সীমান্তের ট্রেন

আম্মা কেন বাঁশঝাড়ের ভেতরে ঢুকল বুঝতে পারছি না। এই বিকেলে তো ঘরের রান্না শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। মাঝেমধ্যে রান্নার আগুনের জন্য শুকনা বাঁশ লতাপাতা দরকার হয়, তখন আম্মাকে এমন ঝাড়ে ঝোপে দেখা যায়। পুকুর থেকে লাফ দিয়ে ওপরে উঠে দেখতে থাকলাম, হ্যাঁ এটা আম্মাই তো! বাঁশঝাড়টা পুকুরের উত্তর পাশের কোনায় পাড় থেকে একটু দূরে বলে আম্মা আমাকে দেখতে পায়নি বোধ হয়; পেলে তো এদিকেই আসত। আমাদের দুটো পুকুরই বেশ বড়; একটা বাড়ির সামনে, আরেকটা পেছনে। বাড়ি ফেলে একটু সামনে গেলে একটা দিঘিও আছে।
ঘণ্টার পর ঘণ্টা সাঁতার কাটা আমার শখ। এটাও আমার খেলার অংশ। বৃষ্টির দিনে পুকুরে ডুবে সাঁতার কাটার মজাই আলাদা। ডুব দিলে বৃষ্টির শব্দ যেন খোলা তাওয়ায় মুড়ি ভাজার মতো মনে হয়। তবে আম্মা সাঁতার দিয়ে আমাকে কোনদিনই ধরতে পারে না। ওনার গোসল আর সাঁতার ওই বাঁধানো ঘাট পর্যন্তই। বড়জোর একটু বকা দেবে, তাই মনের সুখে আরও কিছু সময় সাঁতার কাটতে থাকলাম।
আজকে বাজারবার। আমার বাবারা নয় ভাই, ছয় বোন। সবার ছেলেমেয়ে নিয়ে জমজমাট বাড়ির চারপাশ। চাচারা সবাই বাজার শেষ করে ফিরেছে। তাই চাচিদের সবাই মাছ-তরকারি ধুতে আসে, আর আমাকে পুকুরঘাট থেকে উঠতে বকা দিয়ে যায়। আমি তাঁদের কোনো কথাই গায়ে মাখি না। আপন মনে সাঁতার কেটে চলি। এত মানুষের মধ্যে আমি একা থাকতে চাই। কেমন করে যেন সবার নজর শুধু আমার দিকেই থাকে। তবে খুশির বিষয় চাচাদের কেউ পেছনের পুকুরে আসে না, তাই একটু শান্তি। সামনের পুকুরে এখন আর গোসল করা যায় না। ওটা শুধুই ছেলেদের। ছেলেরা মনের আনন্দে সাঁতার কাটে। মেয়েদের কেউই সামনের পুকুরে যায় না। আমি কিন্তু একটু খালি দেখলেই কয়টা ডুব দিতে ভালোবাসি। একদিন বড় চাচা আমাকে সামনের পুকুরে সাঁতার কাটতে দেখে আম্মাকে বলে দেন। অনেক বকা, কানমলা, থাপ্পড় খেতে হয়েছিল সেদিন। তারপর থেকে আর সামনের পুকুরে গোসল করা হয় না। যদিও সামনের পুকুর আমাকে খুব টানে। খুব পরিষ্কার পানি, বেশ বড় পুকুরঘাট, নষ্টও হয়নি।
আমার বয়সী সব ছেলে যখন মন চায় পানিতে ঝাঁপ দিয়ে গোসল করে। শুধু আমাকেই নেয় না। এ কি! আম্মা চিকন কাঠি-বাঁশ একটার সঙ্গে আরেকটা বেঁধে লম্বা করে পুকুরের দিকেই আসছে কেন? উনি দুটো বাঁশকে জোড়াই বা দিলেন কেন? পুকুরে কি কিছু পড়ছে নাকি? আমাকে বললেই তো হয়। আমি খুঁজে দিই। এখানে আমার মতো সাঁতার তো অন্য কেউ জানে না।
আম্মার চেহারা বেশি সুবিধার ঠেকছে না। ঘাটে নেমেই রেগেমেগে আমাকেই খোঁজা শুরু করলেন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই লম্বা করা চিকন বাঁশ দিয়ে পানিতে মারা শুরু করলেন।
-সন্ধ্যা হয়ে গেছে দেখস না? তুই কি মাছ! কয় ঘণ্টা ধরে সাঁতার কাটস? প্রতিদিন এত সময় নিয়ে তোর সাঁতার কাটা আমি বের করছি দাঁড়া। একদম নড়বি না। বাড়ির মানুষের আর কত কথা শোনাবি?
