স্বজন হারানোর ক্ষত সহজে ভোলার নয়

করোনাভাইরাস
প্রতীকী ছবি

দিন, সপ্তাহ, মাস পেরিয়ে ইতিহাস থেকে বিদায় নিল ২০২০ সাল। তবে রেখে গেছে স্বজন হারানোর ক্ষত। এমন মৃত্যুর মিছিল হতবিহ্বল করে তুলেছে স্বজনহারা মানুষকে। প্রিয়জন হারানোর পাহাড়সম কষ্ট বুকে নিয়ে বছর পার করেছে তারা। আর এই কষ্ট সবচেয়ে বেশিই অনুভূত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে।

করোনাভাইরাস যে কতটা ভয়ংকর হয়ে এসেছে, সেটি যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের মতো এতটা কেউ জানে না। প্রায় ৩ লাখ ৫০ হাজার মৃত্যু দিয়ে শেষ হচ্ছে অভিশপ্ত বছরটি। আর এই ক্ষত লেগেছে যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশি কমিউনিটিতে। মৃত্যুর এই দীর্ঘ মিছিলটি ২০২১ সালে কত হবে, সেটাও অজানা!

যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বাংলাদেশিদের জন্য বছরটি ছিল অন্যরকম। শুধু করোনা ক্ষত-বিক্ষত করেনি, সঙ্গে ছিল আরও কিছু নির্মম দুর্ঘটনা। করোনা ক্ষতের সঙ্গে ছিল রাইড শেয়ারিং অ্যাপ পাঠাওয়ের সহপ্রতিষ্ঠাতা এবং বিনিয়োগকারী ফাহিম সালেহ হত্যাকাণ্ড, সড়ক দুর্ঘটনায় এক পরিবারের দুই ভাইয়ের করুন মৃত্যুর মতো ঘটনা।

মহামারি করোনায় অনেক পরিবার হারিয়েছে একাধিক সদস্য। ভাইরাস কেড়ে নিয়েছে বাংলাদেশি চিকিৎসক, ব্যবসায়ী, মুক্তিযোদ্ধা, প্রকৌশলী, আইনজীবী, শিক্ষক, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, সমাজসেবীসহ নানা শ্রেণিপেশার মানুষ। এ ছাড়া অনেক পরিবার হারিয়েছেন পিতা-পুত্র, স্বামী-স্ত্রী, আদরের সন্তানকেও। আবার কেউ হারিয়েছেন বাড়ির একমাত্র উপার্জনকারী। গত মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ১০ মাসে করোনায় ৪৩০ জনের বেশি প্রবাসী বাংলাদেশির মৃত্যুর হয়েছে। শুধু নিউইয়র্কে মৃত্যু হয়েছে ৩০০ জনের বেশি। এত মৃত্যু প্রবাসী বাংলাদেশিরা আগে কখনো দেখেনি!

কমিউনিটি নেতা, সামাজিক সংগঠন, মসজিদ, মন্দির, গির্জা ও বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্র থেকে এই সংখ্যা পাওয়া গেছে।

এদিকে করোনার প্রথম ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে না উঠতে দ্বিতীয় ঢেউয়ে নতুন করে বিপর্যস্ত গোটা কমিউনিটি। নিউইয়র্কসহ বিভিন্ন রাজ্যে প্রবাসী বাংলাদেশিরা আক্রান্ত হচ্ছেন। তবে করোনার প্রকোপ সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি অধ্যুষিত রাজ্য নিউইয়র্ক, মিশিগান আর ক্যালিফোর্নিয়ায়। এই তিন রাজ্যের অবস্থা সবচেয়ে নাজুক।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, কমিউনিটির অনেকেই করোনায় মৃত্যু গোপন রাখতে চান, যার ফলে মৃত্যু বা আক্রান্তের সঠিক হিসাব পাওয়া কঠিন। কমিউনিটি অ্যাকটিভিস্টরা মৃত্যুর এই সংখ্যা আরও অনেক বেশি হবে বলে মনে করেন।

