স্নায়ুযুদ্ধ ফিরে আসার বছর!
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পর। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনে ইতি ঘটে সেই স্নায়ুযুদ্ধের। তৈরি হয় এককেন্দ্রিক বিশ্ব, যার নিয়ন্ত্রণ পায় যুক্তরাষ্ট্র। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সবচেয়ে বড় অংশটিই ছিল রাশিয়া। যার হাতেই ছিল বিশাল সোভিয়েত ইউনিয়ন নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠি।
সেই রাশিয়ার সঙ্গে আবার মুখোমুখি যুক্তরাষ্ট্র। বেশ কয়েক বছর ধরেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে নানাভাবে পরোক্ষ বা প্রচ্ছন্নভাবে লড়াইয়ে মুখোমুখি হয়েছে ওয়াশিংটন ও মস্কো। তবে ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেন-সংকটের সময় একেবারেই মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যায় দেশ দুটি। আর চলতি বছরের শেষের দিকে সিরিয়া-সংকট ঘিরে দেশ দুটির অবস্থান দাঁড়ায় সাংঘর্ষিক পরিস্থিতিতে। তাই প্রশ্ন উঠেছে, সেই স্নায়ুযুদ্ধ কি ফিরে এল?
যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক রবার্ট লেগভোল্ডের মতে, ‘আমি মনে করি, নতুন স্নায়ুযুদ্ধ ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে...তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলোর সম্পর্কের বৈশিষ্ট্য আজকের রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলোর সম্পর্কের বৈশিষ্ট্য মিলে যায়।’
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার প্রচ্ছন্ন লড়াই দেখা গেছে বেশ কিছু ইস্যুতে। ২০০৭ সালে পোল্যান্ডে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা মোতায়েনের ঘোষণা, ২০০৮ সালে জর্জিয়ায় বিচ্ছিন্নতাবাদী ও সরকারের পক্ষ নিয়ে দুই দেশের অবস্থান, ২০১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের গোপন নথির তথ্য ফাঁসকারী মার্কিন নাগরিক এডওয়ার্ড স্নোডেনকে রাশিয়ায় আশ্রয় দেওয়ার ইস্যুগুলোতে মস্কো-ওয়াশিংটনের ভিন্ন অবস্থানে দেশ দুটির পরোক্ষ লড়াই দেখা গেছে।
ইউক্রেনে রুশপন্থী প্রেসিডেন্ট ভিক্তর ইয়ানুকোভিচের পতনের পর ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে এত দিন ইউক্রেনের সঙ্গে থাকা দ্বীপ ক্রিমিয়া দখল করে নেয় রাশিয়া। যুক্তরাষ্ট্র একে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন উল্লেখ করে তীব্র নিন্দা জানায়। মূলত তখন থেকেই যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া সম্পর্কে প্রকাশ্য তিক্ততা শুরু হয়। ইউক্রেন-সংকটকে ঘিরেই দফায় দফায় রাশিয়ার বিভিন্ন স্তরের নেতা ও সরকারি কর্মকর্তাদের ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। কিছু ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক বিধি-নিষেধও আরোপ করে। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন দুই দেশের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যেতে পারে বলে হুমকি পর্যন্ত দেন। ২০১৪ সালের ১৬ জুলাই তিনি বলেন, এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা দুই দেশের সম্পর্ক ‘শেষ করে’ দিতে পারে।
ইউক্রেন-সংকট নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়ার মুখোমুখি অবস্থানের মধ্যেই ২০১৪ সালের ১৭ জুলাই ইউক্রেনে মালয়েশিয়ার এয়ারলাইনসের একটি বিমান ভূপাতিত করা হয়। এতে ২১৮ আরোহীর সবাই নিহত হন। নিরপেক্ষ বিভিন্ন সূত্র থেকে বলা হয়, ইউক্রেনে রুশপন্থী বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রিত এলাকা থেকে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে ওই বিমান ভূপাতিত করা হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, রাশিয়ার তৈরি ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে বিমানটি ভূপাতিত করা হয়েছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার ভূমিকার জবাবে মার্কিন প্রেসিডেন্টের নির্বাহী আদেশে রুশ কিছু রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। বিপরীতে ইউক্রেন সরকারকে অর্থ, অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম সহায়তা দেয়। তখন থেকেই পর্যবেক্ষকেরা বলা শুরু করেন, ইউক্রেন-সংকটের মধ্য দিয়ে ১৯৯১ সালের পর রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক সবচেয়ে তিক্ত অবস্থায় পৌঁছাল।