আম্মা যত মারে আমি ততই তাঁর কাছে আসতে থাকি। কাছে আসতেই চুল ধরে টেনে তুলতে তুলতেই চড়-থাপ্পড় দিতে থাকেন, আর শাড়ির আঁচলে চোখ মুছতে থাকলেন। বোঝা যায় সবার কথা শুনে মনের কষ্টে এই কান্না। আমি কিছুই শুনি না, দেখিও না। আমার হাতের আঙুল চেক করে দেখতে থাকেন আর কান্না জড়ানো গলায় বলতে থাকেন,
-পানিতে থাকতে থাকতে হাত ফুটা বরইর মতো ফুঁটা হয়ে গেছে। চোখ দুটা লাল হয়ে যায়, তুই কি বুঝোস না? এত্ত বড় হইছোস কবে বুঝবি এই সব?
-কী হয় লাল হইলে? এই যে দেখ হাতও ঠিক আছে। আমি হাত নেড়ে বোঝাই যে কিছু হয় নাই। তুমি শুধু শুধু মার। আমি কই বড় হইছি, এখনো তোমার সমান হই নাই।
-হ্যাঁ, কথা না শুনলে শুধুই মারব। কেন বুঝোস না তুই এখন বড় হইছোস। বড় হইলে এমন যখন-তখন দাপাদাপি করা যায় না। মানুষ খারাপ বলে।
-কোন মানুষ আম্মা?
-তোর দাদি চাচিরা আমারে কথা শোনায়।
-আমার পানি ভালো লাগে, সাঁতার কাটতে ভালো লাগে।
-লাগুক! কাল থেকে আমি গোসল করায়ে দিব। আর একা পুকুরে নামবি না। মনে থাকবে তো?
-থাকবে কিন্তু তুমি তো খালি কাজ কর।
-তুইও আমার সঙ্গে কাজ করবি।
-নাহ্। আমি কাজ করব না।
-মেয়েদের ঘরের কাজ শিখতে হয়।
-আমি মেয়ে হতে চাই না।
আম্মাকে দেখলাম মুখ ফিরিয়ে চোখ মুছতে। এর মধ্যেই মাথা মুছে জামা পাল্টিয়ে রান্নাঘর থেকে দৌড়ে ভাতের থালা এনে মুখে দিতে দিতে আর কী কী করা যাবে না, তা বলতে থাকলেন।
-আম্মা কী কী করতে পারব এসব বল।
-শুধু মন দিয়ে পড়াশোনা।
- নাহ্ পড়াশোনা করব না, আমার পড়তে ভালো লাগে না।
আম্মা আমার কথা পাত্তা দেন না। ওনার কথাই বলতে থাকেন,
- স্কুলের পর সোজা বাড়িতে। আমাকে ছাড়া কোথাও যাবি না। কেউ ডাকলেও যাবি না!
-কেউ ডাকলেও যাব না?
-না, বলছি না, যাবি না।
-সবাই তো যায়, নিজাম, জহির, রাজু-ওরা তো সবাই যায়। চাচিরা কেউ তাদেরকে বকে না, মারেও না।
-আবার তর্ক? চুপ করে পড়তে বস।
আওয়াজ করে পড়ার চর্চা আমাদের সবার। তাই আমিও জোরে জোরে পড়ি, আর আম্মা কাজ করে। দূর থেকে আমায় পড়া ধরে। মাঝে মাঝে বানানও জিজ্ঞেস করে।
হারিকেনের আলোয় পড়ি। তবে চোখ থাকে বাইরে। উঠানে কে কোন দিকে হাঁটে, তা দেখি। বড়রা মাঝে মাঝে সীমান্তের গোলগুলির গল্প বলেন। সেসব কান খাড়া করে শুনি। ইন্ডিয়া প্রতিদিনই কোনো-না-কোনো কারণে আমাদের এপারের মানুষ গুলি করে মারে। কারণ তারা চোরাই পথে চাল, ডাল, চিনি, বিড়ি এসবের ব্যবসা করে। চোখ ও মনোযোগ বাইরে থাকায় আমার পড়ার গলার আওয়াজ ওঠানামা করে। আম্মা সরাসরি না দেখলেও ধরে ফেলেন আমি পড়ছি না। আবার দৌড়ে কাছে এসে পড়ান। এভাবেই মা-মেয়ের দিন কাটতে থাকে। আব্বার সরকারি চাকরি। আজ এখানে তো কাল সেখানে বদলি হয়। আমার তাতে কোনো সমস্যা হয় না। মাঝে মাঝে বাড়ি আসেন। তখন আম্মা ব্যস্ত থাকেন। আমি সেই দিনগুলোতে মন ভরে সাঁতার কাটি। আব্বাকে একদিন বলতে শুনি,
-দুলারী, তুমি মেয়েটাকে বেশি বকাবকি করো! যা গেছে, গেছে; ভুলে যাও। মনে করে তুমি নিজেও কষ্ট পাও মেয়েটাকেও দাও।
-তোমার মেয়ে কি এসব বোঝে! ও গা গতরে বড় হইতেছে। বুদ্ধিশুদ্ধি কিছু হইছে না কি! ভয় ডরও নাই। পড়াশোনায়ও মন নাই!
