সেপ্টেম্বর থেকে সেপ্টেম্বর, তালেবানের জয়–ক্ষয়

মজার বিষয় হলো, তালেবানের উত্থান-পতনের সঙ্গে কাকতালীয়ভাবে গ্রেগরীয় সেপ্টেম্বর মাস বারবার জড়িয়ে যাচ্ছে। যেমন এর প্রতিষ্ঠা, হেরাত দখল, প্রথম দফায় সরকার গঠন, নাইন–ইলেভেন ও ২০ বছর পর আবার ক্ষমতায় এসে ‘সরকার’ ঘোষণা। হয়তো আরেক কোনো সেপ্টেম্বরে তালেবানকে কেন্দ্র করে বিশ্ব নতুন কিছু দেখবে।

মোল্লা মোহাম্মদ ওমর। ছবি: এএফপি

তালেবান পশতু শব্দ, যার বাংলা অর্থ ছাত্র। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে আফগানিস্তান থেকে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সেনাদের প্রত্যাহারের সময়ই তালেবান নামের সংগঠনটির জন্ম। সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতাদের প্রায় সবাই দেশটির সুন্নি মতাদর্শের মাদ্রাসার শিক্ষার্থী।

আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের তথ্যমতে, তালেবানের বাড়তি শক্তি তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতীয়তাবাদী ধারা। আর তা হলো আফগানিস্তানের পশতুন অঞ্চলকে ঘিরে, যার বিস্তৃতি প্রতিবেশী পাকিস্তান পর্যন্ত। দক্ষিণ-পশ্চিম আফগানিস্তান থেকে সশস্ত্র এই সংগঠন দ্রুততার সঙ্গে প্রভাব বিস্তার করে। ১৯৯৪ সালের সেপ্টেম্বরে মোল্লা মোহাম্মদ ওমর নিজ শহর কান্দাহারে ৫০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন।

এরপর ১৯৯৫ সালের সেপ্টেম্বরে তালেবান ইরান সীমান্তবর্তী প্রদেশ হেরাত নিয়ন্ত্রণে নেয়। ঠিক এক বছরের মাথায় ১৯৯৬ সালের সেপ্টেম্বরে রাজধানী কাবুল দখলের মধ্য দিয়ে তারা আফগানিস্তানের ক্ষমতায় আসে। মজার বিষয় হলো, তালেবানের উত্থান-পতনের সঙ্গে কাকতালীয়ভাবে গ্রেগরীয় ক্যালেন্ডারের সেপ্টেম্বর মাস বারবার জড়িয়ে যাচ্ছে। যেমন এর প্রতিষ্ঠা, হেরাত দখল, প্রথম দফায় সরকার গঠন, নাইন–ইলেভেন ও ২০ বছর পর আবার আফগানিস্তান নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ‘সরকার’ ঘোষণা।

তালেবান-মুজাহিদীন

তালেবানের হাতে পতন হওয়া প্রেসিডেন্ট বুরহানউদ্দিন রাব্বানি ছিলেন আফগান মুজাহিদীন বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। আশির দশকে সেখানে সোভিয়েত সেনাদের বিরুদ্ধে এই যোদ্ধারা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। কিন্তু আফগানিস্তানে সোভিয়েত সেনা প্রত্যাহারের পর খোদ মুজাহিদীনের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এমন অবস্থায় তালেবান দৃশ্যপটে চলে আসে। সরকার গঠন–পরবর্তী ১৯৯৮ সাল নাগাদ তালেবান আফগানিস্তানের প্রায় ৯০ শতাংশ এলাকায় নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারে বলে বিবিসির এক নিবন্ধে উঠে আসে।

হামলার পর জ্বলছে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের দুটি টাওয়ারই
ফাইল ছবি: রয়টার্স

মুজাহিদীন সদস্যদের বাড়াবাড়ি ও অন্তর্দ্বন্দ্বে ক্ষমতায় আসা তালেবানকে আফগানরা মোটাদাগে বলতে গেলে স্বাগত জানিয়েছিল। এর পেছনে বাড়তি কারণ হিসেবে ছিল, দুর্নীতি দমনে তাদের সাফল্য, সামাজিক শৃঙ্খলা, নাগরিকদের নিরাপদ ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ করে দেওয়া। তবে একই সঙ্গে তালেবানের জারি করা কঠোর শরিয়াহ শাসনও অনেক আফগানকে ভীতসন্ত্রস্ত করে তোলে। প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড, অপরাধীকে পাথর নিক্ষেপ, চুরির মতো অপরাধে হাত কেটে নেওয়া, পুরুষদের দাড়ি রাখা ও মেয়েদের বোরকা-হিজাব পরা বাধ্যতামূলক করার মতো বিষয়গুলোর কারণে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ে তাদের শাসন নিয়ে প্রশ্ন উঠতে থাকে। এ ছাড়া টেলিভিশন, সংগীত ও সিনেমাও নিষিদ্ধ করেছিল তালেবান। ১০ বছরের বেশি বয়সী মেয়েদের বিদ্যালয়ে যাওয়ার ওপরও নিষেধাজ্ঞা ছিল সে সময়। এসব পদক্ষেপের কারণে আধুনিক বিশ্বে তালেবান সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণার জন্ম হয়।

