সব সময়ই চাইতাম গল্পগুলো যেন বর্ণবাদী না হয়

>

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ফার্স্ট লেডি মিশেল ওবামার আত্মজীবনীমূলক বই ‘বিকামিং’ প্রকাশিত হলো গত ১৩ নভেম্বর, প্রকাশনা সংস্থা ‘পেঙ্গুইন র‍্যানডম হাউস’ থেকে। ‘বিকামিং’ তাঁর দ্বিতীয় বই। ২০১২ সালে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর প্রথম বই ‘আমেরিকান গ্রোন’, সে বইয়ে তিনি হোয়াইট হাউসে করা তাঁর সবজিবাগান সম্পর্কে লিখেছেন। বইটির মূল উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে স্বাস্থ্যকর জীবন সম্পর্কে উদ্বুদ্ধ করা। ঠিক ছয় বছর পর লিখলেন ‘বিকামিং’; ফেলে আসা শৈশব থেকে শুরু করে শিকাগোর সাউথ সাইডের কর্মজীবন, মাতৃত্ব ও কাজের মধ্যে থেকে থেকে যে সব অভিজ্ঞতার রসে তিনি সিক্ত হয়েছেন, যাতে তাঁর জীবন পূর্ণতা পেয়েছে, সেসব কথাই উঠে এসেছে ইতিমধ্যে বেস্ট সেলারে পরিণত হওয়া এই আত্মজীবনীতে।
বইটি প্রকাশের কয়েক সপ্তাহ পর, ৬ ডিসেম্বর নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার ‘বাই দ্য বুক’ বিভাগে সাবেক ফার্স্ট লেডির এই অন্তরঙ্গ সাক্ষাৎকারটি ছাপা হয়। এটির ভাষান্তর করেছেন এমদাদ রহমান

নিউইয়র্ক টাইমস: এখন পড়ার জন্য পাশের টেবিলে কোন বইগুলি এনে রেখেছেন?
মিশেল ওবামা: ঘুমোতে যাওয়ার আগে সব সময়ই পাশের টেবিলে একগাদা বই এনে রাখি। বইগুলোর বেশির ভাগই মোটামুটি পড়ে শেষ হওয়ার অপেক্ষায় থাকে। বহু বই আমাকে এভাবেই পড়ে শেষ করতে হয়, বেশির ভাগই ঘুমোতে যাওয়ার আগে। আমার খাটের পাশের টেবিলে এখন আছে টারা ওয়েস্ট ওভারের ‘এডুকেটেড’, তায়েরি জোন্সের ‘আমেরিকান ম্যারেজ’, মহসিন হামিদের ‘এক্সিট ওয়েস্ট’, জোডি স্মিথের ‘হোয়াইট টিথ’ এবং অ্যান প্যাসেটের লেখা ‘কমনওয়েলথ’—এ বইগুলো। নেলসন ম্যান্ডেলা স্বাক্ষরিত ‘কনভারসেশন উইদ মাইসেলফ’ বইয়ের কপিটিও এখানে আমার হাতের কাছে এনে রেখেছি। এ বইটি ম্যান্ডেলার লেখা ও বক্তৃতাগুলোর একটি সংগ্রহ, ম্যান্ডেলার ‘লং ওয়াক টু ফ্রিডম’ বইটিরই এক দীর্ঘায়িত রূপ। ম্যান্ডেলার এ বইয়ের ভেতর দিয়েই জীবনের বিভিন্ন সময়ে আমি আমার হারানো শক্তি ফিরে পেয়েছি, কিছু কথা বলার সাহস পেয়েছি; বইটি যখনই পড়েছি, নিজেকে নিঃসঙ্গ লাগেনি। বই দুটিকে আমি খুব যত্ন করি, কারণ এগুলোতে তিনি নিজে স্বাক্ষর করেছেন; যত্ন করি, কারণ ২০১১ সালে আমরা যখন তাঁর বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম তখন তিনি আমাকে বইগুলো উপহার দিয়েছিলেন।
নিউইয়র্ক টাইমস: কখন এবং কোথায় বই পড়তে পছন্দ করেন?
মিশেল ওবামা: বাড়িতে বই পড়ার মতো সময় এবং সুযোগ কোনোটিই আমার নেই। ভ্রমণপথেই বেশির ভাগ পড়া আমাকে পড়তে হয়। দীর্ঘ সব উড়ালপথে আমার বই পড়া হয়েছে সবচেয়ে বেশি। আবার, প্রচুর পড়া হয় যখন ছুটিতে থাকি; বলতে পারেন, বই পড়ায় আমি ঘোরগ্রস্ত হয়ে যাই ছুটির দিনগুলোতে।
নিউইয়র্ক টাইমস: সর্বশেষ পঠিত কোন বইটিকে শ্রেষ্ঠ মনে হয়েছে?
