রঙিন বাহামা ও বাংলাদেশ

২৫ ফেব্রুয়ারি, দুপুর। জাহাজ চলছে আটলান্টিক মহাসাগরে। সাউথ ক্যারোলাইনার উপকূল থেকে প্রায় ২০০ মাইল দূর দিয়ে। আফ্রিকা ও ইউরোপের পশ্চিম উপকূল থেকে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত জলরাশির নাম আটলান্টিক মহাসাগর। অভিধানে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী ‘আটলান্টিক’ শব্দটির উৎপত্তি গ্রিক ‘এটলাস’ (ম্যাপ) শব্দ থেকে। কিন্তু বাংলায় নামটি হতে পারে ‘অতলান্তিক’—অন্তহীন তল বা যার কোনো তল নেই। আমার কাছে উচ্চারণ ও শব্দার্থের বিচারে ‘এটলাস’ ও আটলান্টিক’–এর সম্পর্কের চেয়ে ‘অতলান্তিক’ উচ্চারণ এবং ‘অন্তহীন তল’–এর সম্পর্ক অনেক যুক্তিযুক্ত মনে হলো। এই যুক্তিতে ‘আটলান্টিক’ শব্দের আদিরূপ ‘এটলাস’ নয়, ‘অতলান্তিক’ হওয়ার কথা। আধুনিক অঙ্কশাস্ত্রের অত্যাবশ্যকীয় ‘শূন্য’ ‘সংখ্যা’টির উৎপত্তি হয়েছিল প্রাচীন ভারতবর্ষে। রাজনীতি, সমাজনীতি, সমরনীতি ও অর্থনীতির বিজ্ঞানসম্মত প্রাচীনতম গ্রন্থও রচিত হয়েছিল এই ভারতবর্ষেই। তাই আধুনিক ‘আটলান্টিক’ শব্দটির উৎপত্তি প্রাচীন ভারতের অন্যতম, বাংলা ভাষা থেকেই হয়েছিল বলে যদি জানতাম, তবে বেশ ভালো লাগত।
আমাদের গন্তব্য বাহামার তিনটি দ্বীপ। আটলান্টিক মহাসাগরে সাত শতাধিক দ্বীপ ও চরের সমন্বয়ে বাহামা দ্বীপপুঞ্জ বা দেশটি গঠিত। ১৪৯২ সালে এখানকার একটি দ্বীপ সান সালভাদরে স্পেনের নাবিক ক্রিস্টোফার কলম্বাস প্রথম নোঙর ফেলেছিলেন। এলাকাটি ‘বাহামা’ নামে ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভ করে ১৯৭৩ সালে। উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার মাঝে জিডিপি উৎপাদনশীলতার মাপে আমেরিকা এবং কানাডার পরেই বাহামার স্থান। লোকসংখ্যা চার লাখের নিচে। জাতিগতভাবে ৯০ শতাংশ কালো, ৫ শতাংশ সাদা এবং ২ শতাংশ সংকর। ৩০০ বছর আগে জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ ছিল সাদা। পর্যটন ও মূলধন লগ্নিনির্ভর অর্থনীতি। এর পরেই আসে কৃষি খাত পেঁয়াজ, ঢ্যাঁড়স, কমলা, টমেটো, শসা, আখ, মিষ্টি আলু, আম। রাজধানী নাসাউ আমেরিকার ফ্লোরিডা রাজ্যের মায়ামি থেকে আকাশপথে মাত্র এক ঘণ্টা দূরে।