তারা ফিসফিস করে আরও কী কী বলে। পাশের রুম থেকে ঘুমের ঘোরে আমি আর এসব শুনতে পাই না। বুঝিও না, তবে এটা বুঝি যে, তাদের দুজনেই আমাকে নিয়ে কোনো বিশেষ কষ্টে আছেন।
পাশের ঘরের বড় চাচার বড় ছেলে সেলিম ভাই এখন সৌদিতে থাকেন। আম্মা প্রতি রাতেই নামাজে বসে কাঁদেন, আর তাকে গজব দেন। তার ক্ষতি কামনা করেন। বদ দোয়া দিতে থাকেন, ‘আমার মেয়ের এত বড় সর্বনাশ যে করছে, আল্লাহ যেন তার বিচার করে।’ কী সর্বনাশ পরিষ্কার মনে করতে পারি না।
মাঝে মাঝে আব্বা আম্মাকে ধমকে দেন।
-চুপ কর দুলারী! এমন করে প্রতিদিন নামাজে বসে কাঁদবা না। মেয়েটা বুঝে ফেলবে। আম্মা আরও জোরে কাঁদেন। এক সময়ে কান্না থামিয়ে আমার শরীরে হাত বুলিয়ে আদর করেন। আমি ঘুমিয়ে যাই। ওদের কথা সারা রাত চলে। ওরা চান না আমি শুনি। আমি শুনি, আবার শুনি না; বুঝি, আবার বুঝি না। কিছুই গায়ে মাখি না।
কেমন করে যেন ক্লাস ফাইভে রোল নম্বর ৪ হয়ে গিয়েছিল। আম্মা কী যে খুশি! বাড়ির সবার খুশি বোঝা না গেলেও কেউ কেউ বেশ খুশি। আম্মার বয়সী ফুফুরা আদর করেন। তারা নিজেরা কথা বলেন, ‘দুলারী ভাবির মেয়ের হাত-পাগুলো ভালো। দেখছস, কী সুন্দর! কী সুন্দর গায়ের রং।’ এমন বলাবলি বাড়তে থাকে। আবার কেউ কেউ খালি ভুল খোঁজেন।
বাড়ির বড়রা আম্মাকে রাগের সুরে বলেন, ‘তোমার মেয়েকে লম্বা পায়জামা পরাও। আর যেন খালি ফ্রক পরা না দেখি। খালি ঠ্যাংয়ে যেন রাস্তা ঘাটে দৌড়াইতে না দেখি।’ আমার পরীক্ষা পাসের খুশি মিলিয়ে যায় মেয়ের উঠতি সৌন্দর্য ঢাকার চিন্তায়। মা আমার পড়াশোনার পাশাপাশি আমার গতর ঢাকতে ব্যস্ত থাকেন। নিত্যনতুন কৌশলে ফ্রক সেলাই করেন। কত রকমের; ঠিক কোন জায়গায় কুচি দিলে ফ্রক থেকে কিশোরী বুকে মানুষের নজর কম পড়বে, সেদিকে মনোযোগ দেন। আম্মা পায়জামা সেলাই করে দিলেন। সেখানেও ভারী কুচির ঢেউ। ভেতরে ছোট প্যান্ট; তার ওপর লম্বা পায়জামা। শক্ত ফিতায় গিঁট দিয়ে সব সময় পরে থাকার কথা বলেন। পরতে থাকলাম হাজারো ডিজাইনের কুচি দেওয়া জামা-পায়জামা। বড় হতে হতে গায়ে কাপড়ের সংখ্যা বাড়তে থাকল।
একটা সময় শুধু সাঁতার কাটার সময় পায়জামা খুলতে পারতাম। এখন তাও বন্ধ হতে গেল। আম্মার কড়া নিষেধ লম্বা পায়জামা ছাড়া হাঁটাচলা নিষেধ। লম্বা কুচিওলা পায়জামা পরে আর আগের মতো সাঁতারও কাটা হয় না। লম্বা পায়জামায় আটকে যেতে থাকে দৌড়ে বেড়ানোর দিন, আর সাঁতরে পুকুর পার হওয়ার শখ। বাঁধা পড়ে যায় চলনে বলনে। ছোট হতে থাকে মা-মেয়ের জগৎ। স্বপ্নগুলো বাস্তবতায় ঢেকে যায়।