এদিকে করোনার টিকা শুরু হলেও থেমে নেই মৃত্যুর মিছিল। প্রথম ধাপে ভ্যাকসিন পাচ্ছেন চিকিৎসক, নার্সসহ যারা সম্মুখসারিতে কাজ করা কর্মীরা। সাধারণ মানুষের জন্য সহজলভ্য হতে কয়েক মাস সময় লাগবে। তারপরও ভ্যাকসিন নিলেই কোভিড-১৯ থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে, সেটা এখনো নিশ্চিত নয়।

যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী বাংলাদেশিদের ‘আমব্রেলা সংগঠন’ হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ সোসাইটির সভাপতি কামাল আহমেদ, সহসভাপতি আবুল খায়ের ও কার্যকরী সদস্য বাকির আজাদ, প্রবাসের অন্যতম সামাজিক সংগঠন চট্টগ্রাম সমিতি ইউএসএর সভাপতি আবদুল হাই (জিয়া), ছাতক সমিতি ইউএসএর সাবেক সভাপতি ও নিউইয়র্কের ব্রঙ্কসের স্টার্লিং বাংলাবাজার বিজনেস অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট গিয়াস উদ্দীন, বাংলাদেশি-আমেরিকান বংশোদ্ভূত চিকিৎসক মো. ইফতেখার, ডা. শামীম আল মামুন, ডা. কাজী জিয়াউদ্দিন আহমেদ, ডা. কাজী জিয়াউদ্দিন আহমেদ, নর্থ ক্যারোলিনায় রালেয় নগরে বসবাসরত বাংলাদেশি চিকিৎসক তাসলিম আহমদ, নিউইয়র্কের লং আইল্যান্ডের নর্থ শোর এলএইজের প্যাথলজিক্যাল বিভাগের ভাইস চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন অব নর্থ আমেরিকার সাবেক সভাপতি ডা. তৌফিকুল ইসলাম, ফটোসাংবাদিক এ হাই স্বপন, সংগীতশিল্পী বীনা মজুমদার, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ ইউএসএর সাধারণ সম্পাদক বিদ্যুৎ দাস, ডা. রেজা চৌধুরী, মোস্তফা আল্লামা, জ্যামাইকা বাংলাদেশ ফ্রেন্ডস সোসাইটির সভাপতি মোহাম্মদ ফখরুল ইসলামের শ্বশুর প্রবীণ প্রবাসী আবদুস সালাম খান প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে হারিয়ে শোকে কাতর নিউইয়র্কের বাংলাদেশি কমিউনিটি।

এ ছাড়া মৃত্যুর তলিকায় আছেন দুদু মিয়া, গোলাম রহমান, কামরুজ্জামান, লুৎফুর রহমান, মাদারিস আলী, মোহাম্মদ জাফর, মনির উদ্দিন, মন্তাজ খান, পেয়ারা হোসেন, রাশিদা আহমেদ, রওশন আরা ফেরদৌস, এস দুদু, শাহানা আহমেদ তালুকদার, সানাউর আলী, শামীম খান, আমানুল হক, শহীদুল হায়দার, দুই ভাই সাইফুর হায়দার খান ও শফি হায়দার, শিপন আহমেদ ও ইকবাল হক ভূঁইয়া প্রমুখ।

বিগত ডিসেম্বরে মিশিগানে নিজ বাসায় মারা যান মুক্তিযুদ্ধকালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক জন্মভূমি পত্রিকার সম্পাদক বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর ও আশির দশকে সিলেটের মোস্তফা আল্লামা গোল্ডকাপখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা মোস্তফা আল্লামা (৭৭)। পুলিশ বাসার দরজা ভেঙে তাঁর মরদেহ উদ্ধার করে। তিনি একাই বাসায় থাকতেন। পরে পরীক্ষায় তার করোনা পজিটিভ শনাক্ত হয়। তাঁর বাড়ি সিলেটের গোলাপগঞ্জে।

