শেষ চিঠি

রাজিবের বর্তমান অবস্থান কোনো এক জায়গার নির্জন রুমে। রুমটা পুরোপুরি অন্ধকার নয়, কিন্তু নির্জন নিস্তব্ধ। সে যে রুমে আছে, সেটা অনেকটা থানার কয়েদখানার মতো। শিকলের বাইরে একজন মোটাসোটা লোক মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। আর রাজিব অপেক্ষা করছে কবে তার ‘নম্বর’ আসবে। এই তো অল্প কিছু সময় আগেও রাজিবের সামনে বসা ছিল এই শহরের সবচেয়ে প্রভাবশালী এক ব্যক্তি। এত ক্ষমতাধর একজন মানুষের চোখেমুখে মৃত্যুর ভয় দেখে রাজিব নির্বাক। শেষ মুহূর্তে তার বেঁচে থাকার আকুতি দেখে বড় মায়া হয়েছে।
একে একে জলজ্যান্ত সুঠাম দেহের দুজনকে চোখের সামনে নিয়ে গেছে। রাত বাড়ছে, ভোর হওয়ার আগেই কাজ শেষ করতে হবে। রাজিবের সিরিয়াল আসার আগেই বড় সাহেবের মোবাইলে কল এল। ঘণ্টাখানেকের ভেতরে আসছি বলে বড় সাহেব চলে গেলেন। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা অফিসারকে উদ্দেশ্য করে রাজিব ডাকল, ‘স্যার একটু কি শুনবেন?’
অফিসার রাজিবের সামনে এসে বললেন, ‘তুমি কী কিছু চাও?’
রাজিব বলল, ‘আমাকে একটা কলম আর খাতা দেবেন?’
বড় ভালো অফিসার। কলম আর খাতা দিয়ে বললেন, ‘কিছু লিখতে চাও? বড় সাহেব আসতে এক-দেড় ঘণ্টা লাগতে পারে। তার আগেই শেষ করবে।’
রাজিব এর জবাব না দিয়েই লেখা শুরু করল—

প্রিয় বাবা,
এই প্রথম ও শেষ তোমাকে চিঠি লিখছি।
বাবা তোমার মনে আছে আমার ছেলেবেলার কথা? একবার আমি ছেলেবেলায় খেলতে গিয়ে বাড়ির টিনের সঙ্গে মাথায় আঘাত পাই। তুমি দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকলে। কোলে করে নিয়ে গেলে বাড়ির পাশে কাশেম ডাক্তারের কাছে; তারপর হাসপাতালে। সেই আঘাতের সেলাইয়ের দাগ এখনো আমার কপালে আছে। অভাবের সংসার আমাদের ছিল।
আমাদের খাবার দিতে তুমি কত-না কষ্ট করেছ। একদিন বাসায় খাবার কিছুই ছিল না। সকালে তুমি ঘুম থেকে উঠে বললে, ‘আমি বাজার নিয়ে আসছি।’ আমরা সবাই তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। নদীর চরে আমরা ভাইবোন মিলে খেলা করছি। তোমার ফিরতে বিকেল হয়ে গেছে। সকাল থেকে আমরা ভাইবোনেরা কিছু খাইনি। হঠাৎ চেয়ে দেখি তুমি দূর থেকে হাত তুলে আমাদের ডাকছ এবং এক শ টাকার নোট দেখিয়ে হাসছ শুধু। আমরা যতই অভাবে থাকি না কেন, তুমি যেকোনোভাবে রাতে টাকা জোগাড় করে আমাদের মুখে খাবার তুলে দিতে। হাজার কষ্ট হলেও তুমি আমাদের মুখে হাসি ফোটাতে। আমাদের মুখে সামান্য খাবার তুলে দিতে তুমি কী না করেছ? আমি তো বড় ছেলে। আমাকে কিছু একটা করতে হবে। প্রতিনিয়ত আমি শুধু বোনদের কথাই চিন্তা করতাম। বাবা, আমার চলে যাওয়াতে সবচেয়ে অসহায় হবে তুমি। আমি পারি নাই। আমি তোমার স্বপ্ন পূরণে ব্যর্থ হয়েছি। আমি তোমাকে বড় বিপদে ফেলে গেলাম। তোমার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি বাবা। আমাকে ক্ষমা করে দিয়ো।

