রায়ে কি বদলাবে মার্কিন সমাজ

জর্জ ফ্লয়েড, ডেরেক চৌভিন

মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যের মিনিয়াপোলিসে জর্জ ফ্লয়েড হত্যার ঘটনায় শ্বেতাঙ্গ সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা ডেরেক চৌভিন আদালতে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। আদালতের রায়ের পর নড়েচড়ে বসেছে মার্কিন সমাজ। যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত এ ঘটনায় মার্কিন সমাজ ও রাজনীতিতে পরিবর্তন আসতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে। পুলিশ সংস্কার, বিচার ব্যবস্থার সংস্কার ও মার্কিন সমাজে কাঠামোগত বিদ্বেষ বৈষম্যের অবসানে আশুকরণীয় নিয়ে কথা উঠছে। বলা হচ্ছে, শ্বেতাঙ্গ পুলিশ কর্মকর্তাকে দোষী সাব্যস্ত করার মধ্য দিয়ে বিচার বিভাগ ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছে। এখন সবার দৃষ্টি আইন প্রণেতাদের প্রতি। পুলিশের সংস্কার উদ্যোগ নিয়ে মার্কিন সিনেটে আলোচনা শুরু হয়েছে, যদিও এতে বিভক্তির রয়েছে। জনগণের আবেগের সময়টিকে ধারণ করে মার্কিন রাজনীতিবিদদের মধ্যে ঐক্য গড়ে উঠবে, এটিই সবার প্রত্যাশা।

২০২০ সালের ২৫ মে মিনিয়াপোলিস শহরে শ্বেতাঙ্গ পুলিশ কর্মকর্তা চৌভিন কৃষ্ণাঙ্গ ফ্লয়েডকে গ্রেপ্তার করতে গিয়ে তাঁর ঘাড় হাঁটু দিয়ে সড়কে চেপে ধরেন। এতে ফ্লয়েড মারা যান। এ ঘটনার ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে নাগরিক আন্দোলন শুরু হয়।

আন্দোলনের সময় যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় নগরে ব্যাপক সহিংসতা ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। ফ্লয়েডের মৃত্যুর পর যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে মানুষের চাপা অসন্তোষের বিস্ফোরণ ঘটে। বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য পুলিশের তহবিল কর্তন করাসহ দ্রুত নানা সংস্কারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করে। আইনপ্রণেতাদের ওপর মার্কিন বিচারব্যবস্থার সংস্কারে চাপ আসে।

২০ এপ্রিল মিনেসোটার হেনেপিন কাউন্টি আদালতে জুরি বোর্ড তিনটি অভিযোগেই চৌভিনকে দোষী সাব্যস্ত করেন। ১২ সদস্যের জুরি বোর্ডে শ্বেতাঙ্গ, কৃষ্ণাঙ্গ ও মিশ্রবর্ণের বিচারক ছিলেন। পুরো যুক্তরাষ্ট্র তাকিয়ে ছিল এই বিচারের দিকে। হোয়াইট হাউস থেকে স্বয়ং প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়ে টিভির সামনে বসে বিচারের রায় শুনছিলেন।

রায় হওয়ার পর প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেন, এই বিচারের রায়ই যথেষ্ট নয়। আমাদের এখানে থামলে চলবে না। পরিবর্তন ও সংস্কার নিশ্চিত করতে হলে আমাদের আরও অনেক কাজ করতে হবে। যে কারণে এসব ঘটনা ঘটছে, তা কমিয়ে আনার জন্য অবশ্যই উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

প্রেসিডেন্ট বাইডেনের বক্তব্যে পুরো দেশের অধিকাংশ মানুষের মনের কথার প্রতিফলন ঘটেছে। যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ পুলিশের হয়রানির শিকার হওয়া নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। পুলিশের হাতে প্রতিবছরই কালো বর্ণের মানুষের মৃত্যু হচ্ছে।

ডেরেক চৌভিনকে দণ্ড দেওয়ার দিনেই ওহাইও অঙ্গরাজ্যের কলম্বাসে এক কৃষ্ণাঙ্গ কিশোরীকে গুলি করে হত্যা করে পুলিশ। দুই ব্যক্তিকে ছুরিকাহত করার সময় ওই কিশোরীকে গুলি করা হয়।

সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীর মধ্যে অপরাধ প্রবণতাও বেশি। এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে অপরাধ প্রবণতার বেশি মাত্রার পেছনে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যকে দায়ী করা হয়ে থাকে। মার্কিন সমাজ সভ্যতার নানা বাঁক পেরিয়ে আসলেও কাঠামোগত বৈষম্য ও বিদ্বেষের ঊর্ধ্বে এখনো যেতে পারেনি। একজন কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তিকে হত্যার ঘটনায় সাম্প্রতিক সময়ে এই প্রথম একজন শ্বেতাঙ্গ পুলিশ কর্মকর্তাকে হাতকড়া পরিয়ে কারাগারে নেওয়ার দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেছে মার্কিন সমাজ।

