সিনেট নির্বাচনেও প্রভাব ফেলতে পারে গিন্সবার্গের মৃত্যু

বিচারপতি রুথ বেইডার গিন্সবার্গ
রয়টার্স ফাইল ছবি

যুক্তরাষ্ট্রের উদারনৈতিক বিচারপতি রুথ বেইডার গিন্সবার্গের মৃত্যুর ফলে যে রাজনৈতিক দড়ি–টানাটানি শুরু হয়েছে, তার প্রভাব শুধু প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেই নয়, সিনেটের নির্বাচনেও পড়বে। সিনেটের ৩৫টি আসনে নির্বাচন হচ্ছে। এর মধ্যে এখন ২৩টি রিপাবলিকান এবং ১২টি ডেমোক্র্যাটদের দখলে আছে। নিজেদের কোনো আসন না হারিয়ে মাত্র চারটি অতিরিক্ত আসন পেলে ডেমোক্র্যাটরা সিনেটের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাবে।

জনমত জরিপ অনুসারে আটজন রিপাবলিকান ও দুজন ডেমোক্রেটিক সিনেটর বিপদের মুখে রয়েছেন। গিন্সবার্গের মৃত্যু উভয় দলের এসব সিনেট প্রার্থীর জন্য অতিরিক্ত বিপদ ও সুযোগ সৃষ্টি করেছে।

এ দেশে ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট সুপ্রিম কোর্টের শূন্যস্থান পূরণে তাঁর পছন্দের কোনো প্রার্থী মনোনয়ন করেন, কিন্তু তা অনুমোদনের দায়িত্ব সিনেটের। ডেমোক্র্যাটরা আশা করছে, সুপ্রিম কোর্ট দীর্ঘ সময়ের জন্য রক্ষণশীলদের হাতে চলে যাবে, এ আশঙ্কায় অধিকাংশ আমেরিকান, বিশেষত নারীরা, বিপুল সংখ্যায় তাঁদের সিনেট প্রার্থীদের ভোট দেবেন। অন্যদিকে রিপাবলিকানরা শূন্যপদে একজন রক্ষণশীল বিচারপতি নিয়োগের আশা করছে। এটা হলে তা রক্ষণশীল ভোটারদের দারুণভাবে উজ্জীবিত করবে। তারা দীর্ঘদিন থেকে একটি রক্ষণশীল সুপ্রিম কোর্টের অপেক্ষায় থেকেছে। গিন্সবার্গের জায়গায় ট্রাম্প যদি একজন রক্ষণশীল বিচারপতির নিয়োগ নিশ্চিত করতে পারেন, তাহলে এই আদালতে রক্ষণশীল বনাম উদারনৈতিক শিবিরের অনুপাত দাঁড়াবে ৬: ৩।

এই উৎসাহের ভরসায় রিপাবলিকান সিনেট প্রার্থীরা প্রায় সবাই ট্রাম্পের প্রতি তাঁদের সমর্থন ব্যক্ত করেছেন। নির্বাচনের বাকি মাত্র ৪১ দিন। তার আগেই একজন নারী বিচারকের মনোনয়ন তিনি ঘোষণা করবেন বলে জানিয়েছেন ট্রাম্প। সিনেট নেতা মিচ ম্যাককনেল বলেছেন, নির্বাচনের আগেই তাঁরা সে প্রার্থীর নিয়োগ প্রশ্নে ভোট গ্রহণ করবেন। এর আগে ২০১৬ সালে নির্বাচনের বছরের যুক্তি দেখিয়ে ম্যাককনেল প্রেসিডেন্ট ওবামার প্রস্তাবিত প্রার্থী মেরিক গ্যারল্যান্ডের মনোনয়নের প্রশ্নে কোনো রকম শুনানির আয়োজন করতে পর্যন্ত অস্বীকার করেছিলেন। সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী জো বাইডেন জোর দাবি তুলেছেন, গিন্সবার্গের শূন্যস্থানে বিচারপতি মনোনয়ন নভেম্বরের নির্বাচনে বিজয়ী প্রেসিডেন্ট করবেন। কিন্তু ট্রাম্প তত দিন অপেক্ষা করতে নারাজ, তিনি বলেছেন, এটি শুধু তাঁর আইনগত অধিকার নয়, শাসনতান্ত্রিক দায়িত্ব।

মাত্র দুজন ছাড়া সিনেটে ট্রাম্পের দলের সদস্যরা এ ব্যাপারে একমত। এর পেছনে স্পষ্ট কারণ রয়েছে। মাত্র দুটি ছাড়া নাজুক বিবেচিত রিপাবলিকান আসনসমূহ ‘লাল’ অর্থাৎ রিপাবলিকান-প্রভাবিত অঙ্গরাজ্যে। ২০১৬ সালের নির্বাচনে ট্রাম্প এর প্রতিটিতে বড় ব্যবধানে জিতেছিলেন। নানা কারণে এসব রাজ্যে বর্তমানে ট্রাম্পের জনসমর্থন কিছুটা শিথিল, তবে রিপাবলিকানদের মধ্যে তিনি এখনো ব্যাপক জনপ্রিয়। ঝুঁকির মুখে থাকা এসব সিনেটর ট্রাম্পের জনপ্রিয়তায় ভর করে বৈতরণি পার হওয়ার আশা করছেন। তাঁদের মধ্যে চারজন জনমত জরিপে বেশ পিছিয়ে। তাঁরা আশা করছেন, যেসব রিপাবলিকান ভোটার ট্রাম্পের প্রতি বিরক্ত, সুপ্রিম কোর্টে আরও একজন রক্ষণশীল বিচারপতি নিয়োগের সম্ভাবনায় তাঁরাও উদ্দীপ্ত হবেন। ২০১৮ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচনে প্রধানত এসব আশাহত ভোটারের সমর্থনেই ডেমোক্র্যাটরা কংগ্রেসের প্রতিনিধি পরিষদের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেয়েছিল। একজন রিপাবলিকান নির্বাচনী কৌশলবিদের ভাষায়, এই সব ‘নমনীয় রিপাবলিকানরা’ এবার হয়তো বড় সংখ্যায় নিজ ঘরে ফিরবে।