ভারত সীমান্তঘেঁষা আমাদের এলাকা। মাঝে ছোট নদী, নাম খোয়াই। ওই পারে ভারতের আসাম রাজ্য, যার মানুষগুলো দেখতে আমাদের মতো। তারাও নাকি বাংলায় কথা বলে। এই পার থেকে তাদের বাস-কার, আরও ছোট ছোট যানবাহন চোখে পড়ে। অল্প দূরেই আমাদের বাংলাদেশ। আমাদের এদিকে শুধুই একটা ট্রেন। সকালে আর রাতে দু বেলা আসে-যায়। কেন এই পার্থক্য বুঝতে পারি না। এসব নিয়ে বড়রা কেউ গল্প করে না। কথা হয় শুধু কেউ মারা গেলে; তখন শুনি চোরাকারবারিরা কেমন করে মারা যায়। বাড়িতে মেহমান এলে আমরা নদীর পাড়ে বেড়াতে যাই। আম্মার কাছ থেকে অনেক অনুরোধ করে সবার সঙ্গে ঘুরতে যাওয়ার অনুমতি পাই।
একেবারে শেষের স্টেশনের মাঝামাঝি আমাদের বাড়ি। বাড়ির কিনার দিয়েই ট্রেন আসে-যায়। বড় বাঁশের বেড়া দিয়ে বাড়ির চারপাশ ঘেরা দেওয়া। তবে যারা ট্রেনের ছাদে বসে থাকে, তাদের বাড়ির ভেতর থেকে বাঁশের ঘেরার ওপর দিয়েও দেখা যায়। আমি ভাবি ওরা ট্রেনের ওপর থেকে পড়ে যায় না? কেমন করে ওরা বসে থাকে, আবার মাঝেমধ্যে হাঁটেও! আমি যদি একবার উঠতে পারতাম। এখানেও তো সব ছেলেরাই ওঠে। কোনো মেয়েকে তো দেখি না ছাদে উঠতে।
এই ট্রেন নির্দিষ্ট সময়ে কিছু লোক নামায়, আর কিছু লোক তুলে নেয়; এই তার কাজ। ট্রেন ড্রাইভারদের মুখ চেনা হয়ে গেছে। তারা তিন-চারজনই অদল-বদল করে ট্রেন চালায়। কয়লার ট্রেন। কিছু মানুষকে শুধু কয়লা দিতে দেখা যায়। কোথা থেকে এত লাল আগুনে কয়লা আসে কে জানে! খুব ভেতরে গিয়ে দেখতে মন চায়। যারা কয়লা নাড়াচাড়া করে, তারা সবাই দেখতে একই রকম। কেমন করে এই মানুষগুলো একরকম। দেখতে খুব কালো; শক্ত পেশিঅলা হাত। মাঝে কারও গায়ে হাতাকাটা গেঞ্জি পরা থাকে। খুব ভালো করে খেয়াল করলে বোঝা যায়, তাদের কারও কারও গায়ে ময়লা গেঞ্জি আছে। কিন্তু এদের সবার চেহারা একই রকম দেখতে কেন? আম্মাকে জিজ্ঞেস করছিলাম। আম্মা বললেন, ‘তারা অনেক পরিশ্রম করে। তাই এমন দেখায়। একই রকম কঠিন কাজ করলে মানুষ দেখতে একই হয়ে যায়।’ আমার কাছে আম্মার কথাকে রেডিওর মানুষের কথার মতো সত্য বলে মনে হয়। কিন্তু দ্রুতগামী ট্রেনের মানুষগুলোও আমার কাছে একই রকম লাগে কেন?
