শিলার স্বপ্ন

শিলার বাবা আগে থেকেই আমেরিকায় ছিলেন। সিটিজেনশিপ পাওয়ার পর শিলাদের জন্য অ্যাপ্লাই করেছিলেন। তাদের কেস প্রসেসিংয়ের পর মা, ভাইবোন—সবাই একসঙ্গে অভিবাসী ভিসা নিয়ে চলে এল বাবার কাছে আমেরিকায়। শিলা তখন ক্লাস এইটে পড়ে। তারা বাংলাদেশ চট্টগ্রামের হালিশহর এ থাকত।

আমেরিকার নিউজার্সিতে শিলার বাবার দোতলা বাড়ি ছিল। ওপরতলা ভাড়া দেওয়া ছিল। তারই নিচতলায় ওরা এসে উঠেছে। নতুন দেশ, নতুন ভাষা, নতুন সংস্কৃতি—সবকিছুই নতুন মনে হচ্ছিল। তবে বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি আলাদা যা ছিল, তা হচ্ছে শীতের সময়। কারণ, বরফ শিলা তার জীবনে এর আগে কখনো দেখেনি। শিলাদের অনেক আত্মীয় আগে থেকেই আমেরিকায় থাকত। সে জন্য আমেরিকায় এসেও একাকিত্ব অনুভব করার সময় পায়নি। নিউইয়র্ক ও নিউজার্সিতে তাদের অনেক আত্মীয়স্বজন থাকায় অনেক বেড়ানো হতো তার। আত্মীয়স্বজনও সবাই আসত ওদের বাসায় বেড়াতে। আনন্দেই কাটছিল তাদের দিনকাল। এরই মধ্যে শুরু হয়ে যায় তাদের পড়াশোনা। শিলার বোন ক্লাস ফোরে পড়ত, আর ভাই ক্লাস টুতে। শুরু হয় আমেরিকায় তাদের নতুন জীবন।

এভাবে দিন যায়, মাস যায়, পার হয় বছরও। শিলা হাইস্কুল গ্র্যাজুয়েশন করে একটি কলেজে ভর্তির চিন্তা করছিল তখন। ঠিক সেই সময় সমাজের কিছু কুচক্রী লোক শিলার বাবার কান ভারী করে, ‘এ দেশে কলেজে গেলে ছেলেমেয়েরা খারাপ হয়ে যায়। তাই এত ঝামেলায় না গিয়ে দেখেশুনে মেয়ের একটা ভালো বিয়ে দিলেই ভালো হবে।’ যদিও শিলার বাবা শিক্ষিত ছিলেন, কাজ করতেন একটি অফিসে, তারপরও তিনি ধার্মিক হওয়ায় খবরের কাগজে প্রকাশিত বিভিন্ন কেলেঙ্কারির ঘটনা দেখে ভয় পেয়ে যান। চিন্তায় পড়ে যান। ভাবেন, ছেলেমেয়েদের ছোট একটা ভুলের জন্য যুগ যুগ ধরে বাবা-মার কষ্টে অর্জিত সম্মান এক মুহূর্তের মধ্যে ধূলিসাৎ হয়ে যায়। ছেলেমেয়েরা খারাপ কিছুর সঙ্গে জড়িত হলে কিছু বলা যায় না। আমেরিকায় ছেলেমেয়ের গায়ে হাত তোলা যায় না, করা যায় না বাংলাদেশের মতো শাসন। এসব ভয় তাঁর মধ্যে কাজ করছিল। এমন হাজারো চিন্তা করতে করতে এদিকে পার হয়ে যায় শিলার কলেজে ভর্তির সময়। এরই মধ্যে ভেতরে-ভেতরে শিলার জন্য পাত্র দেখা শুরু হয়ে গেছে বাংলাদেশ ও আমেরিকাতে।

শিলাদের আত্মীয়স্বজনের ছেলেমেয়েরা সেই মুহূর্তে কিন্তু কলেজে পড়াশোনা করছিল। কিন্তু কার কথা কে শোনে। এভাবে একটা বছর শিলার নষ্ট হয়ে যায়। এদিকে শিলা একটা পার্টটাইম জব করতে চাইল। তার জন্যও অনুমতি মেলেনি। শেষে শত বাধা পেরিয়ে শিলা জোগাড় করে নেয় কলেজে ভর্তির অনুমতি। বাসার কাছেই এক কমিউনিটি কলেজে দু বছরের একটা অ্যাসোসিয়েট ডিগ্রির জন্য ভর্তি হয় সে।

