শপথের পর কমলার সামনে কী

ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের সামনে চ্যালেঞ্জ অনেক।ছবি: রয়টার্স

যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে স্থানীয় সময় আজ বুধবার শপথ নেবেন কমলা হ্যারিস। শুধু প্রথম নারী ভাইস প্রেসিডেন্টই নন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ ও দক্ষিণ এশীয় আমেরিকান ভাইস প্রেসিডেন্ট।

প্রথম নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে কমলা হ্যারিসের সামনে চ্যালেঞ্জটাও বেশি। কমলা অবশ্য সাহসের সঙ্গেই এই চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন। তাই প্রায়ই বলে থাকেন, নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনিই প্রথম, কিন্তু শেষ নন।

ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে কমলা হ্যারিসের সামনে যেসব চ্যালেঞ্জ রয়েছে, বিবিসির এক প্রতিবেদনে তা তুলে ধরা হয়েছে।

ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব কী

ইতিহাস বলে, যুক্তরাষ্ট্রে ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব খুব বেশি নয়। ফেডারেল সরকারের সংবিধানে ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্বের বিষয়টি অবহেলিত।
ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্বের বিষয়টি মজা করে ব্যাখ্যা করেছেন ভার্জিনিয়া মিলার সেন্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেনশিয়াল স্টাডিজের পরিচালক বারবারা পেরি। তিনি বলেন, ‘ভাইস প্রেসিডেন্টের ভূমিকা প্রেসিডেন্টের হৃৎস্পন্দনের সঙ্গে সম্পর্কিত। প্রেসিডেন্টের মৃত্যু বা প্রেসিডেন্ট গুরুতর অসুস্থ না হওয়া পর্যন্ত ভাইস প্রেসিডেন্টের কাজ হলো অপেক্ষা করা। অনেক ভাইস প্রেসিডেন্টকে বিশেষ কোনো কাজ ছাড়াই এই পদে থাকতে হয়।’ পেরি বলেন, বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে একজন ভাইস প্রেসিডেন্ট বলেছিলেন, ‘প্রতিদিন আমি হোয়াইট হাউসের ডোরবেল বাজাই। আশা করি প্রেসিডেন্ট উত্তর দেবেন।’

ভাইস প্রেসিডেন্টের এমন ভূমিকা হালকাভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই। যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫ জন প্রেসিডেন্টের মধ্যে আটজন মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই মারা গেছেন। একজন মেয়াদের আগেই দায়িত্ব ছেড়েছেন। প্রেসিডেন্টদের এক–পঞ্চমাংশ ভাইস প্রেসিডেন্টদের হঠাৎ পদোন্নতি দিয়েছেন।

তবে ব্যতিক্রমও রয়েছে। ১৯৭০–এর দশকে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের ভাইস প্রেসিডেন্টকে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে হয়। পেরি বলেন, কার্টার ছিলেন জর্জিয়ার সাবেক গভর্নর। রাজনীতির সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পর্ক ছিল না। কার্টার জানতেন তিনি ওয়াশিংটনের ব্যাপারে কিছু জানেন না। যখন মনোনয়ন পেলেন তখন কার্টার যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের সিনেটর ওয়াল্টার মনডালেকে সঙ্গে নেন। তাঁকেই তিনি সরকার পরিচালনায় যোগ্য সঙ্গী মনে করেছিলেন।

যেভাবে ভাইস প্রেসিডেন্ট হলেন কমলা হ্যারিস

জো বাইডেন ও কমলা হ্যারিসের মধ্যকার সম্পর্ক ভারসাম্যপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা মার্কিন সিনেটের প্রবীণ সদস্য জো বাইডেনকে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প বেছে নিয়েছিলেন মাইক পেন্সকে। ট্রাম্পের রক্ষণশীল মনোভাবকে পোক্ত করতে কাজে লেগেছিল পেন্সের ধার্মিক ভাবমূর্তি। একইভাবে জো বাইডেনের বর্ণবৈষম্যবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরতে ভূমিকা রেখেছেন কমলা হ্যারিস।

কমলা হ্যারিস।
রয়টার্স ফাইল ছবি।

সিনেটে প্রেসিডেন্ট হিসেবে জো বাইডেনের চূড়ান্ত হওয়ার বিষয়টিও অনেকটা নির্ভর করবে কমলা হ্যারিসের ওপর। সিনেটে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকানদের ভোট সমান সমান হলে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসবে কমলা হ্যারিসের ভোট থেকে।