আমাদের এলাকায় দুইটা চা বাগান আছে। নলুয়াছড়া, আর সাতছড়া। চা বাগানে যারা কাজ করে ওদের কুলি-কামিন বলে। বাড়ির যত ভারী কাজ ওরাই করে দেয়। বিকেলে কুলি পুরুষ বাড়ি বাড়ি লাকড়ি বেচতে আসে। অনেক সময় ধান বা চাল দিয়ে ও লাকড়ি দিয়ে যায়। তাদের ধর্ম নাকি হিন্দু। ওরা বড় উৎসব করে; দুর্গা পূজা করে। অনেকে পূজা দেখতে যায়। আমি কোনো দিন পুজো দেখিনি। খুব দেখতে ইচ্ছা করে। আমাদের একটাই একমাত্র বাংলা স্কুল। একটা মাদ্রাসাও আছে। দু জায়গায় সমান-সমান শিক্ষার্থী। স্কুলের পাশ দিয়ে একটু দূরে একটা মণিপুরী পাড়া আছে। মণিপুরিরাও নাকি হিন্দু। ওরাও পূজা করে। মণিপুরী ছেলেমেয়ে সবাই স্কুলে আসে। তবে কোনো কুলির ছেলেমেয়ে স্কুলে আসে না। কুলিরা দেখতে খুব কালো। ওদের দেখতে ট্রেনের কয়লা দেওয়ার লোকেদের মতো লাগে। মণিপুরিরা দেখতে আমাদের চাইতেও সুন্দর। ওদের ছেলেমেয়েরা দেখতে সুন্দর। ওরা পড়াশোনায়ও ভালো।
স্কুলের সংখ্যা একটা হলেও পাড়ায় পাড়ায় মসজিদ অনেক। আজান হলে মেয়েরা সবাই মাথায় কাপড় দেয়। ছেলেরা মসজিদে যায়। আজান দিলে ছেলেরা মাথায় কাপড় দেয় না, এমনকি নামাজ পড়ার সময়ও সব ছেলেরা মাথায় টুপি দেয় না। আর মেয়েরা বাড়ির ভেতরে নামাজ পড়ে। আমারও ছেলেদের সঙ্গে লাইন ধরে কাতারে নামাজ পড়তে মন চায়। আম্মার সঙ্গে নামাজ পড়তে ভালো লাগে না। মেয়েদের নামাজের চৌকিটা কেমন জানি অন্ধকার জায়গায় রাখা। ছেলেরা কত সুন্দর লাইন ধরে আলোতে নামাজ পড়ে। কে করেছে এত নিয়ম? জানতে চাইলে আম্মা শুধু চুপ করতে বলে। একবার ছেলেদের নামাজ পড়া দেখতে মসজিদের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। নামাজরত কয়েকজন তা দেখে ফেলায় তারা আম্মাকে বেশ গালমন্দ করেছে। তারপর থেকে আমার হাঁটাচলার পথ আরও সংকুচিত হয়ে যায়।
একদিন আম্মা আবিষ্কার করেন আমি নাকি বড় হয়ে গেছি। তার জন্য আমার ওপর নেমে আসে আরও বেশি সতর্কতা। মাসের ওই কিছুদিন আম্মার হাতে তৈরি করা কাপড়ের ব্যান্ডেজ আমাকে পরে থাকতে হয়। ওই পাঁচ-সাত দিন আমাকে আম্মা ঘরবন্দী করে রাখেন। পরীক্ষা না হলে স্কুলেও যাই না। ঘরের পেছনে আম্মার কাজকর্ম দেখাই তখন আমার বড় কাজ। আম্মা বলেন, ‘বড় হতে হলে সবাইকে এমন কষ্ট করতে হয়।’
-আমি বড় হতে চাই না।
-তোমার আমার কথায় কি দুনিয়া চলে? কথাগুলো কেমন যেন শোনাত!
-তাইলে তুমিও কি বড় হতে চাও নাই আম্মা?
-কোনো উত্তর আসে না। আম্মা চুপ করে থেকে আপন মনে কাজ করেন।
-আম্মা আমি বড় হয়ে কী করব জানো?
-তুমি কী করবা তুমি জানো, আমি কী বলব!
-আমি জানি না। তবে অনেক দূরে চলে যাইতে চাই, যেখানে তোমরা কেউ থাকবা না।
-কি বললি আমিও না?
-নাহ শুধু আমি একা থাকব।
-ছোটবেলায় কী হইছিল আমার?