মিশেল ওবামা: শ্রেষ্ঠ সেই বইটির নাম ‘হোয়াইট টিথ’। বইটিকে যদিও আমি বছরখানেক আগে পড়েছি, তবুও এখন আবার পড়ার একটা তাগিদ অনুভব করছি। এখন আবারও বইটি হাতে তুলে নিয়েছি, তার পেছনের কারণটা হলো- আমার মেয়ে মালিয়া জোডি স্মিথ ও তাঁর লেখালেখির বড় এক ভক্ত, অনুরাগী।
তাঁর গল্পের ভেতরে এত শক্তি আর জটিল সব ঢেউ থাকার কারণেই আমি লেখাটিকে পছন্দ করেছি, যেখানে পরিবার, মাতৃত্ব, ধর্ম, রাজনীতি এবং আরও অনেক কিছুকে, অর্থাৎ, আমাদের বেঁচে থাকা এবং পারস্পরিক সম্পর্কগুলোকে বইটি কিছুটা হলেও প্রভাবিত করতে পেরেছে। জটিল হলেও দারুণ উপভোগ্য এ বইটি। আমি সেই সব বইই পড়তে পছন্দ করি যারা আমাকে পাতায় পাতায় হাসাতে পারে।
আমিও আমার আত্মস্মৃতি ‘বিকামিং’-এ এমন কিছু করতে চাই, কারণ একটি বই যদি গুরুগম্ভীর বিষয় নিয়েও রচিত হয়, তারপরেও আমি মনে করি বইটি পড়তে যেন আনন্দের ঘাটতি না হয়।
নিউইয়র্ক টাইমস: আপনি কি বরাবরই পুনঃপাঠ করেন? কোন বইগুলোর কাছে বারবার ফিরে আসেন?
মিশেল ওবামা: আমার মনে হয় এই প্রশ্নের উত্তরে হ্যাঁ এবং না- দুটোই বলব; প্রাপ্তবয়স্ক জীবনে পঠিত বইগুলোকে পুনঃপাঠ করার মতো যথেষ্ট সময় আমার ছিল না, তা বইগুলো আমার কাছে যতই গুরুত্বপূর্ণ হোক। হোয়াইট হাউসে আমার দিনগুলো মিনিট হিসেবে শিডিউল করা ছিল কিন্তু তারপরেও ছোট দুটি মেয়ে এবং এক স্বামী, যিনি প্রতিনিয়তই ওয়াশিংটন, ডিসি, কিংবা ইলিনয় স্টেট ক্যাপিটলে যাওয়া–আসা করেন, তাদের সঙ্গে একটি ভারসাম্যপূর্ণ জীবনযাপন করার চেষ্টা করছিলাম। নিজের কাজগুলো সুচারুরূপে করার পর পড়ার জন্য পাওয়া সীমিত সময়ের মধ্যেই নতুন নতুন বই পড়তে পছন্দ করতাম।
কিন্তু এই সমস্ত ব্যস্ততার মধ্যেও বলব, হ্যাঁ, এমন কিছু বই তো অবশ্যই আছে যাদের আমি বারবার পড়েছি। মেয়েরা যখন ছোট ছিল, তখন তাদের স্কুলের বইগুলো নিয়েই তাদের সঙ্গে লেগে থাকতাম। সম্প্রতি, টনি মরিসনের ‘সং অব সলোমন’ বইটিকে আমি তিনবার পড়েছি। মেয়েদের সঙ্গে মিলে ‘দ্য গ্রেপ্‌স অব র‍্যাথ’ও আবার পড়েছি। ‘লাইফ অব পাই’ বইটিও একাধিকবার পড়েছি, তাদের সঙ্গে মিলে। কিন্তু এখন তো তারাও বড় হয়েছে, এখন মায়েতে মেয়েতে মিলে এত বই পড়তে পারি না। কিন্তু আমাদের ‘লিটল ওবামা ফ্যামিলি বুক ক্লাব’ ব্যাপারটি বড় উপভোগ্য ছিল।
নিউইয়র্ক টাইমস: কোন ধরনের বই পড়তে বেশি পছন্দ করেন?
