ষড়যন্ত্রতত্ত্বের কফিনে আরও একটি পেরেক

এবার অ্যাটর্নি জেনারেলও বললেন, নির্বাচনে বড় ধরনের কোনো কারচুপি হয়নি। ট্রাম্পের আইনজীবীর পাল্টাবিবৃতি।

জো বাইডেন ও ডোনাল্ড ট্রাম্প
ছবি: রয়টার্স

সত্তর ও আশির দশকে ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন উঠতি ব্যবসায়ী, সে সময় তাঁর সব অপকর্মের দোসর ছিলেন ধূর্ত আইনজীবী রয় কোন। রাশিয়ার সঙ্গে ট্রাম্পের আঁতাত নিয়ে তদন্ত শুরু হলে তিনি তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল জেফ সেশন্সকে সব তদন্ত বাতিলের নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেশন্স তাতে রাজি না হলে ক্ষিপ্ত ট্রাম্প বলেছিলেন, ‘আমার রয় কোন কোথায়?’

২০১৮ সালের নভেম্বরে সেশন্সকে পত্রপাঠ বিদায় দিয়ে পরে ট্রাম্প উইলিয়াম বারকে নতুন অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে নিয়োগ দেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল, তিনি রয় কোনের মতোই অনুগত হবেন। তাঁর অনুমান ভ্রান্ত ছিল না। প্রধান নির্বাহী হিসেবে প্রেসিডেন্টের ‘সীমাহীন ক্ষমতা রয়েছে’, উইলিয়াম বার এই তত্ত্বে বিশ্বাস করতেন। অ্যাটর্নি জেনারেল হওয়ার পর তিনি ট্রাম্পের বিরুদ্ধে আসা সব অভিযোগ বাতিল করে বলেছিলেন, ‘যা খুশি করার’ পুরো অধিকার প্রেসিডেন্টের রয়েছে। এ বছরের নভেম্বরের নির্বাচনের আগে ট্রাম্পের সঙ্গে গলা মিলিয়ে তিনি আরও বলেছিলেন, ডাকভোটের মাধ্যমে ব্যাপক কারচুপির আশঙ্কা রয়েছে।

সেই উইলিয়াম বার ট্রাম্পের নতুন ‘রয় কোন’, মঙ্গলবার এপির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, কারচুপির ফলে নির্বাচনের ফলাফল উল্টে যাবে, এমন কোনো প্রমাণ বিচার বিভাগ খুঁজে পায়নি। অনিয়ম হয়ে থাকতে পারে, কিন্তু তার পরিমাণ তেমন ব্যাপক নয়। উইলিয়াম বার জানান, কারচুপির অভিযোগ উঠলে তিনি নিজ দপ্তরের আইনজীবীদের তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিলেন, কিন্তু তাঁরা তেমন কোনো প্রমাণ খুঁজে পাননি। একই সাক্ষাৎকারে অ্যাটর্নি জেনারেল কিছুটা ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, কেউ কিছু পছন্দ না করলে তা সামলাতে বিচার বিভাগকে ব্যবহারের একটা বাতিক রয়েছে। তাদের চোখে মনে হয়, বিচার বিভাগ ‘সব সমস্যা হরণকারী’ তাবিজ।

নির্বাচন প্রশ্নে উইলিয়াম বারের পরিবর্তিত অবস্থানে রাজনৈতিক মহলে বিস্ময়ের সৃষ্টি হয়েছে। তবে কি উইলিয়াম বার তাঁর সংবিৎ ফিরে পেলেন? সম্ভবত উইলিয়াম বার ইতিহাসের খলনায়ক হিসেবে আর পরিচিত হতে চান না।

ট্রাম্পের ব্যক্তিগত আইনজীবী রুডি জুলিয়ানি ‘যথাযথ সম্মানসহ’ বারের মন্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে এক পাল্টাবিবৃতি দিয়েছেন। তাতে বলা হয়েছে, কোনো রকম তদন্ত ছাড়াই অ্যাটর্নি জেনারেল যেসব কথা বলেছেন, তাতে এটা স্পষ্ট, যে ব্যাপক অনিয়ম ও জোচ্চুরি হয়েছে তার কিছুই তিনি জানেন না। উল্লেখ্য, জুলিয়ানির নেতৃত্বে ট্রাম্পের আইনজীবীরা ইতিমধ্যে ৩০টির বেশি মামলায় হেরে গেছেন। প্রতিটি ক্ষেত্রেই আদালত জানিয়েছেন, ভোট কারচুপির অভিযোগের কোনো প্রমাণ উপস্থিত করা হয়নি।

কোনো প্রমাণ থাক বা না থাক, ট্রাম্প কারচুপির যে অভিযোগ করে চলেছেন, অধিকাংশ রিপাবলিকান সমর্থক তাতে বিশ্বাস করেন। তাঁদের ধারণা, বাইডেন নন, ট্রাম্পই জিতেছেন। অনেকে এখন বিভিন্ন রাজ্যের নির্বাচনী কর্মকর্তার ওপর চড়াও হচ্ছে।