প্রাণপ্রিয় মা,
তোমার কথা এই সংক্ষিপ্ত সময়ে আমি লিখে শেষ করতে পারব না। তোমার মতো ভালো মা সবাই কি পায়? তুমি ভালো মা নও শুধু, ভালো মানুষও বটে। বাবার অভাবের সংসারে একবারের জন্য হলেও মুখ কালো করোনি। মা, তোমার মনে পড়ে—তখন আমি ক্লাস সেভেনে পড়ি। তুমি আর বাবা আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করলে। ডাক্তার আমাকে দেখে বলল, এই ছেলেকে বাঁচানো যাবে না। আমি অসুস্থ হলেও নিজ চোখে দেখলাম, তুমি ডাক্তারের পায়ে পড়ে গেলে। কান্নাকাটি করে পুরো হাসপাতালের সবাইকে এক করে ফেললে। সেই দৃশ্য আমার চোখে এখনো জ্বলজ্বলে।
প্রিয় মা, আমার জীবনে শুধু একটাই চাওয়া ছিল, তোমাদেরর মুখে হাসি ফোটানো। দুটি কাপড় দিয়ে সারা বছর কেটে যায় তোমার। আমার বোনগুলো বড় হলেও তুমি তাদের পড়ালেখা বাদ দিয়ে বাসার কাজে কখনো কোনো দিন লাগতে দাওনি। মা, তুমি আমার ভালোবাসা। মা, তোমাকে অনেক ভালোবাসি। আমি কিছুই করতে পারিনি। কিছুই দিতে পারিনি।

প্রাণের বোন
রাজিয়া, রাবেয়া ও রুবিনা
এই পৃথিবীতে যাদের নিয়ে আমি সবচেয়ে বেশি ভাবি, সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি, সেটা হচ্ছ তোমরা। রাজিয়া তুই পরিবারের বোনদের মধ্যে বড়। কোনো দিন বুঝতেই দিসনি যে তুই আমার ছোট। একেবারে বড় বোনের মতো আমাকে সব সময় শাসন করতি। মায়ের মতো একটু দেরি হলেই ফোন দেওয়া শুরু হয় তোর। আমি খুব ভালোভাবে জানি, তুই আজও আমাকে বারবার কল দিয়েছিস। মা-বাবার সঙ্গে নিশ্চয় তুইও এখন রাত জেগে আমার জন্য অপেক্ষা করছিস। তোর বিয়ের জন্য একটা পাত্র দেখেছিলাম। ছেলেটা অনেক ভালো। একটা বেসরকারি অফিসে কাজ করে। স্বপ্ন ছিল আমার লক্ষ্মী বোনের বিয়ে দেখে যাব। কিন্তু হলো না। আমার খাটের নিচে একটা মাটির ব্যাংক আছে। সেই ব্যাংকে তোর বিয়ের জন্য কিছু টাকা সঞ্চয় করেছি। কত টাকা হয়েছে আমি জানি না। তুই দেখিস। আমার অবর্তমানে তুই হলি এই ঘরের সব। বাবাকে বলিস আকমল চাচার চায়ের দোকানে আমার অল্প কিছু বাকি আছে। এ ছাড়া আর কারও কাছে আমি কোনো ধার করিনি। রাবেয়া ও রুবিনার দিকে খেয়াল রাখিস। রুবিনাকে বকা দিস না। সে ছোট বোন আমাদের। বড় ভাই হিসেবে তোর জন্য কিছু রেখে যেতে পারলাম না। আমাকে ক্ষমা করিস।