মিশেল ওবামা: যে কোনো ধরনের বই পড়ার জন্য আমি সব সময়ই প্রস্তুত, শুধু বইটিকে ভালো হতে হবে। তবে আমি খেয়াল করে দেখেছি যে ফিকশনধর্মী লেখার প্রতিই আমি বেশি আকৃষ্ট হয়েছি। একমাত্র ফিকশন পড়লেই আমি যেন নতুন এক জগতে নিজেকে হারিয়ে ফেলি। গত এক দশকে আমাকে এমন কিছু লেখা পড়তে হয়েছে, আমার অধ্যয়নের একটি বড় অংশ জুড়ে ছিল বিশ্বব্যাপী মেয়েদের লেখাপড়া, শিশুস্বাস্থ্য কিংবা মিলিটারি পরিবারগুলোর পলিসি সম্পর্কিত বিষয়গুলো। অবশ্যই এগুলো আমার কাছে খুব আকর্ষণীয় বিষয় ছিল; কিন্তু যখনই আমি আমার নিজের জন্য কিছু পড়তে চেয়েছি, তখন এমন কিছু বই চেয়েছি যা আমাকে অন্য কোথাও নিয়ে যাবে, অন্য কোনো জগতে। আবার এটাও বলব, আমি আসলে খুব বেশি পালাতেও চাই না, চেনা জগতেই সব সময় থাকতে চাই। আমি কিন্তু পৃথিবীর বাইরে অন্য কোনো গ্রহেও যেতে চাই না, অতিমাত্রার কল্পনার জগতেও হারাতে চাই না। সায়েন্স ফিকশন সত্যিই আমার জন্য নয়।
সৌভাগ্যক্রমে, আমার এমন এক বন্ধু-পাঠকের দল আছে যারা আমাকে সব সময়ই নতুন সব বই ও লেখক সম্পর্কে খবর দেয়। সহজেই বুঝতে পারি সাম্প্রতিক সময়ের কোন কোন লেখককে পড়তে হবে। আমার চিফ অব স্টাফ যিনি, তিনি সব সময়ই সদ্য প্রকাশিত একটি বই পড়ে শেষ করার মাঝপথে থাকেন, এবং অবশ্যই বারাক ওবামা এখনো আমাকে জরুরি বইগুলোর খোঁজ দেয়, পড়তে বলে; ঠিক যেমন ওর সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের পর বলত। এ সব কিছুর মানে হলো, আমাকে কী পড়তে হবে তার সবকিছুই আমার নখদর্পণে। সুতরাং পরবর্তী সময়ে বইগুলো সম্পর্কে সত্যিই আমার কাছে পরামর্শের অভাব থাকে না।
নিউইয়র্ক টাইমস : এরপর কোন বইগুলো পড়বেন বলে ঠিক করেছেন?
মিশেল ওবামা: টারা ওয়েস্ট ওভারের ‘এডুকেটেড’ বইটি পড়ব। বারাক এই বইটি পড়তে দিয়েছে। আমি আসলে বইটি মাত্রই পড়ে শেষ করেছি। আর অনেকেই স্বীকার করবেন যে বইটির বিষয় আশয় ফেনোমেনাল (ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বোধসংক্রান্ত) এবং অবিস্মরণীয়। আমার মতে, এই লেখাটি সব সময় পড়ার পক্ষে দারুণ উপভোগ্য একটি বই। শিক্ষার শক্তিকে বইটি নতুন এক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে চেয়েছে। বইটি এমন কিছু ব্যাপার আমাদের দেখায় যার মাধ্যমে আমরা আমাদের জীবনকে মজবুত ভিতের ওপর স্থাপন করতে পারব। জীবনকে কাঙ্ক্ষিতরূপে গড়ে নিতেও পারব। এ ছাড়া, যেহেতু আমি নিজের একটি স্মৃতিকথা লেখার কাজ শেষ করছি, সেই লেখার কাজটি চলা অবস্থায় আমি দেখতে চাইছিলাম যে লোকেরা কীভাবে তাদের নিজেদের গল্প বলতে পছন্দ করে— জীবনের ছোট্ট মুহূর্তগুলো বড় সত্যকে প্রকাশ করে; কীভাবে একটি চরিত্র নির্মিত হয়, সম্পূর্ণ গল্পটি বলবার অদম্য সাহসটুকু কোথায় পাওয়া যায়, ইত্যাদি। টারা ওয়েস্ট ওভারের জন্ম ও বেড়ে ওঠা, ছেলেবেলার শিক্ষাদীক্ষা এসব আমার থেকে সম্পূর্ণই আলাদা, কিন্তু তাঁর নিজের জগৎ সম্পর্কে আমার জেনে নেওয়াটা আমাকে এমন এক অভিজ্ঞতা দিয়েছে যার মাধ্যমে আমি আমার জীবনের যাত্রাপথ এবং অভিজ্ঞতাগুলোকে উপলব্ধি করতে পেরেছি, যেখানে গল্পগুলো আমার জীবনের নয়। আমার কাছে বইটি মানুষের গল্প বলার অসাধারণ শক্তির একটি উদাহরণ।
নিউইয়র্ক টাইমস: ছেলেবেলার প্রিয় বইগুলোর কথা কি এখনো মনে আছে? তখন কি আপনার কোনো প্রিয় চরিত্র কিংবা নায়ক ছিল?