মামলার বিবরণ, ভিডিওচিত্র দেখে দণ্ডপ্রাপ্ত সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা ডেরেক চৌভিনের প্রতি কারও কোনো প্রকাশ্য সহানুভূতি দেখা যায়নি ঠিকই। আবার শ্বেতাঙ্গ রক্ষণশীলদের মধ্যে এ মামলার রায় নিয়ে কোনো উচ্ছ্বাসও দেখা যায়নি। রিপাবলিকান দলীয় শীর্ষ আইন প্রণেতাদের কাউকে বিবৃতি দিতে দেখা যায়নি। সাবেক ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন, বারাক ওবামা, সাবেক ফার্স্ট লেডি হিলারি ক্লিনটন মামলার রায়কে স্বাগত জানিয়েছেন।

* পুলিশ সংস্কার প্রস্তাব প্রতিনিধি পরিষদে পাস, এখন সিনেটে আলোচনার অপেক্ষায় * এখনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি রিপাবলিকান আইনপ্রণেতারা * পুলিশ সংস্কার নিয়ে রিপাবলিকানদের আগ্রহ কম

রিপাবলিকান দলের সদ্য সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত বছর জর্জ ফ্লয়েড নিহত হওয়ার পর নাগরিক আন্দোলনের বিরুদ্ধেই অবস্থান নিয়েছিলেন। তিনি সেনা মোতায়েন করে বিক্ষোভ দমনের চেষ্টা করেন। পুলিশের আচরণের কোনো সমালোচনা না করে পুলিশি ব্যবস্থাকেই সমর্থন করেছেন। বিক্ষোভ দমনে পুলিশ সদস্যদের আগ্রাসী তৎপরতাকে ব্যাপকভাবে প্রশংসা করেন। দেশের অধিকাংশ পুলিশ ইউনিয়ন গত নির্বাচনে ট্রাম্পের সমর্থনে প্রকাশ্য অবস্থান নেন। ডেরেক চৌভিনের মামলার রায়ের পর ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তাঁর সমর্থকেরা নীরব।

প্রভাবশালী মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন এক সম্পাদকীয় প্রতিবেদনে বলেছে, মামলার রায়ে জর্জ ফ্লয়েডের জীবন ফিরে পাওয়া যাবে না। একজন পুলিশ কর্মকর্তার হাঁটু চাপায় দম বন্ধ হয়ে ফ্লয়েডের মৃত্যুর দৃশ্য যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের স্মৃতি থেকে মুছেও যাবে না। তবে হাতকড়া লাগানো ডেরেক চৌভিনের কারাগারে যাওয়ার দৃশ্য মার্কিন নাগরিক আন্দোলনের সাফল্য হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।

রায় ঘোষণার পর জর্জ ফ্লয়েডের ভাই ফিলোন্সি ফ্লয়েড বলেছেন, এ রায় ঐতিহাসিক। ডেরেক চৌভিনের দণ্ড নিশ্চিত হওয়ার ঘটনা পরিবর্তনের একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত।

পুলিশ সংস্কার নিয়ে প্রতিনিধি পরিষদে পাশ হওয়া প্রস্তাবটি এখন সিনেটে আলোচনার অপেক্ষায়। ৫০-৫০ বিভক্তির সিনেটে এই আইন পাশ করা নিয়ে চাপ বেড়েছে। ক্যালিফোর্নিয়া থেকে প্রতিনিধি পরিষদে নির্বাচিত ডেমোক্র্যাট সদস্য ক্যারেন বাস পুলিশ সংস্কার আইনটি জর্জ ফ্লয়েডের নামে করার প্রস্তাব দিয়েছেন। ডেরেক চৌভিনের মামলার রায়ের পর প্রস্তাবটি নিয়ে সিনেটে উভয় দলের মধ্যে সমঝোতার সুযোগ তৈরি হয়েছে।

ডেমোক্র্যাটদের মতে, প্রস্তাবিত আইনটি পাশ হলে বর্ণ ও ধর্মীয় কারণে মানুষকে চিহ্নিত করার চলমান অবস্থার অবসান ঘটবে। কোনো সন্দেহভাজনকে গলা চেপে ধরা যাবে না, মাদক মামলায় ওয়ারেন্ট ছাড়া কারও দরজায় পুলিশ কড়া নাড়তে পারবে না। আইনটি পাশ হলে সীমা অতিক্রম করা পুলিশের বিরুদ্ধে সহজেই মামলা করা যাবে। আইনে পুলিশের জন্য অতিরিক্ত প্রশিক্ষণ ও জনসমাজের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধির নানা পদক্ষেপের কথা বলা আছে।