আম্মা ঘাবড়ে যান। জানতে চান, ‘কেন? কেউ কি কিছু বলছে?’
-নাহ্! তবে সবাই তো লুকিয়ে বলাবলি করে। বলে আমার সঙ্গে বড় চাচার ছেলে খারাপ কাজ করছে। আম্মা আমি নাকি বেশি দুষ্টু, তাই আমার সঙ্গে এমন হইছে। সামনে কেউ এসব বলে না। তবে আড়ালে বলে। তুমি আমাকে বন্দী করে রাখ কেন? তাই এই কয়দিন খুব এসব বেশি মনে পড়ে।
দিন গড়ায়। এক সময় মা আমাকে জামার ভেতরেও টাইট ছোট জামা পরান। দম বন্ধ হওয়া টাইট। কারণ, উদ্ধত বুক যেন মানুষের নজরে না আসে। জামা-কাপড়ে ঢাকতে থাকেন আমকে। এ নিয়েও আব্বা-আম্মার তর্ক হয়।
-দুলারী তুমি মেয়েটার শরীরের সৌন্দর্য নষ্ট করে দিতেছ।
আম্মা তীক্ষ্ণ নজর আমার সোজা সরল বাপের দিকে যায়। কঠিন কণ্ঠে জবাব দেন, ‘শোনো তুমি আমার মেয়ের দিকে নজর দিবা না। সব পুরুষ এক।’
আব্বা আর জীবনে এই সব নিয়ে কথা বলেন নাই।
জোর করে রোজ আরবি পড়তে নিয়ে যান। আমার বয়সী অন্যরা কোরআন শরীফ খতম করে ফেলেছে। আমি এখনো পড়ছি। হুজুরকে বলেছিলাম, ‘আরবি পড়তে ভালো লাগে না।’ হুজুর তা পুরা পাড়া রীতিমতো ওয়াজ করে জানিয়ে দিলেন। আম্মা মনে কষ্ট পাইলেন ঠিকই, তবে আমাকে তেমন কিছু বলেন নাই। হুজুর সপ্তাহে একদিন আমাদের ঘরে খাবার খান। তখন হুজুরকে বললেন, ‘বাচ্চা মানুষে একটা কথা বলছে আপনি আমাকে বলতে পারতেন। আস্তা পাড়া বলবার দরকার ছিল না।’ পরে আম্মা আমার জন্য নিচে ছোট বাংলায় তরজমাসহ আরবি কোরআন শরিফ আনিয়ে দিলেন। পড়তে শুরু করলাম। হুজুর খুশি, আম্মাও খুশি। আম্মার ওই আহ্লাদের কারণে আমার আর আরবি পড়া শেখা হয় নাই। আম্মাই বলছিলেন আল্লাহকে মন থেকে ডাকতে হয়। আরবি একটা ভাষা। ওটা মুখ্য বিষয় না। কোরআন বুঝে পড়া হলো আসল। আবার আম্মাকে রেডিওর খবর পড়া ওদের মতো মনে হয়।
শক্ত কঠিন বক্ষবন্ধনীর ভেতরে আটকে যায় আমার কিশোরীবেলা। খোলা চুল আটকে পড়ে শক্ত দুই বেণির লাল ফিতায়। খেলাধুলা দৌড়ঝাঁপ বন্ধ হতে থাকে মায়ের কড়া নজরে। ছোট হতে থাকে জীবনের চলার পথ। বেশির ভাগ সময় ঘরে বসেই পাখির কলকলানি শুনি। মন চাইলেই আর ফড়িংয়ের পেছনে ছোটা হয় না। সাপের খেলা দেখতে বেদের দলের সঙ্গে চলে যাওয়ার পথ বন্ধ হয়ে যায়। বোতল খুঁজে নিয়ে কটকটি চকলেট খাওয়া হয় না।