আল–কায়েদা-তালেবান সম্পর্ক

২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে হামলার পর আন্তর্জাতিক মনোযোগের কেন্দ্রে আসে তালেবান। ওই ঘটনার প্রধান সন্দেহভাজন ওসামা বিন লাদেন ও তাঁর সংগঠন আল-কায়েদাকে তালেবান আফগানিস্তানে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। এর পরিপ্রেক্ষিতে মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোট ২০০১ সালের ৭ অক্টোবর সেখানে অভিযান শুরু করে। ওই বছরের ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে তালেবান সরকারের পতন ঘটে।

বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০১ সালে সরকার পতনের পর তালেবানের তৎকালীন নেতা মোল্লা ওমর, অন্যান্য জ্যেষ্ঠ নেতা ও আল–কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেন পালিয়ে যান। এরপর তালেবানের অনেক নেতা পাকিস্তানের কোয়েটায় আশ্রয় নেন ও সেখান থেকে আফগানিস্তানে সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে আসছিলেন বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়। যদিও পাকিস্তান বরাবরই তালেবানকে আশ্রয়-প্রশয় দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।

আল–কায়েদাও নতুন কোনো সংগঠন নয়। এটি আসলে একটি নেটওয়ার্ক। সৌদি ধনকুবের ওসামা বিন লাদেনের হাত ধরে আশির দশকে গড়ে ওঠা আল–কায়েদা সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নবিরোধীদের সমরাস্ত্র ও লজিস্টিক–সহায়তা দিত। সেই সূত্রেই আল–কায়েদার সঙ্গে আফগান মুজাহিদীন ও তালেবানের জড়িয়ে যাওয়া।

কাবুলে বিক্ষোভে নারীরা।
ছবি: এএফপি

তালেবানের নতুন সূচনা

২০ বছরের যুদ্ধ, লাখো প্রাণহানি এবং সর্বশেষ মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে দর–কষাকষি শেষে আবারও কাবুলের মসনদে তালেবান। গত ১৫ আগস্ট তারা কাবুল নিয়ন্ত্রণে নেয়। এর মধ্যেই আফগানিস্তান ত্যাগ করেন প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি। ৭ সেপ্টেম্বর তালেবান তাদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ঘোষণা দেয়। এতে তাদের প্রতিষ্ঠাকালীন নেতাসহ জ্যেষ্ঠ অনেক নেতা বিভিন্ন পদে রয়েছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদে রয়েছেন হাক্কানি নেটওয়ার্কের প্রতিষ্ঠাতা সিরাজুদ্দিন হাক্কানি। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা এফবিআইয়ের ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ তালিকায় রয়েছেন।

কাবুলের ক্ষমতায় তালেবানের প্রত্যাবর্তন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের উগ্রবাদী সংগঠনগুলোকে অক্সিজেন দিচ্ছে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে দাবি করা হয়েছে।

বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, তালেবানের পুনরুত্থানে ইয়েমেন, সোমালিয়ায় রীতিমতো উৎসব করেছে অনেকে। অনেক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, আফগানিস্তানে তালেবানের জয়ের ফলে মধ্যপ্রাচ্য ও মধ্য এশিয়ায় উগ্র মতাদর্শের নতুন যুগের সূচনা ঘটতে পারে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় হুমকি হয়ে উঠতে পারে আল-কায়েদা ও ইসলামিক স্টেট (আইএস) এবং এই দুই জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীগুলো। অবশ্য তালেবান ঘোষণা দিয়েছে, তারা আফগানিস্তানের মাটি কোনো উগ্রপন্থীর জন্য ব্যবহৃত হতে দেবে না।

[তথ্যসূত্র: বিবিসি, সিএনএন, আল–জাজিরা, এএফপি ও রয়টার্স]