বাহামা দ্বীপপুঞ্জের আশপাশে স্ফটিকস্বচ্ছ পানির রং অত্যন্ত সুন্দর ও মায়াবী। টিভি প্রচারণায় আপনারা নিশ্চয়ই প্যারাডাইস আইল্যান্ডের দৃশ্য দেখেছেন ও শুনেছেন। প্রচারণার জন্য সবকিছুকে ফুলিয়ে–ফাঁপিয়ে দেখানো হয়। কিন্তু তিন দিন সামান্য কয়েক ঘণ্টা করে অবস্থান করলেও মনে হলো আসল স্থানটি প্রচারণায় দেখানো দৃশ্যের তুলনায় অনেক গুণ বেশি সুন্দর। অসংখ্য স্নান-সৈকত নিয়ে রাজধানী নাসাউসংলগ্ন শুধু প্যারাডাইস আইল্যান্ডই নয়, আর যে দুটো দ্বীপ, প্রিন্সেস কেয় এবং বাণিজ্যকেন্দ্র ফ্রি-পোর্ট দ্বীপে আমাদের জাহাজটি ভিড়েছিল সেখানকার পানির রং এবং প্রাকৃতিক দৃশ্য সবই দুই চোখ ভরে উপভোগ করার মতো। ‘জেমস বন্ড’ সিরিজের থান্ডারবোল্ট, নেভার সে নেভার অ্যাগেইন এবং ফর ইয়োর আইস অনলি সিনেমাগুলোর অনেক সুন্দর দৃশ্য এখানেই ধারণ করা হয়েছিল।
এখানকার ছোট দ্বীপগুলো প্রেমিক-প্রেমিকা ও কবিদের তীর্থস্থান হওয়ার মতো। তৃষ্ণা পেয়েছে? নারিকেলবীথিতলে ডাবের পানি খেয়ে প্রাণটি জুড়িয়ে নিন। খিদে পেয়েছে? কচি ডাবের শাঁসটিই খেয়ে নিন না? আহা কী মজা! গাছের ছায়ায় ও শাখায় বাঁধা দড়ির ঝোলানো বিছানায় চোখ বুজে শুয়ে থাকুন, কবিতার পাখিরা নানান শব্দের ঝংকারে আপনাকে গান শোনাবে। পাশে প্রেয়সী থাকুক আর না–ই থাকুক, নানা রঙের পাখনা মেলে প্রজাপতিরা আপনাকে ঘিরে রাখবে। আপনাকে এই শান্ত, সুনিবিড় এবং একাকী সময় উপভোগের সুযোগ দিতে অনেক দূরে কিন্তু আপনার দৃষ্টি সীমানার মাঝেই চিত্রিত ঝকঝকে সাদা বকের মতো জাহাজটি সাগরের মাঝখানে অপেক্ষা করবে। মনে হবে আপনি অপার্থিব এক স্বপ্নপুরীতেই আছেন। তারপর একসময় ক্লান্ত সূর্যটি ঢলে পড়লে, পাখিরা ফিরে গেলে আপনার কবিতার ছন্দটি ধরা দিলে, অপেক্ষারত নাবিকদের কাঁধে ভর করে আপনি আবার জাহাজে ফিরে আসবেন।

পানির রং কোথাও গাঢ় নীল, কোথাও সবুজ, কোথাও নীল-সবুজের মাঝামাঝি, আবার কখনো লাল-গোলাপি কিন্তু সবই স্বচ্ছ। নিচের রঙিন উদ্ভিদ, বালু, পাথর বা কোরাল সূর্যের আলোর যে রংটি শুষে নিতে পারে না, আমাদের চোখে পানিটি সেই রঙেই দেখা দেয়। নিচে সবুজ সামুদ্রিক ঘাস বা শেওলা থাকলে পানির রং হয় সবুজ। অনেক গভীরে সূক্ষ্ম কণা বালু থাকলে রং হয় গাঢ় নীল। রঙিন কোরাল থাকলে হয় লাল-গোলাপি। প্রস্তরখণ্ড থাকলে রং হয় খয়েরি-কালচে। সূর্যের আলো কখন, কীভাবে এবং কত তির্যকভাবে পানিতে পড়ছে, তার ওপর নির্ভর করে পানির রং ভিন্ন ভিন্ন গাঢ় ও হালকা রঙের সমাহার নিয়ে দেখা দেয়।