বড় হতে হতে আমি চুপচাপ শান্ত হতে থাকি। আমি যতই বড় হই, মানুষের কানাঘুষা ততই বাড়তেই থাকে। ছোটবেলার দুর্ঘটনার গল্প আত্মীয়, পাড়া-প্রতিবেশীর মুখে মুখে। আমার তেমন কিছু মনে নাই। তবে আমার সঙ্গে বড় অন্যায় হয়েছিল বলে কেউ কেউ বলে। আমি ভাবতে থাকি পাঁচ বছর বয়সের কথা। তেমন খোলাসা কিছু মনে পড়ে না। বড় চাচার ছেলে সেলিম ভাই তখন ক্লাস নাইনে পড়ত। সে-ই বলছিল, ‘কিছু হবে না। আমি তোকে এক দিনে বড় করে দিব।’ আমার ওই সময় থেকেই বড় হওয়ার শখ ছিল। আমি নাকি চিৎকার করে কান্না করছিলাম। আম্মা সেই দিন বাড়িতে ছিল না। মাসে একদিন ডাক্তার আসে বাজারে। তাও প্রতি মাসে আসে না। আম্মা নিজের অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ওষুধ আনতে গিয়েছিলেন আমাকে চাচির কাছে রেখে। তারপর এসে জানেন সবকিছু। হালকা মনে আছে আম্মার কান্নায় আকাশ-বাতাস ভারী হয়েছিল। আমার জন্য কোনো ডাক্তার আনা হয় না। আব্বা ইন্ডিয়া থেকে ওষুধ আনেন, আর কাঁদেন। আব্বার সঙ্গে বাড়ির মুরুব্বিরা কী সব পরামর্শ করেন। আব্বা আম্মাকে সান্ত্বনা দেন। আম্মার কান্না থামে না। আমাকে নিয়ে নানার বাড়ি চলে যেতে চান।
শুনেছি চাচাতো বড় ভাইকে সেই রাতেই ঢাকায় এবং পরে দেশের বাইরে পাঠানো হয়। আমি ভুলে গেছি ওই দিনগুলির কথা। আম্মা বলছে কেউ কিছু বললে কান না দিতে। এখন আম্মার সঙ্গেই আমার সখ্য। সারা দিন আম্মার পেছনে পেছনে ঘুরি। আম্মা কাজ করে চোখেমুখে প্রশান্তি নিয়ে। আমি স্বপ্ন দেখি, বড় হয়ে সবাইকে ছেড়ে ছুড়ে অনেক দূর চলে যাওয়ার।
বাবা ছুটিতে আসেন। মা-মেয়েকে কাছাকাছি দেখে খুশি হন। তিনিও কম বাইরে বের হন। আমার কেন জানি আব্বা-আম্মা কাউকেই আপন লাগে না। ওদেরকে ভালো লাগে না। আমার পুকুরে সাঁতার দিতে মন চায়। ট্রেনের আগুন দেখতে মন চায়। ওদের মতো ট্রেনের ছাদে বসতে মন চায়। আব্বা একদিন আম্মাকে একটা ছোট্ট রেডিও এনে দিয়ে বলেন, ‘তোমরা মা-মেয়ে এতে গান শুনবে।’
আম্মা আর রহিমা বুয়া অনুরোধের আসর শোনে। নাটক আর গান শোনে; খুব অল্প ভলিউমে। আমার রেডিওর গান শুনতে ভালো লাগে না। তবে রহিমা বুয়ার গলায় গান শুনতে ভালো লাগে। রেডিওর চাইতে রহিমা বুয়ার গলার গান বেশি সুন্দর। আমার খবর শুনতে ভালো লাগে। আর খবর শুরু হলেই তারা রেডিও বন্ধ করে দেয়। রেডিও আলমিরার ওপরে তুলে রাখে। তাই আমি কিছুই শুনি না।
আম্মা বলেন, ‘খবরে কিছু নাই। সব খারাপ খবর।’
-আমি বলি শেখ মুজিব কে?