গত ২৩ ডিসেম্বর মিশিগানে করোনায় প্রাণ হারান আরেক মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল এম এ জি ওসমানীর ঘনিষ্ঠ সহচর এবাদুর রহমান (৭৪)। তাঁর বাড়ি মৌলভীবাজারের বড়লেখার বর্ণি গ্রামে। এবাদুর রহমানের পুরো পরিবার করোনায় আক্রান্ত হয়। তাঁর স্ত্রী ও দুই ছেলে বেশ কয়েক দিন হাসপাতালে থেকে কিছুটা সুস্থ হন। তিনি নিজে প্রায় ৩ সপ্তাহ হাসপাতালে ছিলেন। তিনি হ্যামট্রামিক শহরের বাংলাদেশ অ্যাভিনিউসহ বায়তুল মামুর মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন।

প্রায় ১ মাস হাসপাতালে থেকে করোনার কাছে হেরে যান মিশিগান স্টেট বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক শামীম আখতার খান (৬২)। তার দেশের বাড়ি সিলেট শহরতলির দক্ষিণ সুরমার পাঠান পাড়া গ্রামে। মৃত্যু হয় সাবেক ইউপি সদস্য এনামুল হকের (৫৫)। তাঁর গ্রামের বাড়ি সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার মাথিউরায়।

করোনায় দুনিয়া থেকে ছাড়তে হয় নিউইয়র্কের লং আইল্যান্ডের নর্থ শোর এলএইজের প্যাথলজিক্যাল বিভাগের ভাইস চেয়ারম্যান ডা. তৌফিকুল ইসলামকে (৬১)। তিনি নিউইয়র্ক বাংলাদেশি কমিউনিটির প্রিয় মুখ এবং বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন অব নর্থ আমেরিকার সাবেক সভাপতি। তিনি দুই সপ্তাহ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ১৩ ডিসেম্বর মারা যান। বাংলাদেশি চিকিৎসকদের মধ্যে তিনি উচ্চপদে ছিলেন। ডা. তৌফিক বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন অব নর্থ আমেরিকার সাবেক সভাপতি। তার স্ত্রী ডা. নাঈমা ভূঁইয়া খ্যাতনামা ডেন্টিস্ট।

গত ২১ ডিসেম্বর নিউইয়র্কের কোনি আইল্যান্ডের বাসিন্দা ইমিগ্রেশন কৌসুলি সাঈদ আলী হায়দার (৪২) করোনায় মারা যান। তিনি ঢাকার বাসিন্দা।

ওয়াশিংটন মেট্রো আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইফতেখার আহমদ করোনা আক্রান্ত হয়ে ৯ ডিসেম্বর ভার্জিনিয়ায় মারা যান। তার দেশের বাড়ি সুনামগঞ্জ।

গত ১৯ ডিসেম্বর মাত্র ৩ ঘণ্টার ব্যবধানে করোনায় নিউইয়র্কে মারা যান পিতা-পুত্র। ব্রুকলিনের বাসিন্দা মোহাম্মদ খাইরুজ্জামান (৬৭) ও তাঁর একমাত্র ছেলে আবুল বাশার (৪৫)। তাদের দেশের বাড়ি সন্দ্বীপে।

করোনায় ৩০ নভেম্বর প্রাণ হারান নিউইয়র্কের বোর্ড অব এডুকেশনের কারিকুলামে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের পথিকৃৎ কুইন্স কলেজের খণ্ডকালীন ও লং আইল্যান্ড সিটি হাই স্কুলের শিক্ষক আবুল কালাম (৭১)। দীর্ঘ ২১ দিন মাউন্ট সিনাই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থেকে মারা যান জ্যাকসন হাইটসের বাসিন্দা গোলাম রহমান (৪৮)। ভাগনির বিয়েতে ঢাকায় বেড়াতে গিয়ে মৃত্যু হয় এলমহার্স্টের শেফালি বেগমের (৫৫)।