মিশেল ওবামা: পিপি লংস্টকিং (এস্ট্রিড লিন্ডগ্রেনের লেখা ছোটদের গল্পের সিরিজ) তো আমার নিজের মেয়েই ছিল! আমি পিপির সাহস আর তার ভেতরের শক্তিটাকে ভালোবাসতাম। শুধু তার শারীরিক শক্তিই নয়, ঠিক যে উপায়ে আর কেউ যেন তার কণ্ঠকে রোধ করতে না পারে, সে জন্য সে যেভাবে নিজেকে গড়ে তোলে, গড়ার সেই আইডিয়াটিকে আমার দারুণ পছন্দ হয়েছিল। পিপি কোনোভাবেই তার কণ্ঠকে রোধ করতে দেবে না। সে ছিল স্বাধীনচেতা, বুদ্ধিমতী এবং প্রচণ্ড কৌতূহলী; এবং একটি শান্ত সুবোধ ভালো মেয়ে, স্পষ্ট করে বললে তার সম্পর্কে এসবই বলা যায়। দস্যি মেয়েদের সব বৈশিষ্ট্যই তার মধ্যে ছিল; সে সব সময়ই বন্ধুদের সাহায্যের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ত। পিপি চরিত্রটি মেয়ে ছিল বলেই তার প্রতি আমার এত ভালোবাসার জন্ম হয়েছিল। আর সে ছিল ছোট্ট একটি মেয়ে, একরত্তি। আমার ছেলেবেলার বইগুলোয় যত চরিত্র ছিল তাদের মধ্যে একমাত্র সে-ই ছিল সবচেয়ে শক্তিশালী।
অদ্ভুত লাল লেজ এবং রোদেপোড়া চামড়া নিয়েও পিপি লংস্টকিঙের মতো একটি কালো মেয়ের শিকাগোর সাউথ সাইডে রোল মডেলে পরিণত হওয়াটাকে হয়তো কিছু লোক অস্বাভাবিক মনে করেন। কিন্তু আমি যখন ছোট ছিলাম, তখন ঠিক আমারই মতো দেখতে এমন কয়েকটি বিশিষ্ট চরিত্র ছিল। তখন টেলিভিশনে ডক ম্যাকস্টাফিন চরিত্রটিও ছিল না, এমনকি বড় পর্দায় কোনো ‘ব্ল্যাক প্যান্থার’ও ছিল না। তারপর, আমার যখন নিজের সন্তান হলো, আমি তখন তাদের জন্য সেই গল্পগুলোকেই খুঁজে বের করলাম যে-গল্পের চরিত্রগুলো দেখতে ঠিক আমার মেয়েদের মতো। সেই সঙ্গে এটাও আমাকে খেয়াল রাখতে হতো যে, গল্পগুলো যেন কোনোভাবেই বর্ণবাদী না হয়। তখন আমাদের প্রিয় লেখাগুলোর মধ্যে এজরা জ্যাক কিটসের ‘দ্য স্নোই ডে’ বইটিও ছিল অন্যতম। তুষারাবৃত দিনে একটি ছেলের দুঃসাহসী অভিযান নিয়ে লিখিত হয়েছিল বইটি। ছেলেটি তুষারের দেবদূত বানিয়েছিল, উঁচু উঁচু খুঁটি বানিয়েছিল, তারপর তুষারের বল বানিয়ে সবকিছু ভেঙে ফেলছিল। সেই ছেলেটি কালো ছিল, এবং সে শহরে বাস করত। সে ছিল শুধুই একটি বাচ্চা, অবোধ ছেলে, এবং তাঁর চমৎকার সব অভিযান আমাদের ছেলেবেলাকে পূর্ণ করে রেখেছিল।