সহিংসতা দেখবে কি এবারের নির্বাচন

জো বাইডেন ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প
রয়টার্স ফাইল ছবি

যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন নিয়ে যখন প্রতিদিনই বিভিন্ন ধরনের জনমত জরিপ প্রকাশিত হচ্ছে এবং দুই প্রেসিডেন্ট প্রার্থী জো বাইডেন ও ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন তাঁদের প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন, ঠিক তখনই যুক্তরাষ্ট্রে এমন সব ঘটনা ঘটছে, যেগুলো নির্বাচন এবং নির্বাচন–পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে শঙ্কার সৃষ্টি করছে। নির্বাচন ঘিরে সহিংসতার আশঙ্কাও তৈরি হচ্ছে।

এ ধরনের আশঙ্কার একটি সাম্প্রতিক সূত্র হচ্ছে ডাকযোগে ভোট দেওয়া নিয়ে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের একটি ভিত্তিহীন অভিযোগ। তিনি অভিযোগ করেছেন যে এতে জালিয়াতি হবে। গত বৃহস্পতিবার ট্রাম্প আবারও এই নিয়ে টুইট করেছেন, ‘নির্বাচনের ফলাফল সম্ভবত কোনো দিনই সঠিকভাবে জানা যাবে না, কেউ কেউ সেটাই চান।’ তাঁর এ ধরনের মন্তব্যকে এমনকি তাঁর দলের সিনেটররা পর্যন্ত খারিজ করে দিয়েছেন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ডাকযোগে ভোট দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলে নির্বাচনের বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ করতে চাইছেন। গত জুলাই মাসে ট্রাম্প নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ারও প্রস্তাব করেছিলেন।

ট্রাম্পের এ ধরনের বক্তব্যের কারণে তিনি পরাজিত হলে ফল মেনে নেবেন কি না, সেই সংশয় তৈরি হয়েছে। গত ১৬ জুলাই ফক্স টেলিভিশনে এক সাক্ষাৎকারে তাঁকে নির্বাচনের ফলাফল মেনে নেওয়া নিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল। জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘আমাকে দেখতে হবে, আমি হ্যাঁ বলব নাকি না বলব।’ আগস্ট মাস থেকে বিভিন্ন সমাবেশে তিনি বলে আসছেন যে একমাত্র জালিয়াতির মাধ্যমেই তাঁকে হারানো সম্ভব। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে সম্ভবত এ ধরনের প্রশ্ন আবারও মোকাবিলা করতে হবে প্রতিপক্ষ জো বাইডেনের সঙ্গে বিতর্কের সময়। ২৯ সেপ্টেম্বর প্রথম বিতর্ক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। ২০১৬ সালে বিতর্কের সময় ট্রাম্পকে এই প্রশ্ন করা হলে তিনি সঞ্চালক ক্রিস ওয়ালেসকে বলেছিলেন, ‘আমি আপনাকে সাসপেন্সে রাখব।’

শুধু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এ ধরনের আচরণ নয়, তাঁর সমর্থক এবং সহযোগীরাও এমন ধরনের কথাবার্তা বলছেন, যা নির্বাচনের পরের পরিস্থিতি সহিংস করে তুলতে পারে। হেলথ অ্যান্ড হিউম্যান সার্ভিসের একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা মাইকেল কাপুটো ১৪ সেপ্টেম্বর তাঁর ফেসবুক পেজে লাইভে বলেন, ‘ট্রাম্প নির্বাচনে বিজয়ী হবেন কিন্তু বাইডেন তা মানবেন না।’ ষড়যন্ত্রতত্ত্ব প্রচার করে এমন কিছু ওয়েবসাইটে এ ধরনের কথাবার্তা বলা হচ্ছে এবং ট্রাম্প ও তাঁর প্রশাসনের লোকজন সেগুলো পুনঃপ্রচার করছে।

কাপুটো আরও বলেন, যখন ট্রাম্প তাঁর অভিষেক থেকে সরে যেতে চাইবেন না, তখনই গোলাগুলি শুরু হবে। তিনি এর জন্য ‘তাঁদের’ দায়ী করেন, কিন্তু এই ‘তাঁরা’ কারা, সেটা বলেননি। এই ফেসবুক লাইভে তিনি অবশ্য অভিযোগ করেছেন, বামপন্থীরা বিদ্রোহের জন্য হিট স্কোয়াড তৈরি করছে। তিনি বলেন, ‘আপনার যদি অস্ত্র থাকে, তবে এখনই গুলি কিনে রাখুন সেই সময়ে আর গুলি পাওয়া যাবে না।’ তিনি সরকারি স্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্থা সিডিসির বিজ্ঞানীদের বিরুদ্ধে ‘রাষ্ট্রদ্রোহের’ অভিযোগ আনেন এবং বলেন করোনাভাইরাসের টিকা নিয়ে তাঁরা প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। এসব বক্তব্য নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে গত মঙ্গলবার তিনি ক্ষমা চান এবং ছুটিতে চলে যান। করোনাভাইরাস বিষয়ে কাপুটোর কোনো ধরনের বিশেষজ্ঞ জ্ঞান না থাকলেও ট্রাম্প তাঁকে এপ্রিল মাসে এই বিভাগে নিয়োগ দিয়েছিলেন।