দু বছরের সেই ডিগ্রি শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে শিলাকে নিয়ে যাওয়া হয় বাংলাদেশে বিয়ের উদ্দেশে। সেই সময়ে শিলার অনেক কাজিন ব্যাচেলর ডিগ্রি নিয়ে ভালো চাকরি করছিল। তাদের অনেকেই তত দিনে বাড়ি-গাড়ি করে প্রতিষ্ঠিত। আমেরিকায় চাইলেই ছেলেমেয়েরা দ্রুত প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। শুধু দরকার পরিবারের সমর্থন। শিলার বন্ধুদের অনেকেও নিজের মতো করে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। একই রকম স্বপ্ন ছিল শিলারও। ভেবেছিল, কলেজ গ্র্যাজুয়েশন করে একটা ভালো চাকরি করে নিজের পায়ে দাঁড়াবে, পরে নিজের মতো একটি সুন্দর সংসার করবে। শিলার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেল।

অ্যাসোসিয়েট ডিগ্রি নেওয়ার পরপরই শিলাকে বাংলাদেশ নিয়ে যাওয়া হলো। তারপরে খুব ভালো বংশ, শিক্ষিত ও সুদর্শন দেখে সায়েম নামের এক ছেলের সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেল শিলার। বিয়ের পর শিলা তিন মাস বাংলাদেশে ছিল। বাংলাদেশ থেকে আমেরিকায় ফেরার পর শিলা বুঝল যে, সে কনসিভ করেছে। এদিকে আমেরিকা আসার পর শিলা সায়েমের জন্য অ্যাপ্লাই করেছিল। বেশির ভাগ সময় স্পাউসের জন্য আবেদন করলে ছয় থেকে নয় মাস সময় লাগে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ওদের ক্ষেত্রে প্রসেস হতে একটু বেশি সময় লাগল। আবেদনের প্রায় এক বছর পর সায়েম আমেরিকায় আসতে পারে। ওই সময়টা শিলাকে তার প্রেগনেন্সি নিয়ে একাই চলতে হয়েছে। বাবা-মা, ভাইবোন সহায়তা করেছে অবশ্য। কিন্তু সায়েম পাশে থাকতে পারেনি। সায়েম আমেরিকা আসতে আসতে তাদের ছেলে অয়নের বয়স দু মাস হয়ে গিয়েছিল।

বিয়ের পর শিলা ও সায়েমের একটা সুন্দর সম্পর্ক তৈরি হয়। সেখানে ছিল অনেক স্বপ্ন ও ভালোবাসা। বিয়ের পর প্রথম বছরটা যেকোনো দাম্পত্য জীবনের জন্য অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তাদের সেই সময়টা কেটেছে স্কাইপেতে কথা বলে। প্রেগন্যান্ট অবস্থায় শিলার শরীর খুব বেশি খারাপ থাকত। অসুস্থতার কারণে অনেক সময় সায়েমের সঙ্গে ঠিকমতো কথা বলতে পারত না। ওদের জন্য সেই সময়টা ছিল বেশ জটিল। সায়েম আমেরিকা আসার পর কিছুদিন পড়াশোনা করল এবং তারপর চাকরি শুরু করল। বেশ কয়েক বছর চাকরি করার পর ও একটা ভালো পজিশনে চলে গেল। তারপর আমেরিকার সিটিজেনশিপ পেয়ে বাংলাদেশ থেকে সায়েম তার বাবা-মাকে আমেরিকায় আনার আবেদন করল। কিছুদিনের মধ্যে সায়েমের বাবা-মা চলে এল আমেরিকাতে। শিলার বাবার বাড়ির ওপরতলায় তারা উঠল। এদিকে শিলা কিছুদিন আবার পড়াশোনা করে একটা ভালো জবের জন্য বিভিন্ন জায়গায় আবেদন করতে শুরু করল। আর ঠিক সেই মুহূর্তে সে জানতে পারল যে, সে আবারও কনসিভ করেছে।

শিলার অনেক স্বপ্ন ছিল আমেরিকাতে এসে পড়াশোনা করে একটা ভালো চাকরি করবে। কিন্তু সমাজের নানা টানাপোড়েন ও দায়িত্ব পালন করতে করতে শিলার স্বপ্নগুলো স্বপ্নই থেকে গেল, বাস্তব আর হলো না।