কোথায় থাকবেন কমলা হ্যারিস ও তাঁর পরিবার

ওয়াশিংটনের উত্তর-পশ্চিমে যুক্তরাষ্ট্রের নাভাল অবজারভেটরির আলাদা একটি সাদা রঙের বাড়িতে থাকবেন কমলা হ্যারিস ও তাঁর স্বামী ডগ এমহফ। বাড়িটি হোয়াইট হাউসে কমলা হ্যারিসের কার্যালয়ের কাছে। জর্জটাউন ইউনিভার্সিটি ল স্কুলে কমলার স্বামী এমহফ শিক্ষকতা করবেন। সেটিও বাড়ি থেকে বেশি দূরে নয়।

ভাইস প্রেসিডেন্টের ভূমিকা প্রেসিডেন্টের হৃৎস্পন্দনের সঙ্গে সম্পর্কিত। প্রেসিডেন্টের মৃত্যু বা প্রেসিডেন্ট গুরুতর অসুস্থ না হওয়া পর্যন্ত ভাইস প্রেসিডেন্টের কাজ হলো অপেক্ষা করা। অনেক ভাইস প্রেসিডেন্টকে বিশেষ কোনো কাজ ছাড়াই এই পদে থাকতে হয়।
বারবারা পেরি, ভার্জিনিয়া মিলার সেন্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেনশিয়াল স্টাডিজের পরিচালক

এয়ার ফোর্স টু বোয়িং ৭৫৭ তে চলাচল করার সুযোগ রয়েছে কমলা হ্যারিস ও এমহফের। তাঁদের ২৪ ঘণ্টা নিরাপত্তাও দেওয়া হবে।

বাইডেনের সঙ্গে কীভাবে কাজ করবেন কমলা হ্যারিস

ভার্জিনিয়া মিলার সেন্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেনশিয়াল স্টাডিজের পরিচালক বারবারা পেরি বলেন, হোয়াইট হাউসে কাজের সময় তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। এটা ছিল প্রথার বাইরে।

পেরি বলেন, বাইডেন ও হ্যারিস একসঙ্গে সহজভাবে কাজ করবেন বলে তিনি আশা করেন।

জো বাইডেন অবশ্য কাজের ক্ষেত্রে কমলা হ্যারিসকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলেছেন। বাইডেন বলেন, প্রশাসনে যাঁদের বাছাই করেছেন, তাঁদের প্রত্যেকের ব্যাপারে তিনি প্রথমে কমলা হ্যারিসের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। এরপর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কমলা হ্যারিস বাইডেনের মনোনীত মন্ত্রিসভার প্রত্যেক সদস্যদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন।

জো বাইডেন ও কমলা হ্যারিসের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। কমলা হ্যারিসের সঙ্গে বাইডেনের ছেলে বিউ বাইডেনের সম্পর্ক ভালো ছিল। ২০১৫ সালে বিউ বাইডেন মস্তিষ্কের ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।

কমলা হ্যারিসের প্রভাব কতটা থাকবে

পেরি বলেন, মনোনয়নের লড়াইয়ে বাইডেনের পক্ষে কমলা হ্যারিসের বুদ্ধিদীপ্ত বিতর্ক অনেকেই মনে রেখেছে। এটি বিস্মিত করেছিল অনেককে।

ধারণা করা হয়, নিজে ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকাকালে যেমন ভূমিকা রেখেছিলেন, কমলা হ্যারিসকেও দায়িত্ব পালনের তেমন সুযোগ দেবেন বাইডেন। গত বছর ডেমোক্রেটিক ন্যাশনাল কনভেনশনে রানিং মেট হিসেবে কমলাকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সময় ২০০৮ সালের স্মৃতিচারণা করেন বাইডেন। সে সময় বারাক ওবামাও তাঁকে রানিং মেট নির্বাচিত করেন।

সে সময় ওবামা বাইডেনের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, তিনি কীভাবে দায়িত্ব পালন করতে চান। উত্তরে বাইডেন বলেছিলেন, গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় তিনিই শেষ ব্যক্তি হতে চান, যাঁর সঙ্গে প্রেসিডেন্ট কথা বলবেন। বাইডেন বলেন, কমলাকেও তিনি একই কথা বলেছেন। তিনি কমলাকে সব সময় সত্য বলতে আহ্বান জানিয়েছেন। যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে কমলা যেন শেষ কথাটি বাইডেনকে বলেন।

ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস বিশেষ যা করতে পারেন

জো বাইডেনের দলে রাজনৈতিক তারকা হলেন কমলা হ্যারিস। দলের বামপন্থীদের সমালোচনা সত্ত্বেও মার্কিন সিনেটে সমকামীদের অধিকার, অভিবাসন, মারিজুয়ানা বৈধ করা, বন্দুক নিয়ন্ত্রণের মতো ইস্যুগুলোতে উদার ভোটের রেকর্ড রয়েছে কমলা হ্যারিসের। সিনেটে আসার আগে তিনি ক্যালিফোর্নিয়ার শীর্ষ আইনজীবী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