বাহামা দীপপুঞ্জের বাইরে সবুজ বা নীল-সবুজের মাঝামাঝি রং পৃথিবীর আর কোথাও দেখা যায় না বলে শুনে এসেছি। কিন্তু স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্ত গুগল ম্যাপে বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে আশ্চর্য হয়ে গেলাম। উপকূলীয় কক্সবাজার থেকে শুরু করে বাংলাদেশের পুরো দক্ষিণাঞ্চল হয়ে ভারত-পশ্চিম বাংলার দিঘার উপকূলে পানির রং নীল-সবুজ। সন্দীপ, টেঙ্গার চর, হাতিয়া, নিঝুম দ্বীপ, চর নিজাম, কুয়াকাটা, দুবলার চরের মাটি ছেড়ে পানির দিকে আধা মাইল গেলেই মন মাতানো সুন্দর এই রং। রংটি বঙ্গোপসাগরের প্রায় ১০ থেকে ৭০-৮০ মাইল ভেতরে বিস্তৃত। ধারণা করি, আমাদের উপকূলের পানির নিচে সবুজ সামুদ্রিক ঘাস বা শেওলার ফলেই পানির রং এত সুন্দর।
আয়তনের দিক দিয়ে এটি বাহামা দীপপুঞ্জের সবুজ পানির আয়তনের চেয়ে বড় না হলেও বাংলাদেশ উপকূলের সবুজ পানিকে খুব ছোট মনে হয়নি। অথচ কারও কাছে আজ পর্যন্ত এই সুন্দর সবুজ পানির কথা শুনলাম না কেন? কক্সবাজারের বাইরে আমাদের দেশি পর্যটকেরা সুন্দরবনের কটকা সৈকত ও কুয়াকাটায় ভিড় করে সুযোগ পেলেই। কিন্তু কারও লেখায় তো পানির সৌন্দর্যের কথা দেখি না! তাহলে ম্যাপে আমার দেখা কি ভুল? গুগল ম্যাপটি ভুল না হলে আমার ভুল হওয়ার কথা নয়। তবে এমনও হতে পারে যে স্যাটেলাইট থেকে যখন দৃশ্যটি ধারণ করা হয়েছিল, ঠিক সেই মুহূর্তে সূর্যকিরণের তির্যকের বিশেষ কোণের ফলে বাংলাদেশের উপকূলের পানি সবুজ দেখাচ্ছিল, যা অন্য সব সময়ে সবুজ থাকে না। আমরা জানি, স্যাটেলাইট থেকে নতুন নতুন ছবি ও তথ্য দিয়ে গুগল অনবরত ম্যাপ আপডেট করে। ব্যাপারটি পরখ করতে আমি কয়েক দিন বাদে বাদে গুগলের স্যাটেলাইট ম্যাপটি দেখি। কমবেশি পার্থক্য থাকলেও প্রতিবারই বাংলাদেশের উপকূলের পানিকে বাহামা অঞ্চলের পানির মতোই উজ্জ্বল সবুজ-নীল দেখতে পাই। তাহলে উপকূলীয় বাংলাদেশের পানির সৌন্দর্য আন্তর্জাতিক দরবারে স্বীকৃত হয়নি বা হয় না কেন?