ডেমোক্রেটিক বা ‘নীল’ হিসেবে পরিচিত অঙ্গরাজ্য কলোরাডো ও মেইনের অবস্থা কিছুটা ভিন্ন। এই দুই রাজ্যেই জনমতে পিছিয়ে ট্রাম্প। ভোটে তিনি পর্যুদস্ত হলে এই রাজ্যদ্বয়ের সিনেটর সুসান কলিন্স ও করি গার্ডনারেরও খাবি খাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সে বিপদের কথা মাথায় রেখে সুসান কলিন্স নির্বাচনের আগে নতুন বিচারপতি নিয়োগের বিরোধিতা করেছেন। অন্যদিকে কোরি গার্ডনার জানিয়েছেন, তিনি ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত সমর্থন করেন। কলিন্স মধ্যপন্থী হিসেবে পরিচিত, তিনি আশা করছেন ট্রাম্পের বিরোধিতা করায় এই রাজ্যের মধ্যপন্থী ভোটাররা তাঁকে পুরস্কৃত করবেন। অন্য দিকে গার্ডনার ভাবছেন, রিপাবলিকান ও স্বতন্ত্র ভোটাররা, যাঁরা একটি রক্ষণশীল সুপ্রিম কোর্ট সমর্থন করেন, তাঁরা হয়তো ভারী সংখ্যায় তাঁর পক্ষে ভোট দেবেন।

ডেমোক্র্যাটদের হিসাবটা অবশ্য ভিন্ন। সুপ্রিম কোর্ট যদি ৬: ৩ অনুপাতে রক্ষণশীলদের হাতে চলে যায়, তাহলে স্বাস্থ্যসেবা, গর্ভপাত, বর্ণবৈষম্য, ভোটাধিকার ও পরিবেশ প্রশ্নে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটবে। জো বাইডেন সে বিপদঘণ্টি বাজিয়ে বলেছেন, কোভিড-১৯–এর কারণে লাখ লাখ মানুষ বিপদে রয়েছে। ওবামাকেয়ার নামে পরিচিত স্বাস্থ্যবিমা কর্মসূচি যদি বাতিল হয়—ট্রাম্প যা বাতিলের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন—তাহলে কমপক্ষে দুই কোটি মানুষ স্বাস্থ্যবিমা থেকে বঞ্চিত হবে।

গিন্সবার্গের মৃত্যুর পর এখন পর্যন্ত কোনো অর্থপূর্ণ জনমত জরিপ হয়নি। ইতিপূর্বে নিউইয়র্ক টাইমস–এর গৃহীত এক জরিপে মেইন, অ্যারিজোনা ও নর্থ ক্যারোলাইনার ভোটাররা সুপ্রিম কোর্টের জন্য সঠিক প্রার্থী মনোনয়ন প্রশ্নে ট্রাম্পের চেয়ে বাইডেনের প্রতি অধিক আস্থা রাখেন। ডেমোক্র্যাটরা আশা করছে, এ আস্থার জোরে এবং ট্রাম্পের প্রতি অসন্তোষের কারণে শুধু ট্রাম্প পরাস্ত হবেন, তা–ই নয়, রিপাবলিকানরা সিনেটে তাদের নিয়ন্ত্রণ হারাবে। বাইডেনের সমর্থকেরা যে ভীষণ তেতে উঠেছেন, তার প্রমাণও পাওয়া যাচ্ছে। গিন্সবার্গের মৃত্যুর পর প্রথম দুই দিনে তাঁর নির্বাচনী শিবির ১০০ মিলিয়ন ডলারেরও অধিক তহবিল সংগ্রহ করেছে।

সুপরিচিত রিপাবলিকান নির্বাচনী কৌশলবিদ স্টিভ স্মিথ, যিনি এখন আনুগত্য বদলে জোরেশোরে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে প্রচার চালাচ্ছেন, তিনি বিশ্বাস করেন, ডেমোক্র্যাটরাই অধিক সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে। তাঁর কথায়, রিপাবলিকানরা সুপ্রিম কোর্টে গিন্সবার্গের শূন্যস্থান পূরণের চেষ্টা করে সুবিধা পাবে, এই ধারণা ভুল। তিনি বলেছেন, ‘আমার বিশ্বাস, এটাই হবে ট্রাম্প ও রিপাবলিকানদের কফিনে শেষ পেরেক।’