-উনি বড় নেতা দেশ স্বাধীন করছেন। তবে হারামিরা ওনারে পরিবারসহ গুলি করে মেরে ফেলছে।
-কারা হারামি
-বড় হলে চিনবি, আম্মা বলেন।
একদিন বাড়ির সবাই মন দিয়ে রেডিও শোনে কাকে যেন মেরে ফেলছে। বাড়ির ছেলেরা সব এক হয়ে গল্প করে। আম্মাকে বলি, ‘জিয়াউর রহমানকে গুলি করে মেরে ফেলছে।’ হতাশ হয়ে উত্তর দেন, ‘হ্যাঁ, দেশটায় কী যেন হইছে। খালি মরার খবর।’ বলেই রেডিও দেন বন্ধ করে।
একদিন আম্মা খবর পান সেলিম ভাই দেশে আসছে। ঢাকায় ফুফুর বাসায় উঠেছে। তাকে এবার বিয়ে করাবে। তার ইচ্ছা আমাকে বিয়ে করার। বাড়ির মুরুব্বিরা এতে খুশি হলেন। শুধু আমি সেভেনে পড়ছি বলে একটু আপত্তি। মেয়েটা আরেকটু বড় হোক। তারপর দুজনের বিয়ে দিলে সুন্দর হবে। দুলারীকে মেয়ে নিয়ে আর চিন্তা করা লাগবে না। বিষয়টা আম্মা ছাড়া সবাই মেনে নিল। আব্বাকেও নিমরাজি মনে হলো। আম্মা আব্বাকে বলে দিলেন, ‘যদি ওই শয়তানের সঙ্গে আমার বাচ্চা মেয়ের বিয়ের কথা আবার তোমার মুখে শুনি, তাহলে মেয়ে নিয়ে আমি ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিব।’ আব্বা যা বোঝার বুঝে গেলেন। বাড়ির বড়দের বোঝানোর চেষ্টা করলেন, ‘দুলারীর এই বিয়েতে মত নাই। ও চায় মেয়েকে পড়াতে।’ মুরব্বিরা আব্বাকে বলেন, ‘তুমি বউয়ের কথায় কান দিয়ো না।’
-আম্মা আমাকে বিয়ে দিয়ে দাও!
-কী বললি! তোকে বিয়ে দিয়ে দিব!
-হ্যাঁ। বিয়ে দিয়ে দাও।
-তুই বিয়ের কী বুঝস?
-কেন সিমা, সুফিয়া, রেখা ওদের তো বিয়ে হইছে। আমারও হোক।
শুনে আম্মা রেগে কেঁদে দিলেন।
-এই মেয়ে, তুই বিয়ে করবি? হ্যাঁ? তাহলে পড়ালেখা কে করবে? আর তুই ওই শয়তানকে বিয়ে করবি?
-একদিন তো বিয়ে করতেই হবে। যেকোনো একজনকে করলেই হয়। আর বলেছি তো আমার পড়তে ভালো লাগে না।
শুনে জোরে দুই গালে চড়-থাপ্পড় দিতে থাকেন, আর বিলাপ করতে থাকেন আমার আম্মা।
এর কিছুদিন পর বাড়িতে বড় বৈঠক হলো। দিন-তারিখ না। শুধু আমি আরও বড় হলে, আমার বিয়ে হবে তার সঙ্গে; এইটুকুই পাকা হলো। ঠিক তার পরের দিন রাতের ট্রেন আসার শব্দ শুনতেই আম্মা একটা ছোট পোঁটলা বুকের ভিতরে ঢুকিয়ে নিয়ে আমাকে টান দিয়ে ঘর থেকে বের করে নিলেন। পেছনের বাঁশঝাড়ের ভেতরে দিয়ে পুকুরপাড় হয়ে রেললাইন ধরে বড় বড় পা ফেলে স্টেশনের দিকে এগোতে থাকলেন। বের হওয়ার সময়ে রহিমা বুয়াকে কানে কানে কী যেন বললেন। আমি ধরেই নিয়েছিলাম আম্মা নিশ্চিত ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিতেই যাচ্ছেন। ওই দিন আব্বাকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলেন, মনে পড়ে গেল। খালি পায়ে আম্মার পেছনে হাত ধরে দৌড়াচ্ছি। আম্মা ভুলে গেলেন আমি আজকে শুধু ফ্রক পরা। ভাবছি ট্রেন থেকে ঝাঁপ দিতে মনে হয় পায়জামা পরা লাগে না। পায়জামার কথা আমার মনে পড়লেও আম্মাকে মনে করিয়ে দিলাম না।
মা-মেয়ে মিলে স্টেশনের দিকে দৌড়াতেই থাকলাম। এক সময় ট্রেন এল। আম্মা হেঁচড়া টানে বগির ভেতরে উঠে গেলেন। জানালায় হেলান দিয়ে দূরে অন্ধকারে তাকিয়ে রইলেন। আমি আম্মার কোলে মাথা রেখে পা দুটা ভাঁজ করে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকলাম। ফ্রক বাতাসে উড়ছে, আমার কাপড়ের দিকে কোনো খেয়ালই করলেন না আম্মা। মনে মনে ভাবছি আম্মা মনে হয় অন্ধকারে ট্রেন চলতে শুরু করলে আমাকে নিয়ে লাফ দেবেন। দুজনে মরে যাব। তাই জামা-কাপড়ের দিকে তাঁর নজর নেই।
অন্ধকারে রাতের ট্রেন চলতে শুরু করল। সেই যাত্রা আজও থামেনি!