বেশ কিছু সম্ভাব্য কারণের কথা ভাবা যায়। প্রথমত, প্রায় ৫০০ বছর থেকে বাহামা দ্বীপপুঞ্জের মালিকানা বেনিয়া ইউরোপীয়দের হাতে থাকায় বর্তমানে স্বাধীন দেশটির ভাষা ও সংস্কৃতি ইউরোপ প্রভাবিত। ফলে, ৫০ বছর আগে পানির সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে জনৈক দক্ষিণ আফ্রিকা উদ্যোক্তার মনে অঞ্চলটিকে পর্যটকদের তীর্থস্থান করার যে পরিকল্পনা মাথায় আসে, স্থানীয়রা তাঁকে স্বাগত জানায়। মূলত, ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তা গোষ্ঠী বিশেষ করে সামুদ্রিক প্রমোদতরি কোম্পানিগুলোর প্রচারণা ও প্রচেষ্টার ফলেই বাহামা অঞ্চলের পানির সৌন্দর্যের কথা আমরা জানি। এই সব প্রমোদভ্রমণের আবশ্যিক উপকরণ হচ্ছে নারী-পুরুষ একত্রে সাঁতার কাটার ব্যবস্থা, ক্যাসিনোতে জুয়া খেলা এবং স্বল্পমূল্যে মদ্যপান। একই উদ্যোক্তা গোষ্ঠী যদি বাংলাদেশের উপকূলের পানিতে তেমন ব্যবসায়িক চিন্তা করেও থাকে, আমাদের রক্ষণশীল সমাজ ও সরকার এই ধরনের প্রমোদ ব্যবস্থায় কোনো মতেই যে সাড়া দেবে না, তা বলাই বাহুল্য। কাজেই আমাদের পানির সৌন্দর্যের কথা বিশ্ববাসীর কাছে দূরে থাকুক, বাংলাদেশে বসবাসকারীদের কাছেই অজানা রয়ে গেছে।
আরেকটি কারণও থাকতে পারে। গুগল ম্যাপের খুব কাছে গিয়ে লক্ষ করলে দেখা যায়, বাংলাদেশের উপকূলের পানির রং সবুজ হলেও পানি স্বচ্ছ নয়, বরং ঘোলাটে। আমার ধারণা, হিমালয় থেকে নেমে আসা জলের ধারা পদ্মা-মেঘনা-যমুনা এবং তাদের অজস্র শাখা নদী দিয়ে যখন বঙ্গোপসাগরে আছড়ে পড়ে, তখন সঙ্গে আনা অতি সূক্ষ্ম পলিমাটি অনবরত উপকূলের পানিতে ভেসে বেড়ায়। আমাদের অধিকাংশ পর্যটক স্থলভূমির কাছে থাকেন বলেই পানিতে পলিমাটির আধিক্য থাকাতেই হয়তো তাঁদের চোখে পানির সবুজ রং ধরা পড়ে না। পৃথিবীর অন্যত্র স্বচ্ছ সুন্দর পানি থাকতে ব্যবসায়ীরা আমাদের ঘোলা পানিতে বিনিয়োগ করতে যাবেন কেন? তবে গুগল ম্যাপে আমার দেখা তথ্যটি সত্য হলে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা সৃজনশীল কিছুও চিন্তা করতে পারেন। শুধু আমাদের দেশীয় পর্যটকের কথা মাথায় রেখেই হোক না।
বাহামা ও বাংলাদেশের আরেকটি আশ্চর্য সাদৃশ্যও উপেক্ষা করা যায় না। দেশ দুটি প্রায় অর্ধ গোলার্ধ দূরত্বে ও ভূপৃষ্ঠের প্রায় বিপরীত দিকে অবস্থান করলেও কর্কটক্রান্তি অক্ষরেখাটি দুই দেশের ওপর দিয়েই গেছে। ফলে, সারা বছর সূর্যকিরণ প্রায় সমান, আবহাওয়াও প্রায় এক। এই রেখার প্রায় পাঁচ ডিগ্রি দক্ষিণে দুই দেশেই সমুদ্র উপকূল, যেখানে পানির রং সবুজ ও নীল-সবুজ।
গুগল ম্যাপে অতি ছোট ছোট আর যে সবুজ পানি দেখতে পেয়েছি, সেগুলো হচ্ছে মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুন শহরের নিচে উপসাগর, চিনের সাংহাই শহরের পূর্বে হাংঝৌ উপসাগর এবং পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার ভ্যান-দিয়েমান সাগর।