রাবেয়া, আমাদের ঘরে সবচেয়ে মেধাবী ছাত্রী তুই। তোকে নিয়ে আমাদের সবার স্বপ্ন। তুই একদিন অনেক বড় হবি। একদিন ডাক্তার হয়ে মানুষের সেবা করবি। বাবা তোকেই সবচেয়ে বেশি আদর করেন। বাবা সব সময় আমাকে বলতেন, ‘একদিন রাবেয়াই আমাদের পরিবারকে সচ্ছল করবে। রাবেয়া আমাদের মাথা সমাজে উঁচু করবে।’ মা বলতেন, ‘আর করবে? মেয়ে বড় হলেই বিয়ে করে শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে।’ আর তুই বলতি, ‘আমি বিয়ে করব না। আমি বাবাকে ছেড়ে যাব না। আমি তোমাদের ছেড়ে কোথাও যাব না।’ শুনে খুব ভালো লাগতরে রাবেয়া। আমার আদরের বোন আমার স্বপ্ন, আমাদের স্বপ্ন তুই পূর্ণ করিস।
ছোট্ট মণি রুবিনা, আমাদের ঘরের নক্ষত্র তুমি। রুবিনা বোন আমার, তুমি ভাইয়া বলে ডাকলে আমার প্রাণটা ভরে যায়। ওপারে আমি তোমার এ ডাক শুনব না। এই মুহূর্তে তোমার আদর মাখা ‘ভাইয়া’ ডাক শুনতে খুব মন চাইছে। আর কয়েকটা দিন পর তোমার জন্মদিন। মনে আছে, গত বছর এক বান্ধবীর জন্মদিনের অনুষ্ঠান থেকে এসে তুমি বলেছিলে, ‘আমাদের জন্মদিনের উৎসব কেন হয় না।’ ভেবেছিলাম এই বছর তোমাকে জন্মদিনে সারপ্রাইজ উপহার দেব। তোমার সব বন্ধুকে দাওয়াত করব। সে জন্য আমি আমার টিউশনির টাকা থেকে একটু একটু করে জমিয়েছি। আমার যে ডিকশনারি আছে লাল মলাটে সেই ডিকশনারির ভেতর দু হাজার টাকা আছে, তোমার জন্মদিনের জন্য। আমি চাই তুমিও রাবেয়ার মতো হও।
ছোট মামা
জীবনে যতবার বিপদে পড়েছি, আপনি ফেরেশতার মতো আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। আমি যখন এসএসসি পরীক্ষা দিই, তখন বাবার কাছে একটা টাকাও ছিল না যে, আমার রেজিস্ট্রেশনের টাকা দেবেন। আমাদের বাসায় হঠাৎ এলেন আপনি। মা যখন আপনাকে ঘটনা বললেন, আপনি সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে টাকা বের করে দিলেন। বড় মামা মারা যাওয়ার পর আপনি বড় মামার পরিবারের পাশাপাশি আমাদের পরিবারকে সাহায্য করতেন। ইচ্ছা ছিল চাকরি পেলে আপনাকে হজে পাঠাব। একদিন আপনি বলেছিলেন, আপনি হজ করতে চান। তখনই এমনটা ভেবে রেখেছিলাম।
বন্ধু আনিস ও আলম,
বন্ধু তোদের কথা কী বলব? সেই স্কুলজীবন থেকে আমরা তিনজন একসঙ্গে। নিজ মেধা ও পরিশ্রমে আজ তোমরা অনেক ভালো অবস্থানে। কিন্তু আমি পড়ে রইলাম পেছনে। বন্ধু আনিস, অনেক দিন আগে খেলার সময় তোর সঙ্গে রাগারাগি হয়েছিল। আমি মনে হয়, একটু বেশি করে ফেলেছিলাম। বন্ধু, আমি সত্যি দুঃখিত।
বন্ধু আলম, তুই আমাদের সোনালী ব্যাংক। তোর কাছে আমি বহুভাবে ঋণী। এই অল্প সময়ে তোমাদের কথা লিখে শেষ করা যাবে না। তোমাদের সাহায্যের কথা আমি লিখে শেষ করতে পারব না। আমাকে ক্ষমা করে দিয়ো বন্ধুরা।
সুপ্রিয়া সোমা,