২০১৪ সালে ইউক্রেন-সংকটকে কেন্দ্র করে রুশ-মার্কিন প্রকাশ্য তিক্ত সম্পর্কের সেই শুরুটা ২০১৫ সালে যেন ষোলোকলা পূর্ণ করল। সিরিয়া-ইস্যুতে একেবারে বিপরীত অবস্থান নিল দেশ দুটি। ২০১৪ সাল থেকেই সিরিয়ায় ইসলামিক স্টেটবিরোধে (আইএস) অভিযানের অংশ হিসেবে বিমান হামলা শুরু করেছে মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোট। এই জোট দেশটির প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে হটাতে দেশটির সরকারবিরোধী বিদ্রোহীদেরও নানাভাবে সহায়তা দিয়ে আসছে। কিন্তু চলতি বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর ওই জোটের বিপরীতে অবস্থান নিয়ে আইএসবিরোধী অভিযানের নামে সিরিয়ায় বোমা হামলা শুরু করে রাশিয়া। অক্টোবরের মাঝামাঝি সময় রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ সরাসরি এটাও জানিয়ে দেন, বাশার সরকারের সমর্থন দিতেই মস্কো এই অভিযান চালাচ্ছে।
রাশিয়ার অভিযান শুরু হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র বারবার অভিযোগ তুলছিল, রুশ যুদ্ধবিমানগুলো যতটা না আইএসের অবস্থান লক্ষ্য করে বোমা ফেলছে, তার চেয়ে বেশি বোমা ফেলছে বাশারবিরোধী বিদ্রোহীদের ঘাঁটি লক্ষ্য করেই। যদিও এই অভিযোগ রাশিয়া বরাবরই অস্বীকার করছে।
মস্কো সবচেয়ে বড় চমকটি দেয় সিরিয়ার প্রেসিডেন্টকে রাশিয়ায় সফরে এনে। গত অক্টোবরে অঘোষিত সফরে ক্রেমলিনে গিয়ে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করেন বাশার। সিরিয়ায় ফিরে যাওয়ার পর তাঁর সফরের বিষয়টি প্রকাশ করা হয়। ওই সফরের তীব্র নিন্দা জানায় যুক্তরাষ্ট্র।
যদিও সাংঘর্ষিক এমন পরিস্থিতির মধ্যেও সিরিয়ার আকাশে রুশ ও মার্কিন বিমানের সংঘর্ষ এড়াতে সমঝোতায় পৌঁছতে সক্ষম হয় ওয়াশিংটন ও মস্কো। আরও কয়েকটি দেশের অংশগ্রহণে অক্টোবর ও নভেম্বরে অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায় সিরিয়া নিয়ে শান্তি আলোচনায় বসে দেশ দুটি। যদিও প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের ক্ষমতায় থাকা না-থাকা নিয়ে রুশ-মার্কিন পক্ষের ভিন্ন অবস্থানে থাকায় এসব আলোচনায় কোনো ফল আসেনি।
তবে ১৬ ডিসেম্বর মস্কোয় রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে তিন ঘণ্টার বৈঠকে অংশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কিছুটা নমনীয় হওয়ার কথা তুলে ধরেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট পদে বাশার আল-আসাদের থাকা না-থাকার বিষয়টি সে দেশের জনগণই নির্ধারণ করবেন—রাশিয়ার এই পুরোনো দাবি আপাতত মেনে নেয় যুক্তরাষ্ট্র। তবে ভবিষ্যতে বিষয়টি কোন দিকে মোড় নেয়, তা দেখতে অপেক্ষা করতেই হবে।
ইউক্রেন-সংকটের সময় ২০১৪ সালের ২৬ মার্চ প্রেসিডেন্ট ওবামা অবশ্য নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধে জড়ানোর বিষয়টি নাকচ করে দিয়েছিলেন। তবে সেই নাকচ করার সঙ্গে রাশিয়াকে ‘ছোট’ করে দেখার বিষয়টিও ছিল। ওবামা বলেছিলেন, রাশিয়া সেই সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো নয়। সোভিয়েতের মতো বিশ্বের কোনো ব্লকের নেতৃত্বে নেই রাশিয়া। কোনো আদর্শগত নেতৃত্বেও নেই। রাশিয়া এখন বড়জোর প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্য হুমকি হতে পারে। সেই ওবামা কিন্তু এবার আর তেমন কথা বলেননি। সিরিয়ায় যখন রাশিয়া অভিযান চালাল, তখন মস্কোর এই অভিযানকে ‘মহাদুর্যোগের মাল-মসলা’ বলে আখ্যা দেন ওবামা। শুধু তা-ই নয়, মস্কোর অভিযানের পর থেকে নানা তৎপরতায় ব্যতিব্যস্ত হতে দেখা যায় ওবামা প্রশাসনকে।
সব মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া এখন যে জায়গায় পৌঁছেছে, তাতে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক রবার্ট লেগভোল্ডের ‘নতুন স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে’—মতের সঙ্গে একমত হওয়ার লোকের অভাব হবে না।