এ কাজে প্রধান মন্ত্রণাদাতা অবশ্য স্বয়ং ট্রাম্প। নির্বাচনে কোনো কারচুপি হয়নি, সাইবার নিরাপত্তাবিষয়ক দপ্তরের প্রধান ক্রিস ক্রেবস এমন ঘোষণা দিলে ট্রাম্প এক টুইটে তাঁকে পদচ্যুত করেন। সোমবার তাঁর আইনজীবী জো ডিজেনোভা সে সিদ্ধান্তে সুর মিলিয়ে এক রেডিও সাক্ষাৎকারে বলেন, ক্রিস ক্রেবসকে গুলি করে হত্যা করা উচিত।

ট্রাম্প জর্জিয়ার রিপাবলিকান গভর্নর ব্রায়ান কেম্প ও সেক্রেটারি অব স্টেট ব্রাড রাফেন্সপার্গারের ওপরেও খেপেছেন। তাঁদের দুজনকে তিনি নির্বাচনের ফলাফল পাল্টে দিতে চাপ দিয়েছিলেন। জবাবে তাঁরা বলেছেন, আইনবিরোধী কোনো কিছুই তাঁরা করবেন না। সে কথা শুনে ট্রাম্প বলেছেন, কেম্পকে নির্বাচনে জিততে সাহায্য করে তিনি মস্ত ভুল করেছেন। র‍্যাফেন্সপার্গারকে তিনি বলেছেন ‘গণশত্রু’।

নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে ট্রাম্প যে ধূম্রজালের সৃষ্টি করেছেন, তাতে বড় ধরনের হানাহানি হতে পারে, এমন উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন জর্জিয়ার জ্যেষ্ঠ নির্বাচনী কর্মকর্তা গ্যাব্রিয়েল স্টারলিং। মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে তাতে যেকোনো সময় মানুষ খুন হতে পারে। তিনি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও জর্জিয়ার দুই রিপাবলিকান সিনেটরের উদ্দেশে বলেন, ‘নির্বাচনী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যে শারীরিক আক্রমণের কথা বলা হচ্ছে, আপনারা কেউই তার নিন্দা করেননি। দয়া করে সহিংস কাজে উসকানি দেওয়া বন্ধ করুন।’ যাঁরা ক্ষমতা গ্রহণে আগ্রহী, তাঁদের পক্ষে এই সামান্য কাজ করা খুব কঠিন হওয়া উচিত নয় বলে তিনি মন্তব্য করেন।

আসল লক্ষ্য তহবিল সংগ্রহ

নির্বাচনে কারচুপি হয়নি, উইলিয়াম বারের মুখ থেকে এমন কথা শোনার পর ট্রাম্প ও তাঁর সমর্থকদের বাদ-প্রতিবাদ বন্ধ হবে এমন কথা ভাবার কোনো কারণ নেই। এর একটি সম্ভাব্য কারণ, কারচুপির বিরুদ্ধে আদালতে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার কথা বলে ট্রাম্প তহবিল সংগ্রহ অভিযানে ব্যস্ত রয়েছেন। তাঁর জন্য এটি একটি চমৎকার ‘বিজনেস অপরচুনিটি’। ওয়াশিংটন পোস্ট জানিয়েছে, নির্বাচনী ফল ঘোষণার পর থেকে ট্রাম্প শিবির ১৭০ মিলিয়ন ডলার চাঁদা তুলেছে। অধিকাংশ অর্থই সাধারণ ট্রাম্প সমর্থকদের কাছ থেকে এসেছে, যারা বিশ্বাস করে ভোট চুরির মাধ্যমে তাদের প্রিয় প্রেসিডেন্টকে ঠকানোর চেষ্টা হচ্ছে।

আইনি লড়াইয়ের নামে তোলা হলেও এই তহবিলের সিংহভাগই যাবে ট্রাম্প প্রতিষ্ঠিত একটি পলিটিক্যাল অ্যাকশন বা রাজনৈতিক কার্যক্রমবিষয়ক কমিটির খাতে। নিজেকে রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় রাখতে ট্রাম্প এই তহবিল তাঁর ইচ্ছামতো ব্যবহার করতে পারবেন। ‘আপনাদের হয়ে লড়তে আমাকে সাহায্য করুন,’ এই ভাষায় চাঁদা চেয়ে ট্রাম্প শিবির থেকে অসংখ্য ই-মেইল ছাড়া হয়েছে। অন্য একটি ই-মেইলে বলা হয়েছে, আগের চেয়েও এখন আপনাদের আমার বেশি প্রয়োজন।’ ওয়াশিংটন পোস্ট জানিয়েছে, যেভাবে অর্থ আসছে তাতে ভোট কারচুপির দাবি মিথ্যা জানা সত্ত্বেও ট্রাম্প ও তাঁর দলের কেউ সুর বদলের কোনো প্রয়োজন দেখছেন না।

ক্যাম্পেইন লিগ্যাল সেন্টারের অন্যতম পরিচালক ব্রেনডান ফিশার বলেছেন, ‘ইলেকশন ডিফেন্স ফান্ড’-এর নামে যে চাঁদা তোলা হচ্ছে, তা আসলে ব্যবহৃত হবে ট্রাম্পের ব্যক্তিগত ঋণ মেটাতে ও ভবিষ্যতের রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনায়। সিএনএনের একজন ভাষ্যকার বলেছেন, ‘এটা আসলে জোচ্চুরি, যা আমাদের চোখের সামনেই ঘটছে।’