ব্রঙ্কসের বাংলাদেশি মোহাম্মদ জাফরের মৃত্যুতে বাংলাদেশিদের সঙ্গে কেঁদেছে মার্কিনরাও। সিএনএন জাফরকে নিয়ে মর্মস্পর্শী একটি প্রতিবেদন প্রচার করলে কেউই চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি। যুক্তরাষ্ট্র যাদের রক্ত ঘামে রঙিন ও মহান হয়ে উঠেছে, জাফর ছিলেন তাদের একজন। নিজে অসম্ভব পরিশ্রম করে ছেলেকে পাঠিয়ে ছিলেন বিখ্যাত হার্ভার্ডে। পেশায় ইয়েলো ক্যাবচালক জাফর নিউইয়র্কের রাস্তায় ট্যাক্সি চালাতেন। মেয়েকে পড়াতেন সেরা ট্রিনিটি স্কুলে। তার জীবনের গল্প থামিয়ে দিয়েছে করোনা। জাফরের দেশের বাড়ি সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া।

পেনসিলভানিয়ার ফিলাডেলফিয়ায় করোনায় মৃত্যু হয় সিলেটের প্রিয়মুখ জুলকারনাইন জায়গীরদারের। সিলেটের হাউজিং এস্টেটের বাসিন্দা জুলকারনাইন ছিলেন একজন নিবেদিত প্রাণ সংগঠক ও সমাজকর্মী।

করোনায় মারা গেছেন মিশিগান কমিউনিটির অন্যতম একজন মুরব্বি কামরুজ্জামান (কমই মিয়া)। তিনি দীর্ঘ দিন সপরিবারে মিশিগান রাজ্যের ওয়ারেন শহরে বসবাস করে আসছিলেন।

করোনায় মৃত্যু হয়েছে মিশিগানে বাংলাদেশি কমিউনিটিতে পরিচিত শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. মোহাম্মদ হোসেনের বাবা সানাওর আলী, আওয়ামী লীগ নেতা ও বিশিষ্ট সংগঠক সিরাজম মুনির, দুদু মিয়া, মদরিছ আলী, বড়লেখা সমিতির উপদেষ্টা চুনু মিয়ার মা নেওয়ারুন নেসা ও বাবা মনির উদ্দীন, আনোয়ার হোসেনের মা, বিয়ানীবাজার সমিতির সভাপতি নুরুজ্জামানের শাশুড়ি সামসুন নেহার, লুৎফুর রহমান, আবদুল আহাদ ও সুফিয়া খাতুন। মারা গেছেন মসজিদের মুয়াজ্জিন মন্তাজ খান। তিনি ডেট্রয়েট শহরের মসজিদুন নুরের দীর্ঘকালীন মুয়াজ্জিন ছিলেন। সবার বাড়ি বৃহত্তর সিলেটের বিভিন্ন স্থানে।

ডেট্রয়েট শহরের অন্যতম মসজিদ আল–ফালাহের খতিব মাওলানা আবদুল লতিফ বলেন, করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। মসজিদের ফিউনারেল হোমে কোভিড-১৯-এ মৃতদের মরদেহ আসছে প্রতিদিন।

নিউইয়র্কের জ্যামাইকা মুসলিম সেন্টার (জেএমসি) আর মিশিগান কমিউনিটির সবচেয়ে পুরোনো মসজিদ মসজিদুর নুরেও প্রায় প্রতিদিন মৃতদের জানাজা হচ্ছে। মসজিদুর নুরের প্রবীণ সদস্য কমিউনিটি নেতা ইকবাল হোসেন চৌধুরী বলেন, কেবল ডিসেম্বরেই করোনায় অন্তত ৩০ জনের মৃত্যু হয়েছে।