ঘোষিত রায়ে চৌভিনের ৪০ বছর কারাদণ্ড হতে পারে। আইন অনুযায়ী, ‘সেকেন্ড ডিগ্রি’ অনিচ্ছাকৃত খুনের জন্য সর্বোচ্চ ৪০ বছর কারাদণ্ডের বিধান আছে। ‘থার্ড ডিগ্রি’ খুনের জন্য সর্বোচ্চ কারাদণ্ডের বিধান ২৫ বছর। আর ‘সেকেন্ড ডিগ্রি’ নরহত্যার জন্য ১০ বছরের কারাদণ্ড বা ২০ হাজার ডলার জরিমানার বিধান রয়েছে।

যেহেতু জর্জ ফ্লয়েড হত্যা যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা। এ মামলায় রাজ্যের প্রসিকিউটর সর্বোচ্চ কারাদণ্ড ৪০ বছরের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবেন। এবিসি নিউজের আইন বিশ্লেষক ড্যান আব্রাহাম বলেন, এই মামলায় চৌভিনের দণ্ড কেমন হবে, তা নিয়ে পরে বড় বিতর্ক হবে। তিনি মনে করেন, সরকার পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ দণ্ডের চেষ্টা করা হবে।

২০ এপ্রিল জর্জ ফ্লয়েডের ভাই ফিলোনাইস ফ্লয়েড বলেন, আজ আমরা আবার নিশ্বাস নিতে পারছি। আমাদের সব সময় বুঝতে হবে, লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। জীবনের জন্যই এটা আমাদের চালিয়ে যেতে হবে। এ চক্রের বিরুদ্ধে আমাদের বিক্ষোভ চালিয়ে যেতে হবে। শুধু ফ্লয়েডের জন্য আমি লড়ছি না। বিশ্বের সবার জন্য আমি লড়ে যাচ্ছি।

২০২০ সালের মে মাসে জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর পর শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই আন্দোলন হয়নি। নাগরিক আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল সারা বিশ্বে। এসব সমাবেশ থেকে লন্ডন, প্যারিস, ফ্রাঙ্কফুর্টসহ পশ্চিমের বড় বড় নগরে বৈষম্য, পুলিশি সহিংসতা ও বর্বর বিদ্বেষের বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিবাদের সঙ্গে ফ্লয়েড হত্যার বিচার দাবি করা হয়।

মামলার রায়ের পর নাগরিক আন্দোলনের নেতারা বলছেন, বিদ্বেষ–বৈষম্যের অবসানে নতুন যাত্রা শুরু হয়েছে। এ নিয়ে আইন প্রণয়নের সঙ্গে সামাজিক, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির অবসান করাই সভ্য বিশ্বের এখনকার মূল কাজ বলে নাগরিক নেতারা মনে করেন।

মার্কিন সিনেটে আইন প্রস্তাব নিয়ে সহসাই আলোচনা শুরু হবে। নেপথ্যে আইন প্রণেতাদের সমঝোতা আলোচনা শুরু হয়েছে বলে সংবাদমাধ্যম দা হিল তাদের এক প্রতিবেদনে বলেছে। যদিও মার্কিন সিনেটের ৫০-৫০ ভিত্তিতে ডেমোক্র্যাট ৫০ জনই এই আইন পাসের ব্যাপারে একমত কি না, এ নিয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। রিপাবলিকানদের পক্ষ থেকে আগে থেকেই বলা হয়েছে, পুলিশ সংস্কারে রাজ্য পর্যায়ে উদ্যোগ নেওয়াকে তারা সমর্থন করেন। কেন্দ্রীয়ভাবে সংস্কার আইন প্রণয়নকে এড়িয়ে যেতে রিপাবলিকানদের এই অসার অজুহাত বলে নাগরিক সংগঠনগুলো সমালোচনা করছে।

প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর পর থেকে এ নিয়ে সক্রিয়। তাঁদের নির্বাচনী প্রচারের সময় ফ্লয়েডের হত্যাকাণ্ড অবধারিতভাবে বক্তৃতার অংশ হয়ে উঠেছিল। ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস নিজেকে কৃষ্ণাঙ্গ পরিচয় দিয়েই রাজনীতি করেন। নাগরিক আন্দোলনের বিক্ষোভ সমাবেশে তিনিও বক্তৃতা করেছেন।

বাইডেন প্রশাসনের অন্যান্য অগ্রাধিকারের মধ্যে এখন পুলিশ সংস্কার আইনে পাস করাও অন্যতম কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ডেরেক চৌভিনের দণ্ডের পর নড়েচড়ে বসা মার্কিন জনসমাজের মনোভাবও ব্যাপকভাবে এখন পুলিশ সংস্কারের পক্ষে। রক্ষণশীলদের বিরোধিতা মোকাবিলা করে বাইডেন প্রশাসন কতটা সফলভাবে এ কাজটি করতে পারেন, তা দেখার অপেক্ষায় মার্কিন উদারনৈতিক সমাজ।