মধ্য আটকে থাকেনি। মার্কিন নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটের হামলায় আফগানিস্তানে জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদার আশ্রয়দাতা তালেবান সরকারের পতন ঘটে অল্প দিনের মধ্যেই। তারপর যুক্তরাষ্ট্র যথারীতি আফগানিস্তানে জাতি গঠনের কাজে যুক্ত হয়। এ কাজ করতে গিয়ে আফগানিস্তানে ২০ বছরের এক যুদ্ধে আটকে যায় তারা।

বারাক ওবামা
ছবি: রয়টার্স

বুশের পর যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতায় এসে বারাক ওবামা ও ডোনাল্ড ট্রাম্প আফগান যুদ্ধের সমাপ্তি টানার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। মার্কিন জনমতের কথা মাথায় রেখে ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট প্রার্থী জো বাইডেন তাঁর নির্বাচনী প্রচারে আফগান যুদ্ধের অবসান ঘটানোর প্রতিশ্রুতি দেন। তিনি ঘোষণা দেন, প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে আফগানিস্তান থেকে সব মার্কিন সেনা দেশে ফিরিয়ে আনবেন।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব গ্রহণের পরই বাইডেন তাঁর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণে ত্বরিত উদ্যোগ নেন। চলতি বছরের মধ্য এপ্রিলে বাইডেন ঘোষণা দেন, ৯/১১-এর হামলার ২০ বছর পূর্তির আগেই শেষ মার্কিন সেনা আফগানিস্তান ছাড়বেন। গত জুলাইয়ের শুরুর দিকে তিনি জানিয়ে দেন, আফগানিস্তানে মার্কিন বাহিনী তার লক্ষ্য অর্জন করেছে। আল-কায়েদার প্রতিষ্ঠাতা ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা করা হয়েছে। আল-কায়েদাকে দুর্বল করে দেওয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে আরও হামলা চালানোর বিষয়টি প্রতিহত করা হয়েছে। তাই আফগানিস্তানে মার্কিন সামরিক মিশন ৩১ আগস্ট শেষ হবে।

আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের প্রক্রিয়ার মধ্যেই তালেবান দেশটির একের পর এক এলাকা দখল করে নেয়। তালেবানের ঝোড়ো অভিযানের সামনে তাসের ঘরের মতো ভেঙে যায় দুই দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে গড়ে ওঠা আফগান বাহিনী। মার্কিন সেনারা আফগানিস্তান ছাড়ার আগেই গত ১৫ আগস্ট তালেবানের হাতে রাজধানী কাবুলের আকস্মিক পতন হয়। কাবুল পতনের মুখে যুক্তরাষ্ট্রসমর্থিত আফগান সরকারের প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি দেশ ছেড়ে পালান।

ডোনাল্ড ট্রাম্প
ছবি: রয়টার্স

আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ তালেবানের হাতে যাওয়ার পর কাবুল থেকে সামরিক-বেসামরিক লোকদের সরিয়ে নিতে সশস্ত্র সংগঠনটির সঙ্গে দেনদরবারে পর্যন্ত যেতে হয়। ভিয়েতনাম যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের করুণ প্রস্থান দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি ঘটে কাবুলে। শুধু তা-ই নয়, লোকজনকে সরানোর সময় কাবুল বিমানবন্দরে জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের (আইএস) বোমা হামলায় ১৩ মার্কিন সেনা নিহত হন। এ কারণে আফগানিস্তান থেকে পাততাড়ি গোটানোর যাত্রায়ও যুক্তরাষ্ট্রকে লাশ বইতে হয়। এখন খোদ মার্কিন সমালোচকেরাই বলছেন, কাবুলে যুক্তরাষ্ট্র তার ইতিহাসের সবচেয়ে লজ্জাজনক প্রস্থান দেখেছে। আফগানিস্তানে জাতি গঠনের মাশুল যুক্তরাষ্ট্রকে চরমভাবেই দিতে হয়েছে।

আফগান যুদ্ধের সমাপ্তির মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এক নতুন পররাষ্ট্রনীতির যুগে প্রবেশ করেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন সম্প্রতি সুস্পষ্টভাবে বলেন, ৯/১১-পরবর্তী ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র আর জাতি গঠনের কাজে দেশের বাইরে যাবে না। তারা সামরিক শক্তি দিয়ে অন্য দেশ পুনর্গঠন করতে যাবে না।

বাইডেন প্রশাসনের নীতিনির্ধারকদের ভাষ্যমতে, এখন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির মূল দৃষ্টি থাকবে চীন ও রাশিয়ার দিকে। এই দুটি দেশকে এ মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হিসেবে দেখা হচ্ছে। ফলে, এখন চীন-রাশিয়াকে সামলানোই হবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান কাজ।

৩০ আগস্ট দিবাগত রাতে শেষ মার্কিন সেনা কাবুল ছাড়েন
ছবি: রয়টার্স

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে সাইবার নিরাপত্তার দিকটি গুরুত্ব পাবে বলে মার্কিন গণমাধ্যমে বলা হচ্ছে। বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বের ভবিষ্যৎ লড়াইয়ের প্রধান হাতিয়ার হবে সাইবার ক্ষেত্র।

তাই বলে, যুক্তরাষ্ট্র তার সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ থেকে সরছে না। তবে নতুন নীতি অনুযায়ী এই যুদ্ধের ধরনে পরিবর্তন আসবে। তারা সন্ত্রাস দমনের জন্য বাইরের কোনো দেশের মাটিতে মার্কিন সেনাদের পাঠাবে না। বাইডেনের ভাষায়, সন্ত্রাসবাদবিরোধী লড়াই নিয়ন্ত্রিত হবে দূরদিগন্ত থেকে। অর্থাৎ, স্যাটেলাইট প্রযুক্তি ও মনুষ্যবিহীন ড্রোন ব্যবহার করে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়বে যুক্তরাষ্ট্র।

জো বাইডেন
ছবি: রয়টার্স

জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার জন্য প্রয়োজন হলে যুক্তরাষ্ট্র দেশের বাইরে সামরিক পদক্ষেপে যাবে। কিন্তু তা হবে স্বল্প সময়ের জন্য। আর এ ক্ষেত্রে অবশ্য লক্ষ্য হবে স্পষ্ট ও অর্জনযোগ্য।

নতুন যুগেও মানবাধিকার ও গণতন্ত্র যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করবে। কিন্তু তারা আর সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে কোনো দেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় যাবে না। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের হাতিয়ার হবে অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক পদক্ষেপ। মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির এই নতুন দিক সম্পর্কে বলতে গিয়ে দ্য গার্ডিয়ানের কূটনৈতিক সম্পাদক প্যাট্রিক উইনটোর যে ইঙ্গিত দেন, তার অর্থ হলো গণতন্ত্র রপ্তানির ব্যবসা বন্ধ করতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।

কিন্তু প্রশ্ন হলো যুক্তরাষ্ট্র কি তার পুরোনো অভ্যাস ছাড়তে পারবে? নতুন পররাষ্ট্রনীতি দিয়ে ওয়াশিংটন কি বিশ্বে তার মোড়লপনা বজায় রাখতে পারবে? এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে বিশ্বকে অপেক্ষা করতে হবে।

তথ্যসূত্র: গার্ডিয়ান, রয়টার্স, এএফপি