জো বাইডেন ও কমলা হ্যারিস।
রয়টার্স ফাইল ছবি।

কমলা হ্যারিসের আইনি অভিজ্ঞতা যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশ বাহিনীর সংস্কারে ভূমিকা রাখবে। মার্কিন পুলিশের অসদাচরণের পরিপ্রেক্ষিতে এই বাহিনী সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন বাইডেন। কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েড হত্যার জেরে যুক্তরাষ্ট্রে ব্ল্যাক লাইভস মেটারস প্রোটেস্টের সক্রিয় সমর্থক ছিলেন কমলা হ্যারিস। তিনি পুলিশ বাহিনীর সংস্কারের আহ্বান জানান।

বর্ণবৈষম্যবিষয়ক বিচার সংস্থা কালার অব চেঞ্জের জ্যেষ্ঠ পরিচালক জেনিফার এডওয়ার্ড বলেন, কমলা হ্যারিসের শপথ নেওয়ার মুহূর্তটি কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানদের জন্য ঐতিহাসিক। এই মুহূর্তে পৌঁছাতে হাজারো কৃষ্ণাঙ্গ নারী লড়াই চালিয়েছেন। সংগঠিত হয়েছেন। ভোট দিয়েছেন। যাঁরা লড়াই করেছেন, তাঁদের দাবি তুলে ধরা এখন ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের দায়িত্ব।

এডওয়ার্ড বলেন, কমলা হ্যারিসকে কোভিড ১৯ এর প্রাদুর্ভাবে অর্থনৈতিক তহবিল, বিচারপ্রক্রিয়া, ভোট এবং নির্বাচনী সংস্কার নিয়ে কাজ করতে হবে। তবে এসব কাজ করতে গিয়ে বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর সমালোচনার মুখে পড়তে পারেন কমলা হ্যারিস।

কমলা হ্যারিসকে যা সামলাতে হবে

ভাইস প্রেসিডেন্টের কাছে মার্কিন জনগণের প্রত্যাশা বেশি থাকে। যেকোনো সংকটময় পরিস্থিতিতে মার্কিনরা ভাইস প্রেসিডেন্টকে কমান্ডার ইন চিফ হিসেবে দেখতে চান। তবে ভাইস প্রেসিডেন্টের যোগ্যতা প্রমাণের মতো এমন পরিস্থিতি না–ও আসতে পারে। এ ছাড়া একজন ভাইস প্রেসিডেন্টকে প্রেসিডেন্টের খারাপ দিকগুলো এড়িয়ে চলার মতো উপস্থিত বুদ্ধি থাকতে হয়।

এ প্রসঙ্গে ব্যাপকভাবে সমালোচিত কয়েকজন ভাইস প্রেসিডেন্টের উদাহরণ দেন পেরি। পেরি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের ভাইস প্রেসিডেন্ট ড্যান কোয়ায়েল দক্ষ ভূমিকা রাখতে পারেননি। ড্যান কোয়ায়েল প্রাথমিক স্কুল পরিদর্শনে গিয়ে বেশি সমালোচিত হন। সেখানে তিনি এক শিক্ষার্থীকে বোর্ডে পটেটো (আলু) লিখতে বলেন। ওই শিক্ষার্থী ঠিক বানানেই শব্দটি লেখে। কিন্তু ভাইস প্রেসিডেন্ট কোয়ায়েল সেখানে বাড়তি ‘ই’ যোগ করতে বলেন।

১৮২৮ সালের নির্বাচনের পরে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড্রু জ্যাকসন ভাইস প্রেসিডেন্ট জন কালহুনকে অপছন্দ করা শুরু করেন। ওয়াশিংটনের সামাজিক বিভিন্ন নীতিতে দুজনের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। তাঁদের বিরোধ এত বেড়ে যায় যে কালহুন পদত্যাগ করেন। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে তিনিই প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট যিনি এভাবে পদত্যাগ করেছিলেন।

তবে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সম্ভবত সবচেয়ে খারাপ ভাইস প্রেসিডেন্ট অরোন বুর। কার্যালয়ে তিনি প্রতিপক্ষ যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা আলেকজান্ডার হ্যামিলটনকে গুলি করে হত্যা করেন। এরপরও আইনের আশ্রয় নিয়ে বুর তাঁর মেয়াদ শেষ করেন।