ভালোবাসার নির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞা আমার জানা নেই। কিন্তু এতটুকু বুঝি, নিঃস্বার্থভাবে কারও পাশে থাকার ইচ্ছাই হয়তো ভালোবাসা। আমি এখনো তোমার সেই চিরকুট রেখে দিয়েছি। আমার ডায়েরিতে এই চিরকুট তুমি পাবে। তুমি একমাত্র মানুষ, যে আমাকে বলেছিল চেয়ারম্যান মানুষটা তেমন ভালো না। আসলে তোমাকে ছাড়া আমি কাউকে বলিনি যে, আমি কীভাবে চট্টগ্রামে আসা-যাওয়া করি। তুমি আমার জন্য অনেক কিছু করেছ। তুমি আমার জন্য কী কী করেছ, তা লিখতে গেলে কলমের কালি শেষ হয়ে যাবে। লেখা শেষ হবে না।
চেয়ারম্যান চাচা,
সেই কিশোর বয়স থেকে আপনাকে চেয়ারম্যান হিসেবে দেখে এসেছি। আমাদের ইউনিয়নের তিন-তিনবারের চেয়ারম্যান আপনি। কত শত বিপদে আপনাকে সবাই কাছে পায়। রাত কিংবা দিন—সব সময় আপনি সবার সেবায় নিয়োজিত। চাকরির বাজারে আমি পরাজিত। একটা স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানে চাকরি প্রায় হয়ে যাবে। কিন্তু একজন রাজনৈতিক ব্যক্তির রেফারেন্সের খুব প্রয়োজন। আমার কেউ নেই। আমি এমন কাউকে পাইনি। আমাদের গ্রামের হেলাল চাচার পরামর্শে আপনার কাছে গিয়েছিলাম। চাচা, আমি সামান্য সাহায্য চাইতে গিয়েছিলাম। আপনি আমাকে বিরাট সাহায্য করলেন। আপনার কুকাজের ব্যবসা আমাকে ধরিয়ে দিলেন।
আপনার প্রতি বিশ্বাস ছিল বলে আমি আপনার কথামতো কাউকে বলিনি আমি যে আপনার শুঁটকি ব্যবসার কাজে সাহায্য করি। এমনকি আমার মা-বাবাকেও না। আমি কি জানতাম আপনি শুঁটকির ভেতরে-ভেতরে মাদকের ব্যবসাও করেন?
গত এক মাসে আমাকে ছয়বার চট্টগ্রামে আসা যাওয়া করতে হয়েছে। এবারই প্রথম অফিসার গাড়ি তল্লাশি করল। আমি যখন আপনাকে কল দিলাম, আপনি আমাকে না চেনার ভান করলেন। আমার মতো আপনার একটা ছেলে আছে। চাচা আপনি কি পারবেন আপনার ছেলেকে এভাবে মৃত্যুর মুখে রেখে বাসায় বসে থাকতে?

রাজিবের হাত ব্যথা করছে। আর লিখতে পারছে না। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে তার, ‘আমাকে মারবেন না, আমাকে মারবেন না।’ এই রাষ্ট্রের কাছে, আইন ও বিচার ব্যবস্থার কাছে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হচ্ছে তার।
রাজিব আবার লেখা শুরু করল—
প্রিয় রাষ্ট্র, জন্মভূমি আমার। প্রাণের বাংলাদেশ আমার, যখন কোথাও কোনো চাকরি পাইনি, তখন মনে অনেক প্রশ্ন জেগেছে। হয়তো একদিন করব ভেবেছিলাম। কিন্তু আজ এই বিদায়বেলায় তোমার কাছে একটাই প্রশ্ন করব...
বাইরে গাড়ি আসার শব্দ শোনা গেল। দাঁড়িয়ে থাকা অফিসার দৌড়ে এসে রাজিবের কাছ থেকে খাতা নিয়ে পকেটে ঢুকিয়ে বললেন, ‘ঠিক আছে ঠিক আছে, পৌঁছে দেব।’
বড় সাহেব রুমে প্রবেশ করেই বললেন, ‘এই চল চল। দেরি হয়ে গেছে। এই শালার পকেটে চার রাউন্ড গুলি রেখে দাও।’
কলম হাতে নিয়ে তখনো দাঁড়িয়ে রাজিব। তার চোখের পানিও তখন স্তব্ধ হয়ে গেছে।