ট্রাম্পের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি রজার স্টোন ১০ সেপ্টেম্বর একটি উগ্র দক্ষিণপন্থী ওয়েবসাইট ‘ইনফোওয়ার’কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ক্ষমতায় থাকার জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে ‘মার্শাল ল’ জারি করার এবং নির্বাচনে বিজয়ী না হলে ‘ইনসারকেশন অ্যাক্ট’ ব্যবহার করার পরামর্শ দেন। ১৮০৭ সালের এই আইনের আওতায় দেশের ভেতরে বিদ্রোহ দমানোর জন্য প্রেসিডেন্ট প্রতিরক্ষা বাহিনীকে ব্যবহার করতে পারেন। জুন মাসে দেশে পুলিশি নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময় প্রেসিডেন্ট এই আইন ব্যবহারের হুমকি দিয়েছিলেন। রজার স্টোন ওই সাক্ষাৎকারে রিপাবলিকানদের প্রতি ভোট গণনা জোর করে আটকে দেওয়ার আহ্বান জানান। স্টোন বেশ কিছু মামলায় দণ্ডিত হয়েছিলেন এবং প্রেসিডেন্ট তাঁর ক্ষমতা ব্যবহার করে সেগুলো কমিয়ে দেন।

একই দিন ফক্স টেলিভিশনের উপস্থাপক গ্রেগ গাটফিল্ড বলেন, নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটরা যদি বিজয়ী না হয়, তা হলে দেশে ব্যাপক অসন্তোষ তৈরি হবে। তিনি এ জন্য ডেমোক্র্যাট সমর্থক গণমাধ্যমকে দায়ী করেন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাঁর নির্বাচনী বক্তৃতায় বারবার বলেছেন যে তিনি বিজয়ী না হলে শহরতলিগুলো স্বল্প আয়ের লোকজনের আবাসনে ছেয়ে যাবে এবং সেখানে ছড়িয়ে পড়বে নৈরাজ্যবাদী, লুটেরারা।

একই দিন ফক্স টেলিভিশনের উপস্থাপক গ্রেগ গাটফিল্ড বলেন, নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটরা যদি বিজয়ী না হয়, তা হলে দেশে ব্যাপক অসন্তোষ তৈরি হবে। তিনি এ জন্য ডেমোক্র্যাট সমর্থক গণমাধ্যমকে দায়ী করেন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাঁর নির্বাচনী বক্তৃতায় বারবার বলেছেন যে তিনি বিজয়ী না হলে শহরতলিগুলো স্বল্প আয়ের লোকজনের আবাসনে ছেয়ে যাবে এবং সেখানে ছড়িয়ে পড়বে নৈরাজ্যবাদী, লুটেরারা। এসব বক্তব্য ট্রাম্পের সমর্থকদের উত্তেজিত করার ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করছে।

১৬ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্ক টাইমস–এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা যায়, কয়েক মাস ধরে দেশে যেসব বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছে , সেগুলোতে অংশগ্রহণকারীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনা যায় কি না, তা খতিয়ে দেখতে সরকারি কৌঁসুলিদের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল উইলিয়াম বার। সিয়াটলে শহরের কেন্দ্রস্থলে বিক্ষোভকারীদের জন্য ‘পুলিশমুক্ত এলাকা’ করতে দেওয়ায় মেয়র জেনি ডারকানের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করা যায় কি না, তা–ও খুঁজে দেখতে বলেন। এ ধরনের পদক্ষেপ যে উসকানি হিসেবেই কাজ করবে, সেটা সহজেই বোধগম্য। পোর্টল্যান্ড শহরে বিক্ষোভ মোকাবিলার জন্য ফেডারেল সরকার বাহিনী পাঠানোর পরে সেখানে পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছিল। নির্বাচনের সময় হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগের মাধ্যমে আইন বিভাগ যদি এ ধরনের ব্যবস্থা নেয়, তা সহিংসতা সৃষ্টির উপাদান হিসেবেই কাজ করবে।

আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর